সঙ্গীতের শ্রেণি-বিভাজন
নানা দেশে নানা ধরনের গীত-বাদ্য-নৃত্য প্রচলিত রয়েছে। গীত-বাদ্য-নৃত্য অর্থে সঙ্গীত বিবেচনা করলে। প্রথমেই এই তিনটি ভাগের কথাই সর্বাগ্রে উঠে আসে। আবার এর দুটি বা তিনটি ধারার সমন্বয়ে সৃষ্ট সঙ্গীতেরও রয়েছে নানাবিধ ভাগ। আবার বাদ্যযন্ত্রের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ছন্দ ও তাল। সেই সাথে রয়েছে বাণীপ্রধান গানের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরণের ভাগ। সব মিলিয়ে সঙ্গীতের শ্রেণিকরণের ছক যে দীর্ঘতর হয় উঠবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে গোড়াতেও বলে দেওয়া হয়, গীত, বাদ্য, নৃত্য এই তিনটি উপাদান মিলে গঠিত সঙ্গীত জগৎ। এই বিচারে সঙ্গীতকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ইন্দ্রি্য়গত অনুভূতির বিচারে এই বিভাজনে সামান্য অসুবিধা হয়। এই অসুবিধা এড়াতে চাইলে সঙ্গীতকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটি হলো গীতবাদ্য [শ্রবণের বিচারে] এবং নৃত্য [শ্রবণ ও দর্শনের বিচারে]

এমন কোন মানব গোষ্ঠী নেই, যার সঙ্গীত নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা গোষ্ঠীর ভিতর সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছে নানা ভাবে। পৃথিবীর নানা ধরনের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সঙ্গীতও নানা ধরনের হয়ে থাকে। এতসব সঙ্গীতকে আলাদাভাবে নির্দেশিত করার জন্য সঙ্গীতকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। যেমন

  • স্থান বা দেশের বিচারে সঙ্গীত : একটি ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে দেশ বা ভূখণ্ডের বিচারে সঙ্গীতের নামকরণ করা হয়। যেমন  চীনা সঙ্গীত, ইরানের সঙ্গীত, ভারতবর্ষের সঙ্গীত ইত্যাদি। এক্ষেত্রে একটি বড় ভৌগোলিক অবস্থানে প্রচলিত বা অপ্রচলিত সকল ধরনের সঙ্গীতের একটি গড় মানে বিবেচনা করা হয়। এই বড় অবস্থানের ভিতরে ভাগ হতে পারে অপেক্ষাকৃত ছোটো অবস্থানে। যেমন বড় ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে ভারতীয় সঙ্গীত, আর অপেক্ষাকৃত ছোটো ভৌগোলিক অবস্থানে বিবেচনা করা হয়। যেমন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতি, দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতি, পাশ্চাত্য সঙ্গীত পদ্ধতি ইত্যাদি। একই ভাবে ঘরানাও গড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রেও একটি গড়মানে এই ছোটো ছোটো ভাগকে গ্রহণ করা হয়। এইভাবে ক্রমান্বয়ে যদি ভৌগোলিক অবস্থানকে ছোটো করে আনা যায়, তাহলে বাণীবিহীন সঙ্গীতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন বড় একটা নজরে আসে না। পদ্ধতিগত যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে,  ভৌগোলিক অবস্থানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভারতীয় সঙ্গীতের উত্তর ভারতীয় পদ্ধতিতে নৃত্যের, সুরের, বাদনশৈলীর বিচারে যে ঘরানা সৃষ্টি হয়েছে, তার একটি স্থানিক পরিচয় আছে বটে। কিন্তু সে পরিচয় স্থানের দ্বারা আবদ্ধ নয়। বিশেষ ঘরনারা বাদনশৈলী অনুসরণে যেকোনো ভৌগোলিক অবস্থানে হতে পারে। তাতে ঘরানার প্রসার ঘটে কিন্তু পৃথক কোনো পরিচয় বহন করে না। কিন্তু বাণীপ্রধান গানে ভাষার একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। সুর বা দেহভঙ্গিমার প্রকৃতি এবং এর পরিবেষণগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে নানা ধরনের সঙ্গীত হতে পারে। যেমন- নাচের বিচারে মনিপুরী, কথক, ভরতনাট্যম ইত্যাদি। রাগের বিচারে খেয়াল, ধ্রুপদ ইত্যাদি। 
     

  • ভাষার বিচারে সঙ্গীত: যে কোনো ভাষার গান ওই ভাষার সকল সদস্যের গান।  এর গভীর সম্পর্ক থাকে জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের সাথে। ভারতবর্ষের মতো বহুভাষাভাষীর দেশে ভাষাভিত্তিক গানগুলো, ভাষাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক অংশ হয়ে উঠেছে। যেমন ভারতবর্ষে রয়েছে বাংলা গান, হিন্দিগান, তামিল গান ইত্যাদি। ইউরোপের বিচারে তেমনি রয়েছে- ইংরেজি গান, স্প্যানিশ গান, জার্মানি গান ইত্যাদি।

