সঙ্গীত
সঙ্গীত হলো-দর্শনেন্দ্রিয় ও শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা
উপস্থাপিত শিল্পকলা।
ভারতীয় কলাশাস্ত্রে
সঙ্গীতের স্থান সর্বোচ্চ স্তরে।
ভারতীয় সঙ্গীততত্ত্ব অনুসারে সঙ্গীতের সাধারণ শ্রেণিবিভাজন
হিসেবে উল্লেখ করা হয় গীত, বাদ্য ও নৃত্য।
কিন্তু সঙ্গীত শব্দের
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে নৃত্য ও বাদ্যের কথা পাওয়া যায় না।
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়-
ডিভ্জে বাবে বাঁশি
ম্যামথ হাতির
অস্থিজাত বাঁশি
হোহ্লে ফেল্স্
বাঁশি
সত্তা
(entity):
আমাদের চেতনায় অন্যান্য সকল
সত্তার মতোই, সঙ্গীতও একটি সত্তা হিসেবেই থাকে। আমাদের চেতনায় বিরাজমান সকল
সত্তার দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। এক ধরনের সত্তা আছে যাদের ওজন আছে এবং জায়গা
দখল করে। এই গুণের সূত্রে মূর্ত সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আর কিছু সত্তা আছে,
যাদের ওজন নেই জায়গা দখল করে না। এগুলো বিমূর্ত সত্তা। এগুলো দৃশ্যমান কোনো মূর্তি তৈরি করে না। এই
জাতীয় সত্তাকে বলা হয় বিমূর্ত সত্তা। সঙ্গীততত্ত্বে সঙ্গীত হলো-
গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিত কলা। এর ভিতরে গীত ও বাদ্য শ্রবণযোগ্য। কিন্তু নৃত্য
চোখে দেখা যায় এবং এর একটি ত্রিমাত্রিক রূপ আছে, যা নৃত্যশিল্পীর দেহাশ্রিত হয়ে
উপস্থাপিত হয়। কিন্তু নৃত্যের নান্দনিক রূপ বিমূর্ত।
প্রাথমিকভাবে সঙ্গীতকে বিমূর্ত ও মূর্ত এই দুই ধরনের সত্তার সমাহার বলা যায়। শ্রবণ এবং দর্শনের
বিচারে সঙ্গীত নামক সত্তাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সঙ্গীতের বিমূর্তসত্তার রূপরেখা
√
গৈ
(গীত করা) +
ত
(ক্ত),
কর্মবাচ্য
এই বিশ্লেষণে সম উপসর্গ একটি অর্থ হলো- সমবেত। এই অর্থানুসারে সঙ্গীত শব্দের অর্থ দাঁড়ায়- সমবেতভাবে কণ্ঠ দ্বারা উপস্থাপিত কলা। আবার সম উপসর্গটি
ভিন্নার্থে হয় সম্যক (পূর্ণ)। এই সূত্রে সঙ্গীতের অর্থ দাঁড়ায়- যা শুদ্ধ বা পূর্ণ রূপ গীত হয়ে থাকে। রূপতাত্ত্বিকের বিচারে যাই হোক, ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে 'গীত-বাদ্য-নৃত্য'
নৃত্যের সমাহার। সম্ভবত সঙ্গীতের শুরুর দিকে ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞরা শুধু কণ্ঠসঙ্গীতকেই সঙ্গীত হিসেবে বিবেচনা করতেন।
এর অনুসঙ্গ হিসেবে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতো। এই
বাদ্যযন্ত্রের ভিতরে ছিল সুরের জন্য ব্যবহৃত হতো - তত ও সুষির যন্ত্র, আর তাল
রক্ষার জন্য আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্র। প্রায় একই সময়ে সঙ্গীতের অনুষঙ্গী হিসেবে এর সাথে
যুক্ত হয়েছিল বাদ্যযন্ত্র। তখন গীত ও বাদ্য নিয়ে সঙ্গীতের মিশ্র রূপ প্রকাশিত হয়েছিল।
আবার আদিম জনগোষ্ঠীর ভিতরে নৃত্যশৈলীর উদ্ভব হয়েছিল-
অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে আনন্দকে প্রকাশ করার জন্য। শিকার বা
গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে বিজয়ী হয়ে- অঙ্গভঙ্গীর মধ্য দিয়ে নৃত্যের
আদি রূপের বিকাশ ঘটছিল। কালক্রমে গীত-বাদ্য-নৃত্য-
এই ত্রয়ী কলার সমষ্টিগত নাম দাঁড়িয়েছিল- সঙ্গীত।
সম্-
পণ্ডিত অহোবলের রচিত 'সঙ্গীত পারিজাত' গ্রন্থে- সঙ্গীতের সংজ্ঞা হিসেবে যেন এরই সমর্থনে পাই- "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতেতে।
গীত, বাদ্য নৃত্যের সমন্বিত নামবাচক পদ হিসেবে সঙ্গীত শব্দটি, নিতান্তই
সঙ্গীতশাস্ত্রের পারিভাষিক নাম। মূলত এর দ্বারা সঙ্গীতের তিনটি
প্রধান শাখার নাম হিসেবে পাওয়া যায়। সরলার্থে বলা যায়-
একে বলা যায়, গীত বিষয়ক সঙ্গীত, বাদ্য বিষয়ক সঙ্গীত ও নৃত্য বিষয়ক সঙ্গীত।
√বদ্ (বলা) +ই (ণিচ)। এখানে 'বলা'
শব্দের ভাবার্থ হলো- প্রকাশ করা। এই ণিজন্ত ক্রিয়ামূল
√বাদি থেকে উৎপন্ন হয়েছে বাদ্য শব্দ। এর রূপ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো-
√বাদি (প্রকাশ, বলা) +ষ (যৎ), কর্মবাচ্য। এই বিচারে বাদ্য শব্দের সাধারণ
অর্থ দাঁড়ায়- কোনো বিষয়কে
প্রকাশ করা। সঙ্গীতশাস্ত্রের পারভাষিক শব্দ হিসেবে বিশেষ অর্থ হলো- যন্ত্রের
মাধ্যমে সুর ও তালের
প্রকাশ। আর যে যন্ত্রের মাধ্যমে এই প্রকাশ ঘটে, তার নাম বাদ্যযন্ত্র।
বাদ্যযন্ত্রের গাঠনপ্রকৃতি হিসেবে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- তত, সুষি,
