কণ্ঠসঙ্গীত
কণ্ঠসঙ্গীত হলো সঙ্গীতের প্রধান তিনটি ধারার একটি। মানুষ তার স্বরতন্ত্রীজাত শব্দেকে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিতে পরিণত করে যে সঙ্গীত পরিবেশন করে, তাকেই কণ্ঠসঙ্গীত বলা হয়।


প্রজাতি হিসাবে
Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) বহুবিধ সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে। এর অন্যতম দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো ভাষা এবং সঙ্গীত। পৃথিবীর এমন কোন জাতি-গোষ্ঠী নেই, যাদের ভাষা নেই বা তাদের সঙ্গীত নেই। মানুষ তার কণ্ঠস্বর এবং বাগ্‌প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে যে ভাষা তৈরি করে এবং তা ব্যবহার করতে পারে, তা ভাষা-অর্জনের বিশেষ অংশ মস্তিষ্কে আছে বলেই। একই ভাবে কণ্ঠস্বরকে সঙ্গীতে পরিণত করতে পারে এমন একটি অংশ মস্তিষ্কে আছে বলে, মানুষ সঙ্গীত সৃষ্টি করতে পারে বা উপলদ্ধি করতে পারে। রবীন্দ্র যথার্থই বলেছেন

 

            পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,
                    তার বেশি করে না সে দান।
            আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,
                           আমি গাই গান।

                                        বলাকা-২৮।

কণ্ঠসঙ্গীতের মূল উপাদান হলো
স্বরযন্ত্রজাত ধ্বনি। এই ধ্বনিকে অন্যান্য বাক্‌প্রত্যঙ্গের সাহায্যে নানা বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর করে। এর কোনোটিকে বলা হয়, কণ্ঠবর্ণ, কোনোটিকে বলা হয় ওষ্ঠাধর বর্ণ। ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনির সাথে মানুষ অন্যান্য ধ্বনিও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন পাখির ডাক, সাপের হিস্ হিস্ শব্দ ইত্যাদি। সঙ্গীতে ব্যবহৃত শব্দ হলো তারই একটি প্রকরণ। মানুষ বিশেষ প্রচেষ্টার দ্বারা কণ্ঠের সাধারণ স্বরকে  সঙ্গীতোপযোগী শব্দে পরিণত করতে শেখে। সঙ্গীতশাস্ত্রের বিচারে কণ্ঠসঙ্গীতে সঙ্গীতোপযোগী শব্দ ছাড়া অন্যান্য সকল শব্দই শ্রীহীন।

 

স্বরযন্ত্রের সাধারণ পরিচয়
স্বরযন্ত্রের গহ্বরে একজোড়া স্থিতিস্থাপক পর্দা থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় পাতের মতো পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। এই পর্দা অনেকটা ধ্বনি দ্বারের মতো কাজ করে, তাই এই পর্দাকে বলা হয় ধ্বনিদ্বার (vocal fold) বা স্বরতন্ত্রী (vocal cord)। স্বরযন্ত্রের দুটি ধ্বনিদ্বারের ভিতরে যে ছোট রন্ধ্র রয়েছে তাকেই স্বরপথ বলা হয়। এর অপর নাম স্বররন্ধ্র (glottis)। উন্মুক্ত অবস্থায় স্বরপথ বা স্বররন্ধ্রের আকার দেখায় অনেকটা ইংরেজি V বর্ণের মতো। এমন রুদ্ধাবস্থায় এর আকৃতি সরলাকার ধারণ করে।

 

স্বরতন্ত্রী নিয়ন্ত্রণজাত ধ্বনির প্রকৃতি :
ধ্বনির প্রকৃতি অনুসারে স্বরতন্ত্রী দুটো প্রসারিত বা সঙ্কুচিত করে স্বরপথকে প্রসারিত বা সরু করা হয়। যখন স্বরপথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন এর ভিতর দিয়ে বাতাস সঞ্চালিত হতে পারে না। এই অবস্থায় কোন ধ্বনি তৈরি হয় না। স্বরতন্ত্রী যখন সামান্য প্রসারিত করে সরু স্বরপথ তৈরি করা হয়, তখন এই পথে বাতাস প্রবাহিত হলে স্বরতন্ত্রী দুটো তীব্র বা হাল্কাভাবে কাঁপতে থাকে। এরই ফলে ধ্বনি তৈরি হয়।