    ভাষাভিত্তিক গান হিসেবে বাংলা গানকে শ্রেণিবদ্ধ করতে গেলে, এর পরিচয় হবে
    ভারতীয় গান>উত্তর ভারতীয় গান>বাংলা গান। এই পরিচয়ের ভিতরে সঙ্গীতের পরিবেশনগত যে বৈশিষ্ট্যে ভাষাটাই প্রধান হয়ে উঠে। খেয়াল গান বাণী নির্ভর নয়, তাই খেয়াল গানের বাণীটা মারাঠি না হিন্দি সে নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। এক্ষেত্রে বাণীটা অবলম্বন হিসেবেই ন্যূনতম উপাদান হিসেবেই কাজ করে। একালের বাঙালি ওস্তাদ বা পণ্ডিতরা মনে করেন যে, বাংলায় খেয়াল হয় না। এঁরা তাঁদের অক্ষমতাকে ভাষার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায় মুক্তির ঘোষণা দেন। কাজী নজরুল ইসলাম 'হারামণি' অনুষ্ঠানে বিলুপ্ত রাগকে উদ্ধার করে, কলকাতা বেতারে প্রচার করেছেন। সে সময়ে তিনি যে সকল বাংলা গান তৈরি করেছিলেন, সেগুলোতো বটেই, এর বাইরে তাঁর রাগাশ্রয়ী বহু গানকে খেয়াল গান হিসেবে পরিবেশন করা যায় স্বচ্ছন্দে। ভাগ্যিস নিধুবাবু, কালীমির্জাদের মতো সঙ্গীতজ্ঞরা বাংলা টপ্পা রচনা করেছিলেন, নইলে হয়তো শুনতো হতো, বাংলায় টপ্পা হয় না।

    ভাষাভিত্তিক অঞ্চল একটি বড় ভৌগোলিক স্থানকে অধিকার করে থাকে। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে, একই ভাষার ভিতরে আঞ্চলিক ভাষারূপ তৈরি হয়। এর সাথে থাকে স্থানিক প্রাকৃতিক পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানদি, অন্যান্য প্রথা, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সব মিলিয়ে স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয় আঞ্চলিক সঙ্গীত। এর মুখ্যস্থান জুড়ে থাকে লোকসঙ্গীত। বাকিটা থাকে নগরকেন্দ্রিক গান। উভয়ের প্রভাবে এই গানগুলো পাল্টায়। নগরকেন্দ্রিক গানে ভাষার প্রমিত রূপ পাওয়া যায়। আঞ্চলিক গানে পাওয়া যায় ভাষার আঞ্চলিক রূপ। তাই লোকগানের ক্ষেত্রে ভাষার আঞ্চলিক উচ্চারণ এবং লোকজ শব্দের বিকৃতি রোধে সচেতন হতেই হয়।
     

    শৈলীর বিচারে সঙ্গীত
    নানান দেশের নানান ধরনের গান শোনা বা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এর ব্যাপ্তিটা আরও বেড়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে মানবগোষ্ঠীর সঙ্গীত চর্চাকে এক সাথে দেখলে, মনে হবে আমরা বিশ্বসঙ্গীতের মেলায় বসে আছি। এই মেলার কেউ পরিবেশক, কেউ বা দর্শক-শ্রোতা। দর্শক শ্রোতার আসনে আমরা যারা আছি, তাঁদের অধিকাংশই সঙ্গীতের ব্যাকরণ জানেন না। কিন্তু এই বিশ্বসঙ্গীতের মেলায় আমরাই শক্তি। ক্রেতা না থাকলে যেমন মেলা বরবাদ হয়ে যায়, তেমনি শ্রোতা না থাকলে সঙ্গীতমেলা সার্থক হয়ে উঠে না।