ঘন, আনদ্ধ ও ব্র্যাস। ব্যবহারের বিচারে বাদ্যযন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত। ভাগ দুটি
হলো- সুরযন্ত্র ও তালযন্ত্র। এই দুই ধরনের যন্ত্রই একক বাদনে বা গীত ও নৃত্যের
অনুষঙ্গী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
সঙ্গীতের এই বিশেষ শাখার মূল বিষয় হলো কণ্ঠসঙ্গীত। এই শাখায় নৃত্য বা বাদ্যের
ব্যবহার না হলেও একে কণ্ঠসঙ্গীতই বলা হয়। বাংলাভাষীরা সঙ্গীত বলতে
প্রথমে ধরে নেন- কণ্ঠসঙ্গীত। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই আমরা শুনে থাকি- 'এখন
সঙ্গীত পরিবেশন করবেন- অমুক শিল্পী'। এখানে সঙ্গীত এবং গীত
সমার্থক। এই অর্থেই বলা হয়ে থাকে
রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, পল্লীসঙ্গীত ইত্যাদি।
এর বিচারের সঙ্গীতের সমার্থক শব্দাবলী হতে পারে- কণ্ঠসঙ্গীত, গীত, গান।
সঙ্গীতের প্রকৃতি
গীত, বাদ্য, নৃত্য—
এই তিন-এর সমন্বয়ে গড়ে উঠা সঙ্গীত জগতে মানুষ বিচরণ করে এবং মানসিকভাবে আলোড়িত হয়,
এই কারণে সঙ্গীত বিমূর্ত। সঙ্গীতের উপাদানসমূহের ভর নেই এবং বস্তুজগতে জায়গা দখল
করে না। এই অর্থেও সঙ্গীত বিমূর্ত। যদিও নৃত্যকলায় নৃত্যশিল্পী জায়গা দখল করেন এবং
এদের ভরও আছে, কিন্তু নৃত্যশিল্পীরা নান্দনিক দৃশ্য রচনা করে, মনোজগতে যে স্থানটি
করে নেন, তা ভরহীন এবং তা বস্তুজগতের বাইরে ভিন্নতর বিমূর্ত মনোজগতের।
সঙ্গীত মানুষের সহজাত মানসিক ক্রিয়াত্মক উপাদান। এমন কোন মানবগোষ্ঠী নেই, যাদের
ভাষা এবং গান নেই। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের জন্য, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তার
কোষস্তরের জিনকোডে আছে। এই সূত্রে মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ডিভাইস রয়েছে। একে বলা যায়,
সঙ্গীতের উপলব্ধি এবং প্রকাশের ডিভাইস। এই উপকরণ আছে বলেই মানুষ সঙ্গীত সৃষ্টি করতে
পারে এবং সঙ্গীতকে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু সুর ও ছন্দের সমন্বয় সঙ্গীতর যে নান্দনিক
রূপ ফুটে উঠে তা বিকশিত হয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। এই শিক্ষা ভাষার মতোই। শৈশব থেকে
প্রতিটি মানব শিশু বড়দের সাহায্যে এক বা একাধিক ভাষা শিখে নেয়। সঙ্গীতকেও তেমনি
শিখতে হয়। মনুষ্য জাতি আজকের সঙ্গীতশাস্ত্রে পৌঁছেছে ক্রমবিবর্তনের ধারায়।
সঙ্গীত মাত্রেই উপস্থাপনযোগ্য এবং তা সময়ের সাথে বাঁধা। সঙ্গীতের যে কোন বিষয়
উপস্থাপিত হয় সময়ের প্রবহমান ধারায়। বর্তমান নামক ক্ষুদ্র সময়ে মানুষ সঙ্গীতের একটি
ক্ষুদ্র অংশকে উপলব্ধি করতে পারে। এরপর তা হয়ে যায় অতীত। কিন্তু সদ্য অতীত হয়ে
যাওয়া অংশের একটি রেশ রয়ে যায় তাঁর স্মৃতিতে এবং পরে তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়।
সঙ্গীতের প্রবহমান ধারায় এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করে,
মনে জগতে একটি বিমূর্ত চিত্র রচিত হয়। আর সেই বিমূর্ত চিত্রের অসংখ্য আনন্দের মধ্য
দিয়ে সৃষ্টি হয়, সঙ্গীতের সৌন্দর্য।
চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদির মতো কলাগুলোর সাথে সঙ্গীতের বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি
করে সময়। রঙ-তুলিতে চিত্রশিল্পী যে ছবি আঁকেন, ওই শিল্পী ওই চিত্রকে বার বার
একইভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এবং তা দর্শক উপলব্ধি করতে পারেন এবং দর্শক তা বার বার
একই ভাবে দেখতে পারেন বা অন্যকে দেখাতে পারেন। সঙ্গীত-চিত্রটি যন্ত্রে সাহায্যে বার
বার উপস্থাপন করা যায় বটে। কিন্তু প্রতিবারেই দর্শক বা শ্রোতাকে এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
অংশগুলোকে একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করেই উপলব্ধি করতে হয়। এই চিত্রকর্মটি
ত্রিমাত্রিক জগতে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে অভিজ্ঞ করে তোলে। পক্ষান্তরে
সময়ের প্রবহমান ধারায় সঙ্গীত বাঙময় হয়ে উঠে, ফেলে যাওয়া স্মৃতির লেজ ধরে ধরে। যেন
সুরের বাঁদরগুলো লেজ ধরে ধরে চলেছে। আমরা বর্তমানের বাঁদরটাকে দেখি, অতীতের
বাদরগুলোকে মনে রাখি লেজের সূত্রে। এইভাবেই তৈরি হয়, শ্রোতার মনে শ্রবণের নান্দনিক
শৃঙ্খল এবং শৃঙ্খলা।
গীতের প্রধান মাধ্যম কণ্ঠস্বর। এর বাণী মূলত গীত-বাদ্য ও নৃত্যের মধ্যে কণ্ঠসঙ্গীতই
প্রধান। বাণী, সুর ও ছন্দের মিলনে গীত হয়ে ওঠে পূর্ণ ও মহিমান্বিত। এই পূর্ণতার