স্বরযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা ধ্বনিকে মানুষ কণ্ঠ, জিহ্বা, ঠোঁট, নাক ইত্যাদির সাহায্যে বিভিন্নভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। এই সকল ধ্বনি পার্থক্যগুলোকে এক-একটি পৃথক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করে চিহ্নিত করা হয়। স্বরতন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের দ্বারাই সৃষ্টি করা হয় ধ্বনির প্রকৃতি (অঘোষ, ঘোষ, অল্পপ্রাণ, মহাপ্রাণ ইত্যাদি)। কণ্ঠসঙ্গীতে আমরা যে সুরেলা ধ্বনি শুনি তা হলো স্বরতন্ত্রী দ্বারা উৎপন্ন ধ্বনির পরিশীলিত ও সুখশ্রাব্যরূপ। কণ্ঠস্বরের উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারণেও মূখ্য ভূমিকা রাখে এই স্বরতন্ত্রী।

স্বরতন্ত্রী কম্পিত হলে, একটি সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ধ্বনি উৎপন্ন হতে পারে বা একাধিক কম্পাঙ্ক সমন্বিত শব্দ মিশ্রিতরূপে প্রকাশিত হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ধ্বনিকে বলা হয় সুর
(Tone)। পক্ষান্তরে একাধিক কম্পাঙ্কবিশিষ্ট মিশ্রিত ধ্বনিকে বলা হয় স্বর (Note)। এক্ষেত্রে স্বরের ভিতর সবচেয়ে কম কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট ধ্বনিকে বলা হয় মৌলিক সুর (Fundamental tone), পক্ষান্তরে মৌলিক সুরের চেয়ে সবচেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের সুরকে বলা হয় উচ্চসুর (Over tone)। মানুষ স্বভাবতই সঙ্গীতের পরিমার্জিত স্বর অনুসরণ করে কথা বলে না বটে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে ধ্বনি বা সুর থাকে। স্বাভাবিকভাবে মানুষ কথা বলার সময় একাধিক সুর উৎপন্ন করে এবং তা মিশ্ররূপেই পাওয়া যায়। তারপরেও তা সঙ্গীতশাস্ত্রের বিধিবদ্ধ সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে না বলে তাকে স্বর হিসাবে বিবেচনা করা হয় না।
 

চিত্র-১

চিত্র-২

মানুষ প্রয়োজন সাপেক্ষে কখনও জোরে কথা বলে আবার কখনও বা ফিসফিস করে বলে। এক্ষেত্রে শব্দের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন ঘটে না, ঘটে শব্দতরঙ্গের বিস্তারে। যখন একটি শব্দ তরঙ্গের আকার বড় হয়, তখন তা জোরালো শোনা যায়। মানুষ যখন স্বরতন্ত্রীর উপর বাড়তি জোর দিয়ে ধ্বনির বিস্তার বাড়িয়ে দেয়, তখন শব্দ জোরালো হয়ে উঠে। পাশের চিত্র-১ লক্ষ্য করুন। এখানে দুটো ধ্বনির তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য একই। কিন্তু ক সংখ্যক ধ্বনির বিস্তার বেশি বলে, এটি জোরে শোনা যাবে। পক্ষান্তরে খ সংখ্যক ধ্বনি শোনা যাবে আস্তে। এক্ষেত্রে শব্দের বিস্তারের উপর নির্ভর করে শব্দের তীব্রতা (Intensity) বা শব্দ-উচ্চতা (Loudness)

আগেই বলেছি প্রতিটি সুর সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে বাঁধা থাকে। যদি এই কম্পাঙ্কের সংখ্যাকে বৃদ্ধি করা যায়, তা হলে শব্দ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। এই জাতীয় শব্দকে আমরা সাধারণত চিকন সুর বলে থাকি। পুরুষ কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক কম বলে, পুরুষের কণ্ঠস্বর মোটা এবং মেয়েদের কণ্ঠস্বরের কম্পাঙ্ক বেশি বলেই, মেয়েদের কণ্ঠস্বর চিকন শোনায়। সঙ্গীতযন্ত্রে ব্যবহৃত খাদের সুরগুলো থাকে কম কম্পাঙ্কের কিন্তু তারার সুরগুলো হয় উচ্চ কম্পাঙ্কের। একই সঙ্গীত স্কেলের শুরু ও শেষের স্বরের এই পার্থক্য স্পষ্টই বুঝা যায়। যেমন
A স্কেলের আদি স্বরের কম্পাঙ্ক যদি হয় ৪৪০, তা হলে এর শেষের সি-এর কম্পাঙ্ক হবে ৮৮০। কম্পাঙ্ক নির্ভর শব্দের এই গুণকে বলা হয় শব্দ-তীক্ষ্ণতা (Pitch)। পাশের চিত্র-২ লক্ষ্য করুন। প্রথম ক ধ্বনিটি মোটা শোনাবে কারণ এর কম্পাঙ্ক কম। কিন্তু নিচের খ ধ্বনিটির কম্পাঙ্ক বেশি বলে, এই ধ্বনিটি চিকন শোনাবে।