    দর্শক-শ্রোতা সাধারণ, কিন্তু পছন্দের ক্ষেত্রে তাঁরা অসাধারণ ভূমিকা রাখে। এঁরা সঙ্গীতের ব্যাকরণ জানেন না, কিন্তু মোটা দাগে গানের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারেন। বলতে পারেন এটা রাগসঙ্গীত, এটা ভাওয়াইয়া, এটা বাউল। এই ভাবে কোনো বিশেষ গানকে বিশেষ শ্রেণির মধ্যে ফেলার প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে সঙ্গীতের শ্রেণিকরণের কাজ এগিয়ে চলে। শাস্ত্রকাররা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সঙ্গীতের শ্রেণিকরণ করেন ব্যকারণের বিধিতে। এই ব্যাকরণও আবার তাঁদেরই তৈরি। সাধারণ শ্রোতা-দর্শক সঙ্গীতের শ্রেণিকরণ করেন সহজাত বোধ ও অভিজ্ঞতার রসে চুবিয়ে। যেভাবে হোক যখনই সঙ্গীতের শ্রেণিকরণের কথায় আসা যায়, তখনই ভাবতে হয় এর রূপ নিয়ে। প্রতিটি গানের নিজস্ব রূপ আছে। এরূপ বহু গানের রূপ যখন একটি সাধারণ রূপের জন্ম হয়, তখন একটি বিশেষ সঙ্গীতশৈলীরও জন্ম  দেয়। এই শৈলীর প্রকৃতি অনুসারে সঙ্গীতের যে সকল শ্রেণি তৈরি হতে পারে বা হয়ে থাকে, তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা হলো।
     

    • লোকসঙ্গীত: লোকজীবন নির্ভর স্থানীয় ভাষা ও সুরশৈলীর এই জাতীয় গান গড়ে উঠে। লোকসঙ্গীতই সকল ধরনের সঙ্গীতের উৎস। এই উৎসই তৈরি করেছে। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে যেমন ভাষার ভিন্নতা সৃষ্টি হয়, তেমনি সঙ্গীতেই ভিন্নতা সৃষ্টি করে। একটি উৎস হতে যত ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়তে থেকে, ততই সঙ্গীত শৈলীগুলোর ভিতরে গুণগত পার্থক্য ঘটতে থাকে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুণে এই পার্থক্যের মান একরকম নাও হতে পারে।
       

    • নাগরিক সঙ্গীত: নগরকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বা নগরবাসীর বিনোদনের জন্য সৃষ্ট গান। এই গানের বাণী অংশ প্রমিত ভাষা শৈলীকে অনুসরণ করে। সুরের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ শাস্ত্রীয় শৈলীর সম্পূর্ণ বা আংশিক অনুসৃত হয়। এছাড়া নানা দেশের নাগরিক বা লোকগানের সুর অনুসৃত হয়ে থাকে। অনেক সময় দেশীয় লোকসঙ্গীতের সুরের বাড়তি উপকরণ যুক্ত করে লোক আঙ্গিকের নাগরিক গান তৈরি করা হয়। গানের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে নাগরিক গানে বা যেকোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুরের বিচারে নাগরিক গানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

      • শাস্ত্রীয় সঙ্গীত: বিধিবদ্ধ রীতি অনুসরণ করে, বা শাস্ত্রসম্মতভাবে যে গান তৈরি হয়ে থাকে। ভারতীয় সঙ্গীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল সুরের ভিত্তি মূল উপাদান হলো রাগ। রাগ পরিবেশনের সময় বিশেষ কিছু সুরালঙ্কার ব্যবহার করা হয়। একই সাথে থাকে তালের লয়ের বিস্তার,

        ধ্রুপদ ও খেয়ালকে বিবেচনা করা হয়। এই দুটি শ্রেণির গানের উপর ভিত্তি করে নানান ধরনের আধা-শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎপত্তি ঘটেছে। এই ধারায় পাওয়া যায় ঠুমরি, টপ্পা, গজল ইত্যাদি। এর বাইরে আরও এক শ্রেণির গান রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় রাগাশ্রয়ী গান।
         

      • অশাস্ত্রীয় সঙ্গীত: রাগসঙ্গীতের বিধি অগ্রাহ্য করে, বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা রয়েছে। এই ধারায় গানের বাণীকে সুরারোপিত করা হয়েছে সমকালীন সুর ও ছন্দের নিগড়ে। এই জাতীয় গানকে নানাভাবে নানা সূত্রে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- থিয়েটারের গান, আধুনিক গান, চলচ্চিত্রের গান, রেকর্ডের গান ইত্যাদি। এসব শ্রেণিগত নাম কোনো বিশিষ্ট সুরাঙ্গ বা বিষয়াঙ্গকে বিশেষভাবে নির্দেশিত করে না। মূলত এগুলো গানের উপস্থাপন করার মাধ্যম মাত্র। এ সকল মাধ্যম নির্ভর গানের সুরে যেমন রাগের স্পর্শ পাওয়া যায়, তেমনি খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, গজলও পাওয়া যায়।

        অনেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরের গানকে লঘু সঙ্গীত বলে থাকে। এই বিচারটা অবশ্যই সুরের বিচারে। এই বিচারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বলতেই হয় গুরুসঙ্গীত। কিন্তু বাংলা গানে গুরু সঙ্গীত বলে কিছু নেই।