দাবীতে গীত শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠে সঙ্গীত।
সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা
মূলত
ভাষা হলো দুই বা ততোধিক সত্ত্বার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম।
জীবজগতের সকল প্রজাতিই নিজেদের মধ্যে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। প্রজাতিগত
পার্থক্যের সূত্রে প্রতিটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব রূপ। জীবজগতের সদস্য হিসেবে মানুষের
ভাষারও রয়েছে স্বতন্ত্র রূপ। মানুষের ভাষার
জন্য রয়েছে দুটি প্রধান জৈবিক উপকরণ। এর একটি হলো
বাক্প্রত্যঙ্গ ।
অপরটি হলো বাক্য সংগঠনকারী মস্তিষ্কের সক্রিয় জৈবিক অংশসমূহ। যাকে বলা যায় ভাষা
সংগঠক ডিভাইস। এই দুটি প্রধান উপাদান মানুষের সহজাত। আদিম মানবগোষ্ঠীর ভিতর ভাষার
সাথে সাথে মস্তিষ্কের সুরবোধক অংশেরও বিকাশ ঘটেছিল। এই কারণেই ভাষা ও সঙ্গীতকে
সহোদরা বলা হয়। এই কারণেই এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষা শিখতে পারে এবং ওই ভাষার গানও
শিখতে পারে। এই বিচারে ভাষার ব্যাকরণ এবং এবং সঙ্গীতের ব্যাকরণ সকল মানুষের জন্য
একই। মোটা দাগে আমরা যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সঙ্গীতের পার্থক্য দেখি, তা হলে সময় এবং
আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার সূত্রে সৃষ্টি হয়েছে।
আদি মানুষ কিছু প্রতীকী ধ্বনি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা শিখেছিল। গোড়ার দিকে তারা
বাক্য তৈরি করতে শিখে নি। আদিম মানুষ গুটিকয়েক শব্দ ব্যবহার করতো তার চারপাশের
প্রাকৃতিক উপকরণকে প্রকাশ করার জন্য। তারা শিকারী পশু, পানি, মেঘ, বৃষ্টি ইত্যাদির
মতো জীবনঘনিষ্ট শব্দের ব্যবহার করা শিখেছিল। এই সময় সৃষ্টি হয়েছিল
অন্তর্গামী ধ্বনি
(Ingressive sound)
বহির্গামী ধ্বনি ( ( Egressive
sound)
শব্দের আদি রূপ ।
গোড়া থেকেই অবচ্ছিন্ন
স্বরধ্বনির প্রাধান্য ছিল। তারা এর সাথে আ, উ জাতীয় শব্দ তৈরি করতো। এরপর বিচ্ছিন্ন
ধ্বনিধর্মী কিছু ব্যঞ্জনধ্বনী যুক্ত হয়ে ধ্বনিবৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছিল।
এর ভিতর দিয়ে শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল।
ভাষা ও সঙ্গীতের দ্বিতীয় ধাপে মানুষ ছোট ছোট বাক্য তৈরির প্রক্রিয়া শিখেছিল। একই
সাথে ভাব প্রকাশের জন্য বাক্যের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল সুর। এই সুর মানুষ ব্যবহার করা
শিখেছিল কণ্ঠস্বরের অবচ্ছিন্ন ধ্বনিপ্রবাহের বর্ধিত
ব্যবহারে। একাধিক শব্দের বিচ্ছিন্ন রূপকে অবচ্ছিন্ন ধারায় বহমান করে তোলে অবচ্ছিন্ন
ধ্বনি। ভাবের প্রকৃতি অনুসারে অবচ্ছিন্ন ধ্বনির-প্রকৃতি পাল্টায়। এর ভিতর দিয়ে জন্ম
নেয় প্রশ্নের সুর, বিস্ময়ের সুর, বেদনার সুর ইত্যাদি। সঙ্গীতের সুর হলো শব্দ ও
বাক্যের সুরের নান্দনিক উপস্থাপন। এই নান্দনিক বোধেই সেকালের মায়েরা শিশুদের শান্ত
করতো, শাসনও করতো। সেকালের মায়েরাও শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য কোমল স্বরে, কোমল সুরে
সম্মোহিত করতো। শিকারী পুরুষ ধনুকের টঙ্কারে সুরের সন্ধান পেয়েছিল
এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়েছিল ততযন্ত্র।
ওষ্ঠাধরে গাছের পাতা চেপে ধরে, শ্বাসাঘাতে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির অভিজ্ঞতা লাভ
করেছিল। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল রিড জাতীয় যন্ত্র। আর নল খাগড়ার
মতো খোলা নলে শ্বাসাঘাতে উৎপন্ন সুরেলা ধ্বনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বাঁশি।
আদিম মানুষ কাঠে কাঠে বাড়ি দিয়ে বা হুঙ্কার দিয়ে হিংস্র পশুদের ভয় দেখাতো।
শব্দ সৃষ্টির আরও একটি মাধ্যম তৈরি হয়েছিল পশুর চামড়া দিয়ে আবৃত
আনদ্ধ যন্ত্র। এরই উন্নত সংসকরণ ব্যবহৃত হতো যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাক,
কাড়া-নাকাড়ার মতো গম্ভীর ধ্বনি উৎপদক যন্ত্র।
ঘাতযন্ত্রের মাধ্যমে ছন্দের দোলা অনুভব করেছিল তারা।
আদিম দেখেছিল বায়ু প্রবাহে ঘাসের ভরা মাঠে জেগে ওঠা দোলা, কিম্বা বৃক্ষশাখা আন্দোলন,
জলাশয়ে জলতরঙ্গমালা। সে দোলা লেগেছিল মানুষের মনে। সে দোলা থেকে উদ্ভব হয়েছিল
ছন্দের আরও পরে ছন্দ থেকে উদ্ভব হয়েছিল তালের। ছন্দের দোলা
লেগেছিল আদিম মানুষের আদি ভাষায় এবং আদিম গানে। তারা সুরের ছন্দকে শ্রবণযোগ্য করে
তুলেছিল করাঘাতে কিম্বা কঠিন বস্তুতে আঘাত করে।
যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল নানাবিধ আনদ্ধ যন্ত্র।
আদিম মানুষ মনের ভাবকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শব্দের দুঃষ্প্রাপ্যতার অভাব
পূরণ করতো হাতের নানারকম ভঙ্গী দিয়ে। আধুনিক মানুষও সেই রীতিতেই ধ্বনি এবং হস্তভঙ্গী
মিশিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। ধ্বনির ছন্দে
দেহে ছন্দ জাগবে, এটিও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ।
এই প্রবৃত্তির সূত্রে
মানুষের আদিম নৃত্যের সূচনা ঘটেছিল।
মানুষ প্রথম বাদ্য যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শিখেছিল তার নিজের বাক্যন্ত্রকে।
বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণিকরণে একে বলা যায় শুষির যন্ত্র
(wind instrument)
। মানুষ তার শারীর যন্ত্রের বাইরে সুর সৃষ্টি করেছিল পাতার বাঁশি, নলখাগড়া বা এই
জাতীয় নলাকার বস্তুর ব্যবহারে। আদিম কালের সে সকল উপকরণ কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে।
অবশ্য হাড়ের তৈরি কিছু দু চারটি বাঁশির নমুনা পাওয়া যায়।
বাঁশির সুরে আদিম সঙ্গীত
গাছের পাতায় ঠোঁটে চেপে বাতাসের প্রবাহে সুরেলা ধ্বনি তৈরি করা যায়। গ্রামে অনেক
শিশুদের কাছে এটা খেলার সামগ্রী। এই খেলা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল পাতার বাঁশি।
প্রাগৈতিহাসিক হোমো গণের কিছু কিছু প্রজাতি পশুর হাড় ব্যবহার করতো নানা কারণে। এর
ভিতরে নরমবস্তি থ্যাঁৎলানোর জন্য, শিকারের জন্য এরা শক্ত এবং বড় বড় হাড় ব্যবহার
করতো। ছোটো ছোটো হাড় পাথরে ঘষে ধারালো করতো এবং তা বর্শার মাথায় ব্যবহার করতো।
সেটাও ছিল শিকারের জন্য। এরা লক্ষ্য করেছিল বড় বড় হাড়ের ভিতরে থাকে ফাঁপা অংশ। হয়তো
খেলাচ্ছলেই এই হাড়ের ভিতর ফুঁ দিয়ে সুরেলা ধ্বনির সন্ধান পেয়েছিল। পরে এর গায়ে ফুটো
তৈরি করে সুরের বৈচিত্র্য এনেছিল এরা।
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের সূত্রে প্রাপ্ত হাড়ের বাঁশিগুলোর ভিতরে, এখন পর্যন্ত
স্লোভিনার ডিভ্জে বাবে (Divje Babe)
অঞ্চলের গুহাভল্লুকের হাড়ের বাঁশিকে সর্বপ্রাচীন ধরা হয়। এই বাঁশিটির নামকরণ করা
হয়েছে ডিভ্জে বাবে বাঁশি । ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিভ্জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক
ক্ষেত্র থেকে এই বাঁশিটি উদ্ধার করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই বাঁশি তৈরি
করেছিল নিয়ানডার্থাল-রা। অনেকে অবশ্য মনে করেন- এই বাঁশি তৈরি করেছিল
ক্রো-ম্যাগনোন-রা।
বিজ্ঞানীরা এই বাঁশির তৈরি সময় হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩,১০০ অব্দ নির্ধারণ করেছেন।
উদ্ধারকালে এই বাঁশিটির দুটি ফুটো অক্ষত রয়েছিল। এর উভয় পাশের ভাঙা অংশ দেখে মনে
হয়েছিল আরো দুটো ফুটো ছিল। ধারণা করা হয়, পূর্ণাঙ্গ বাঁশিতে হয়তো আরও বেশি ফুটো ছিল।
বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল এক বা দুই বছরের গুহাভল্লুকের বাম-ঊর্বাস্থি
(left femur)
থেকে। এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩৩.৬ মিলিমিটার (৫.৩৬ ইঞ্চি)। এর পূর্ণাঙ্গ ফুটোর ব্যাস ছিল
৯.৭ এবং ৯ মিলিমিটার। ফুটো দুটোর কেন্দ্রবিন্দুর দূরত্ব ৩৫ মিলিমিটার (১.৩৮ ইঞ্চি)।
ডিভ্জে বাবে বাঁশির পরে প্রাচীন বাঁশি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে প্রায় ৪০,০০০
বৎসর পূর্বে ম্যামথ হাতির অস্থি দিয়ে তৈরি বাঁশি (mammoth-ivory
flutes ) । এই বাঁশি পাওয়া গিয়েছে জার্মানিতে।
এই বাঁশিটির দৈর্ঘ্য ১৮.৭ সেন্টিমিটার। বাঁশির গায়ে তিনটি ফুটো পাওয়া গিয়েছে।
ডিভ্জে বাবে বাঁশির পরে প্রাচীন বাঁশি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে হোহ্লে ফেল্স্
বাঁশি (Hohle Fels Flute)
বাঁশি। এই বাঁশিটি পাওয়া গেছে জার্মানির সোয়াবিয়ান এলব
(Swabian Alb)
অঞ্চলের হোহ্লে ফেল্স্ গুহায়। এই বাঁশিটি তৈরি করা হয়েছিল শকুনের ডানার হাড় থেকে।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০০ বৎসর পূর্বে এই বাঁশিটি তৈরি করা হয়েছিল।
সম্ভবত মানুষ সঙ্গীতের প্রাথমিক উপলব্ধি বিলুপ্ত আদিম নৃগোষ্ঠীদের কাছ থেকে পেয়েছিল।
মানুষের মস্তিষ্কে 'সঙ্গীত অর্জনের ডিভাইস' থাকার কারণে মানুষ সঙ্গীতকে গ্রহণ করতে
পেরেছিল। মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়া হোমো গণের অন্যান্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে
গেছে। শেষ পর্যন্ত মানুষই সঙ্গীতের উত্তারিকারের দাবিদার হয়ে উঠেছে এবং মানুষই
চর্চার মধ্যদিয়ে আজকের বিশ্বসঙ্গীতের উৎকৃষ্টতর স্তরে আনতে সক্ষম হয়েছে। আদিম
বাঁশির এ সব নমুনা দেখে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে- আদিম নৃগোষ্ঠীর ভিতরে
সুরবোধ জন্মেছিল আরো আগে। সম্ভবত সুদূর অতীতে সঙ্গীতের তিনটি ধারাই ধীরে ধীরে
বিকশিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এই তিনটি ধারার ক্রমবিমূর্তন বর্ণনা করা মতো যথেষ্ঠ
নমুনা আমাদের কাছে নেই। ধারণা করা হয় প্রায় ৩.৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে হোমো
গণের উন্নততম প্রজাতি স্যাপিয়েন্সের তথ্যা মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার
মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud
) অঞ্চলে। ২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা
আফ্রিকার ইথিওপিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর এখান থেকে মানুষ ক্রমে
ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলসহ সকল মহাদেশ, দ্বীপ-উপদ্বীপে। নানা
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া মানুষের ক্রমবিবর্তন ঘটেছিল দৈহিক ও সাংস্কৃতিক সত্তায়।
সঙ্গীতের আঞ্চলিক
রূপরেখা
প্রথম দিকে মানুষের সাংস্কৃতিক উপাদান তথা ভাষা, সঙ্গীত ও অন্যান্য মানবিক
আচার-আচরণ একই ছিল। প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন এবং খাদ্যসঙ্কটের সূত্রে মানুষ যখন
দলবদ্ধভাবে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল, তখন কাছাকাছি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সাম্য ছিল।
কিন্তু বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিতরে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সূচনা হয়েছিল।
ক্রমান্বয়ে কোনো নৃগোষ্ঠী যখন মূল নৃগোষ্ঠী থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, তখন
সাংস্কৃতিক সত্তার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছিল। এই পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল-
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই সূত্রে আঞ্চলিক ভাষা ও সঙ্গীতের
ধারাই বিচ্ছন্ন স্বত্ন্ত্র ধারায় পরিণত হয়েছিল। মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির
প্রাগৈতিহাসিক স্তর পেরিয়ে যখন প্রাচীন ঐতিহাসিক স্তরে প্রবেশ করেছিল, ভাষা ও
সঙ্গীত ভূখণ্ড-ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য রূপ লাভ করেছিল এবং যাকে আমরা বড় ধরনের
সাংস্কৃতিক একক হিসেবে অভিহিত করে থাকি। যেমন- প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি, প্রাচীন
ভারতীয় সংস্কৃতি, প্রাচীন আফ্রিকান সংস্কৃতি ইত্যাদি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা
সংস্কৃতির বিকাশের সূত্রে গড়ে উঠছে অঞ্চলভিত্তিক ভাষা, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম ইত্যাদি।
সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরণে সঙ্গীতের স্বরূপ উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে- কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য সভ্যতার নাম অনিবার্যভাবে চলে আসে। যেমন- গ্রিক/রোম, চিন, পারশ্য,
ভারতবর্ষ, মায়া, মিশর ইত্যাদি। সঙ্গীতের ক্রমবিকাশের ধারায় আঞ্চলিকাতার বিচারে
নানাভাগে ভাগ করে থাকি। যেমন-
ভাষার
বিচারে গান:
বাণীপ্রধান গানে
আঞ্চলিক ভাষা, আঞ্চলিক সুর ও তালের
একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। যেমন—
ভারতবর্ষে রয়েছে বাংলা গান, হিন্দিগান, তামিল গান ইত্যাদি। ইউরোপের বিচারে
তেমনি রয়েছে-
ইংরেজি গান, স্প্যানিশ গান, জার্মানি গান ইত্যাদি।
আবার একই
ভাষার ভিতরে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা ও সুর-তালের প্রভেদ। মূলত একটি বড় ভাষা-পরিমণ্ডলের
সামগ্রিক রূপরেখা হলো-, তার সকল আঞ্চলিক সঙ্গীত-সমগ্র। যেমন- ভাটিয়ালি, ঝুমুর,
ভাওয়াইয়া, ইত্যাদিতে ভাষা ও সুরের বিচারে পৃথক সত্তা হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু এর
সামগ্রিক রূপ হলো- বাংলা গান। এর সাথে গভীর সম্পর্ক থাকে ভাষাভিত্তিক জাতির নিজস্ব
সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের। ভাষাভিত্তিক গান হিসেবে বাংলা গানকে শ্রেণিবদ্ধ করতে গেলে, এর পরিচয় হবে—