শব্দ ও মনুষ্য উচ্চারিত ধ্বনি
শব্দের গুণের
(Quality) তারতম্যও একটি লক্ষ্য করার বিষয়। ধরা যাক, আপনি একটি মেয়ে এবং একটি ছেলেকে কোন সঙ্গীতযন্ত্রের সাথে সা স্বরটি প্রলম্বিত ও সুরেলা করে গাইতে বললেন। যদি তারা সেই ভাবেই যথার্থ সুরে সা ধ্বনিটি পরিবেশন করে, তারপরেও একটা পার্থক্য বুঝা যাবে। এক্ষেত্রে মূল পার্থক্যটি তৈরি হবে কম্পাঙ্কের সূত্রে। ধরা যাক সঙ্গীতযন্ত্রের সা ধ্বনিটি ২৪০ কম্পাঙ্ক হিসাবে নির্বাচন করেছেন। ছেলেটি যদি ২৪০ কম্পাঙ্কে সা মিলায়, আর মেয়েটি ৪৮০ কম্পাঙ্কে কণ্ঠ মেলায়, সেক্ষেত্রে দুটো কণ্ঠস্বরই সঙ্গীতযন্ত্রের সা এর সাথে মিলবে। কিন্তু পরস্পরের কণ্ঠস্বর পৃথক ধ্বনি হিসাবে মনে হবে। আগেই বলেছি- স্বর হলো একাধিক কম্পাঙ্কের ধ্বনির সমন্বিত রূপ। এই সমন্বয়ের তারতম্যের কারণে শব্দরঞ্জন (Timbre) পাল্টে যাবে। ফলে ছেলে ও মেয়ের কণ্ঠ একই মনে হবে না। একই কারণে দুটি পুরুষকণ্ঠ থেকে উৎপন্ন একই কম্পাঙ্কের স্বর-ধ্বনি মান অভিন্ন মনে হবে না।

জন্মগতসূত্রে প্রতিটি মানুষ একটি মৌলিক সুর কণ্ঠে ধারণ করে। এই মৌলিক সুরটির দ্বারাই মানুষের কণ্ঠস্বরের পার্থক্য নিরূপিত হয়। শৈশবে মানবশিশুর কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা বেশি থাকে, সেই কারণে সকল শিশুর কণ্ঠই মেয়েদের মতো চিকন শোনায়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বরতন্ত্রীর পরিবর্তন ঘটে। মেয়েদের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন এক্ষেত্রে বড় বেশি বুঝা যায় না, কিন্তু ছেলেদের স্বর মোটা হয়ে যায়। মানুষের জীবনে কণ্ঠস্বরের এই পরিবর্তন ঘটে সাধারণত ১২-১৪ বৎসরের দিকে।

 

মানুষের সুরেলা শব্দের প্রকৃতি
মানুষ কোনো অর্থবোধক ধ্বনি ছাড়াই প্রবহমান ধ্বনি তৈরি করতে পারে বা করে থাকে। মানুষ এই প্রবহমান ধ্বনিকেই সাধনার দ্বারা সঙ্গীতোপযোগী করে তোলে। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে একটি বিশেষ মৌলিক ধ্বনি উৎপাদনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই সহজাত ধ্বনিকে মানুষ সঙ্গীতে ব্যবহৃত কোনো ধ্বনির মতো করার চেষ্টা করে। এবং এক সময় সে সঙ্গীতোপযোগী নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ধ্বনির সাথে নিজের কণ্ঠধ্বনিকে মেলাতে সক্ষম হয়। কিন্তু জন্মসূত্রে পাওয়া ধ্বনিকে কখনো পরিবর্তন করতে পারে না। মূলত মানুষ জন্মসূত্রে পাওয়া ধ্বনির সাথে, আরও কিছু সহায়ক ধ্বনি সৃষ্টি করে এবং নিজের ধ্বনির সাথে এমনভাবে সমন্ব করে যে, নিজের স্বরধ্বনি এবং অন্যান্য ধ্বনি মিলেমিশে একটি মিশ্র রূপ লাভ করে। ফলে সাধনার দ্বারা সৃষ্ট ধ্বনি হয়ে উঠে সঙ্গীতোপযোগী