ভারতীয় গান>উত্তর ভারতীয় গান>বাংলা গান।
এই পরিচয়ের ভিতরে সঙ্গীতের
পরিবেশনগত যে বৈশিষ্ট্যে ভাষাটাই প্রধান হয়ে উঠে। খেয়াল গান বাণী নির্ভর নয়,
তাই খেয়াল গানের বাণীটা মারাঠি না হিন্দি সে নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। এক্ষেত্রে
বাণীটা অবলম্বন হিসেবেই ন্যূনতম উপাদান হিসেবেই কাজ করে। একালের বাঙালি ওস্তাদ
বা পণ্ডিতরা মনে করেন যে, বাংলায় খেয়াল হয় না। এটা তাদের অক্ষমতাকে ভাষার উপর
চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায় মুক্তির ঘোষণা দেন। কাজী নজরুল ইসলাম 'হারামণি'
অনুষ্ঠানে বিলুপ্ত রাগকে উদ্ধার করে, কলকাতা বেতারে প্রচার করেছেন। সে সময়ে
তিনি যে সকল বাংলা গান তৈরি করেছিলেন, সেগুলোতো বটেই, এর বাইরে তাঁর রাগাশ্রয়ী
বহু গানকে খেয়াল গান হিসেবে পরিবেশন করা যায় স্বচ্ছন্দে। ভাগ্গিস
নিধুবাবু, কালী মির্জাদের মতো সঙ্গীতজ্ঞরা বাংলা টপ্পা রচনা করেছিলেন, নইলে হয়তো
শুনতো হতো, বাংলায় টপ্পা হয় না।
ভাষাভিত্তিক অঞ্চল একটি বড় ভৌগোলিক স্থানকে অধিকার করে থাকে। ভৌগোলিক দূরত্বের
কারণে, একই ভাষার ভিতরে আঞ্চলিক ভাষারূপ তৈরি হয়। এর সাথে থাকে স্থানীয়
প্রাকৃতিক পরিবেশ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানদি, অন্যান্য
প্রথা, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সব মিলিয়ে স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয় আঞ্চলিক সঙ্গীত। এর
মুখ্যস্থান জুড়ে থাকে লোকসঙ্গীত। বাকিটা থাকে নগরকেন্দ্রিক গান। উভয়ের প্রভাবে
এই গানগুলো পাল্টায়। নগরকেন্দ্রিক গানে ভাষার প্রমিত রূপ পাওয়া যায়। আঞ্চলিক
গানে পাওয়া যায় ভাষার আঞ্চলিক রূপ। লোক গানের ক্ষেত্রে শব্দের উচ্চারণ এবং লোকজ
শব্দের ব্যবহারকে মান্য করতেই হয়।
সঙ্গীতের মানসিক
বিকাশের ধারা
সঙ্গীত মানুষের সহজাত মানসিক
ক্রিয়াত্মক উপাদান। এমন কোন মানবগোষ্ঠী নেই, যাদের ভাষা এবং গীত-বাদ্য-নৃত্য নেই। মানুষের সহজাত
প্রবৃত্তি প্রকাশের জন্য, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তার কোষস্তরের জিনকোডে আছে। এই
সূত্রে মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ডিভাইস রয়েছে। একে বলা যায়, গীত-বাদ্য-নৃত্যের উপলব্ধি এবং
প্রকাশের ডিভাইস। এই
উপকরণ আছে বলেই মানুষ গীত-বাদ্য-নৃত্য সৃষ্টি করতে পারে এবং এদেরকে ভালোবাসতে পারে।
কণ্ঠসঙ্গীতের বিচারে
সুর-বাণী ও ছন্দের সমন্বয় যে নান্দনিক রূপ ফুটে উঠে তা বিকশিত হয় অনুশীলনের মধ্য
দিয়ে। এই শিক্ষা ভাষার মতোই। শৈশব থেকে প্রতিটি মানব শিশু বড়দের সাহায্যে এক বা
একাধিক ভাষা শিখে নেয়। গানকেও তেমনি শিখতে হয়। ভাষার মতই গীত-বাদ্য-নৃত্য বর্তমান দশায় পৌঁছেছে ক্রমবিবর্তনের ধারায়।
সঙ্গীত মাত্রেই উপস্থাপনযোগ্য এবং তা সময়ের
সাথে বাঁধা। এদের যে কোন বিষয় উপস্থাপিত হয় সময়ের প্রবহমান ধারায়।
বর্তমান নামক ক্ষুদ্র সময়ে মানুষ
সঙ্গীতের একটি ক্ষুদ্র অংশকে উপলব্ধি করতে পারে মাত্র।
এরপর তা হয়ে যায় অতীত। কিন্তু সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া অংশের একটি রেশ রয়ে যায় তাঁর
স্মৃতিতে এবং পরে তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়।
সঙ্গীতের
প্রবহমানতার ভিতর দিয়ে সঞ্চালিত হয়। এদের ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র অংশগুলো একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করে এবং মনোজগতে একটি বিমূর্ত চিত্র তৈরি
করে।
আর সেই বিমূর্ত চিত্রের অসংখ্য আনন্দের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়,
সঙ্গীতের সৌন্দর্য।
এই সৌন্দর্যে যখন কারুণ্য, দ্রোহ, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদি
মানবিক অনুভতি সঞ্চালিত হয়, তখন মনের ভিতরে ভাবের সৃষ্টি হয়। এই ভাবকে সঙ্গীতের
মধ্য প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে সঙ্গীতে রসের প্রকাশ ঘটে।
চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদির মতো কলাগুলোর সাথে
গীত-বাদ্য-নৃত্যের বিশেষ পার্থক্য সৃষ্টি করে- সময়। রঙ-তুলিতে চিত্রশিল্পী যে ছবি আঁকেন, ওই শিল্পী ওই চিত্রকে বার বার
একইভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এবং তা দর্শক উপলব্ধি করতে পারেন এবং দর্শক তা বার বার
একই ভাবে দেখতে পারেন বা অন্যকে দেখাতে পারেন।
গীত-বাদ্য-নৃত্যের
চিত্রটি যন্ত্রে সাহায্যে বার বার উপস্থাপন করা যায় বটে। কিন্তু প্রতিবারেই দর্শক
বা শ্রোতাকে এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করেই উপলব্ধি
করতে হয়। এই শ্রবণ বা দর্শনযোগ্য চিত্রকর্মটি ত্রিমাত্রিক জগতে আমাদের
চৈতন্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সময়ের প্রবহমান ধারায় সঙ্গীত বাঙময় হয়ে উঠে, ফেলে যাওয়া
স্মৃতির লেজ ধরে ধরে। যেন সুর ও ছন্দের বাঁদরগুলো লেজ ধরে ধরে চলেছে। আমরা
বর্তমানের বাঁদরটাকে দেখি, অতীতের বাদরগুলোকে মনে রাখি লেজের সূত্রে। এইভাবেই শ্রোতা-দর্শকের মনে তৈরি
হয়- শ্রবণ ও দর্শনের নান্দনিক শৃঙ্খল এবং শৃঙ্খলা।
মাধ্যমের বিচারে গীত-বাদ্য-নৃত্যের প্রকৃতি:
ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির বিচারে গীত-বাদ্য শ্রবণযোগ্য, আর নৃত্য হলো
শ্রবণ-দর্শনযোগ্য। এই বিচারে গীতবাদ্যেজগতের মূল উপকরণ হলো শব্দমাধ্যম। নৃত্যের
ক্ষেত্রে দেখাটা প্রাধান্য পায় বটে, কিন্তু সুর ও তালযন্ত্রে বাদিত ছন্দ ছাড়া নৃত্য
পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে ব্যর্থ হয়। এই বিচারে নৃত্য হয়ে ওঠে গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমাহার।
মূলত নৃত্যেই ফুটে উঠে সঙ্গীতের আদর্শিক রূপ।
সঙ্গীতের গাঠনিক উপাদানের বিচারে শব্দ-মাধ্যমকে প্রথম স্তরে স্থান দিলে,
অনিবার্যভাবে চলে আসে সময়ের কথাও। শব্দ বিজ্ঞানের শব্দ যা শুধুই শব্দ, সঙ্গীত
জগতের শব্দ হলো-সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। অন্যদিকে চতর্মাত্রিক জগতে সময় প্রবহমান
ঘটনার একটি মাত্রা, আর সঙ্গীতজগতের সময় হলো ছন্দের প্রবহমান ধারা। এ সকল বিচারে
সঙ্গীতজগতের ধ্বনি নান্দনিক শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে যায়। যেমন-
softness)
ও তীব্রতা (loudness)
বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। সর্বোপরি বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হয়,
ধ্বনির মধুর অনুভূতির বিষয়। যে অনুভূতির বিচারে কোনো শব্দকে স্নিগ্ধ,
মধুর, মনোরঞ্জক ইত্যাদি শব্দে অভিহিত করে হয়। সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির এই বিশেষ
গুণকে বলা হয় 'ধ্বনিরঞ্জকতা গুণ'। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে একে বলা হয়
timbre।
শৈলীর বিচারে সঙ্গীত
মূলত শব্দ ছাড়া শুধু নৃত্য ভঙ্গিমা দর্শককে তৃপ্ত করতে পারে। দৃশ্যমান দেহভঙ্গিমা
নৃত্যে একটি মৌলিক উপাদান। নৃত্যের ছন্দকে ধ্বনিহীন দশায় উপস্থাপন করা যায় বটে।
কিন্তু ছন্দের পূর্ণরূপ প্রকাশ পায় তাল যন্ত্রের ধ্বনির সহায়তায়। তাই শেষ পর্যন্ত
নৃত্য শুধু দর্শনযোগ্য হয়ে উঠে না। বর্তমান সময়ে সকল সঙ্গীতই শ্রবণ-দর্শনের সমন্বয়ে
উপভোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
নানান দেশের নানান ধরনের গান শোনা বা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়।
তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এর ব্যাপ্তিটা আরও বেড়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে
মানবগোষ্ঠীর সঙ্গীত চর্চাকে এক সাথে দেখলে, মনে হবে আমরা বিশ্বসঙ্গীতের মেলায়
বসে আছি। এই মেলার কেউ পরিবেশক, কেউ বা দর্শক-শ্রোতা। দর্শক শ্রোতার আসনে আমরা
যারা আছি, তাঁদের অধিকাংশই সঙ্গীতের ব্যাকরণ জানি না। কিন্তু এই বিশ্বসঙ্গীতের
মেলায় আমরাই শক্তি। ক্রেতা না থাকলে যেমন মেলা বরবাদ হয়ে যায়, তেমনি শ্রোতা না
থাকলে সঙ্গীতমেলা সার্থক হয়ে উঠে না।
দর্শক-শ্রোতা সাধারণ, কিন্তু পছন্দের ক্ষেত্রে তাঁরা অসাধারণ ভূমিকা রাখে। এঁরা
সঙ্গীতের ব্যাকরণ জানেন না, কিন্তু মোটা দাগে গানের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে
পারেন। বলতে পারেন এটা রাগসঙ্গীত, এটা ভাওয়াইয়া, এটা বাউল। এই ভাবে কোনো বিশেষ
গানকে বিশেষ শ্রেণির মধ্যে ফেলার প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে সঙ্গীতের শ্রেণিকরণের
কাজ এগিয়ে চলে। শাস্ত্রকাররা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সঙ্গীতের শ্রেণিকরণ করেন
ব্যাকরণের বিধিতে। এই ব্যাকরণও আবার তাঁদেরই তৈরি। সাধারণ শ্রোতা-দর্শক
সঙ্গীতের শ্রেণিকরণ করেন সহজাত বোধ ও অভিজ্ঞতার রসে চুবিয়ে। যেভাবে হোক যখনই
সঙ্গীতের শ্রেণিকরণের কথায় আসা যায়, তখনই প্রথমেই ভাবতে হয় খণ্ড খণ্ড রূপ নিয়ে। প্রতিটি গানের
নিজস্ব রূপ আছে। এরূপ বহু গানের রূপ যখন একটি সাধারণ রূপের জন্ম দেয়, তখন একটি
বিশেষ সঙ্গীতশৈলীরও জন্ম হয়। এই শৈলীর প্রকৃতি অনুসারে সঙ্গীতের যে সকল
শ্রেণি তৈরি হতে পারে বা হয়ে থাকে, তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা হলো।
সঙ্গীতসত্তার বিচার:
আমাদের চেতনায় নানা ধরনের বিষয়
থাকে। প্রতিটি বিষয় কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের দ্বারা আমাদের উপলব্ধিতে আসে। যে কোনো বিষয়ের সকল
বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে সার্বিক পরিচয় পাওয়া যায়, তা ওই বিষয়ের ধর্ম। এর ভিতর
দিয়ে কোনো বিষয় তার আপন অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। সেটাই তার সত্তা-পরিচয়। এই বিচারে
আমাদের চেতনায় যা কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে, তা সবই এক একটি সত্তা
(Entity)।
একই সূত্রে সঙ্গীত একটি সত্তার নাম।
( physical entity)
: এই শ্রেণির সঙ্গীতের একমাত্র সদস্য হলো নৃত্য। আমাদের চারপাশের নানা ধরনের লক্ষ্যবস্তু রয়েছে। এর ভিতরে নৃত্য স্বতন্ত্র গুণাবলি
নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয়। কোনো মঞ্চে যখন নৃত্য পরিবেশিত হয়, তখন তার চারপাশে নানা ধরনের বস্তু থাকে। এর ভিতরে দর্শকের লক্ষ্য করার
অন্যতম বিষয় থাকে নৃত্য।
মঞ্চ সজ্জার জন্য যাবতীয় উপকরণকে ব্যবহার করা হয় নৃত্যকে নান্দনিক দশায় উপস্থাপনের
সহায়ক উপকরণ হিসেবে। তাই এক্ষেত্রে নৃত্যকে বলা যায় প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
সত্তাতত্ত্বে এর সাধারণভাবে
নামকরণ করা হয়েছে লক্ষ্যবস্তু
(object, physical object)
।
(object, physical object):
মানুষের চার পাশের অসংখ্য মূর্তসত্তা আছে। কিন্তু মানুষ সবকিছুর ভিতর থেকে কোনো
বিশেষ বস্তুর দিকে মন দেয়, তখন ওই বস্তু লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত। তাই
উপস্থাপনযোগ্য নৃত্য মাত্রেই লক্ষ্যবস্তু।
সত্তাতত্ত্বের বিচারে চাই থাক, গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপে
প্রকাশ করার মতো- সঙ্গীত ছাড়া ঊর্ধবক্রমবাচক শব্দ নেই। গোলাপ, টগর, শেফালি
ইত্যাদিকে ফুল নামে, কিম্বা মানুষ, গরিলা, বাঘ, সিংহ ইত্যাদিকে স্তন্যপায়ী নামে
ঊর্ধবক্রমবাচক শব্দ দিয়ে আবদ্ধ করতে পারি, তেমনি গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপকে
'সঙ্গীত' নামক ঊর্ধবক্রমবাচক শব্দ দিয়ে বাঁধতে পারি।
মূলত আদিম মানুষের 'সঙ্গীত অর্জনের ডিভাইস' বিকশিত হয়েছিল মস্তিষ্কে। আর এর
ব্যবহারিক উপকরণ হিসেবে মানুষ বাক্যন্ত্র পেয়েছিল ক্রমবিবর্তনের ধারায়। আর উভয়ের
সমন্বয়ে আদিম নৃগোষ্ঠী কণ্ঠস্বরকে সুরেলা ধ্বনিতে প্রকাশ করার কৌশল আয়ত্ব করেছিল।
এই বিচারে মানুষের বাক্যন্ত্র হলো 'জৈবিক রিড', যা বায়ুতাড়িত হয়ে কম্পিত হয়। এই
রিড থেকে যে সকল মূল ধ্বনি ও উপধ্বনির সৃষ্টি হয়, আদিম নৃগোষ্ঠী সেসকল ধ্বনিকে
সমন্বিত করে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিতে পরিণত করেছিল। আর সুরের সাথে বাণীর মেলবন্ধনে
সৃষ্টি হয়েছিল কণ্ঠসঙ্গীত। সঙ্গীতের ধ্বনিগত অধ্যায়ের পাশাপাশি ছন্দবোধের ঘটনা
ঘটেছিল। সঙ্গীতের আদি দশায় দেহকে ছন্দের আধার করে আদিম নৃত্যের উদ্ভব হয়েছিল।
শব্দার্থের বিচারে সঙ্গীতের এই শ্রেণিকরণকে মানা যায় বটে, কিন্তু এর ভিতর দিয়ে সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রকৃতরূপটি প্রকাশ পায় না। মূলত সঙ্গীত হলো একটি মানুষের সুনির্দিষ্ট কার্যকলাপের অংশ।
আর সঙ্গীতশাস্ত্র হলো- একটি সুশৃঙ্খলিত বিষয়। জ্ঞানের বিষয় হিসেবে যদি সঙ্গীতশাস্ত্রকে বিচার করা যায়, তাহলে এর প্রাথমিক চারটি ধাপকে স্বীকার করে নিতে হবে। এই ধাপ চারটি হলো-
সঙ্গীত ও সঙ্গীতশাস্ত্রের এই শ্রেণিকরণের পর, আমরা সঙ্গীতের উপাদানগুলোর প্রকৃতি
নিয়ে পর্যাক্রমে আলোচনা করবো। গীত-বাদ্য-নৃত্যের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী পাঠে আলোচনা
করবো 'ধ্বনি থেকে সঙ্গীত'।
উল্লেখ্য, এই চারটি ধাপ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এই চারটি ধাপ শেষে
সঙ্গীত নান্দনিক দশায় উপস্থাপিত হয়. তখন সঙ্গীত আরও বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনার
দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়। এর পরযায় ক্রমিক ধাপ হলো- অভিজ্ঞা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা,
জ্ঞানক্ষেত্র, জ্ঞানশাখা ও মানবিক শাখা।