এই বিশ্লেষণে সম উপসর্গ একটি অর্থ হলো- সমবেত। এই অর্থানুসারে সঙ্গীত শব্দের অর্থ দাঁড়ায়- সমবেতভাবে কণ্ঠ দ্বারা উপস্থাপিত কলা। আবর সম উপসর্গটি সম্যক (পূর্ণ)। এই সঙ্গীতের অর্থ দাঁড়ায়- যা শুদ্ধ বা পূর্ণ রূপ গীত হয়ে থাকে। রূপতাত্ত্বিকের বিচারে যাই হোক, ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে 'গীত-বাদ্য-নৃত্য। সম্ভবত সঙ্গীতের শুরুর দিকে ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞরা শুধু কণ্ঠসঙ্গীতকেই সঙ্গীত হিসেবে বিবেচনা করতেন। প্রায় একই সময়ে সঙ্গীতের অনুষঙ্গী হিসেবে এর সাথেযুক্ত হয়েছে বাদ্যযন্ত্র। তখন গীত ও বাদ্য নিয়ে সঙ্গীতের মিশ্র রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। আদিম জনগোষ্ঠীর ভিতরে নৃত্যশৈলীর উদ্ভব হয়েছিল। তা অনেক সময় পরিবেশিত হতো নৃত্যের সাথে। কালক্রমে গীত-বাদ্য-নৃত্যের ত্রয়ী চর্চার সমষ্টিগত নাম দাঁড়িয়েছিল- সঙ্গীত। পণ্ডিত অহোবলের রচিত 'সঙ্গীত পারিজাত' গ্রন্থে- সঙ্গীতের সংজ্ঞা হিসেবে যেন এরই সমর্থনে পাই- "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতেতে।সম্- √ গৈ (গীত করা) + ত (ক্ত), কর্মবাচ্য
উভয় অর্থের বিচারে উভয় অর্থেই সঙ্গীত শব্দটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাভাষীরা অনেক সময় সঙ্গীতের পরিবর্তে ' Music' শব্দটি ব্যবহার করেন। এই শব্দের সম্ভবত আদি রূপটি গ্রিস ভাষায় গৃহীত হয়েছিল গ্রিক বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার নয় দেবী Muses থেকে। এই দেবীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন হোমার এবং হেসিয়োড-র সাহিত্যকর্ম থেকে। প্রাচীন গ্রিসে mousiké শব্দটি ব্যবহৃত হতো- Muses নামক নয় দেবীর শিল্পকলা হিসেবে। এই শব্দটি প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় প্রবেশ করেছিল- musica হিসেবে। এই শব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রাচীন ফরাসি ভাষায় - এই শব্দটি গৃহীত হয়েছিল - 'musique' হিসেবে। এই সময় স্প্যানিশ ভাষায় শব্দটির লেখ্যরূপ গৃহীত হয়েছিল- música হিসেবে। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে মধ্যভাগের ভিতরে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এই শব্দটি কৃতঋণ শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল- ফরাসি ও স্পেনিশ ভাষার মাধ্যমে। ইউরোপীয় প্রাচীন ভাষাগুলোতে এই কৃতঋণ শব্দগুলো ছিল- ইতালিয়ান ভাষা musica, জার্মান ভাষায় musik, ডাচ ভাষায় muziek, নরওয়ান ভাষায় musikk, পোলিশ ভাষায় muzyka, রুশ ভাষায় এবং muzïka । খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে- প্রাচীন ইংরেজি তথা এ্যাঙলো-স্যাক্সোন ভাষায় এই শব্দটি গৃহীত হয়েছিল - 'musike' হিসেবে। সপ্তদশ শতাব্দীতে আধুনিক ইংরেজির Music শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং এখনো এই বানানই চলছে।১. যা কণ্ঠে গীত হয়। বাংলাভাষীরা সঙ্গীত বলতে প্রথমে ধরে নেন- কণ্ঠসঙ্গীত। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই আমরা শুনে থাকি- 'এখন সঙ্গীত পরিবেশন করবেন- অমুক শিল্পী'। এরপর 'অমুক শিল্পী' গান পরিবেশন করেন। বর্তমানে প্রচলিত লেখ্য-কথ্য রীতিতে গান অর্থেই সঙ্গীত সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ইত্যাদি বলতে আমার মূলত রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের রচিত গান অর্থে বুঝে থাকি।
২. গীত, বাদ্য নৃত্যের সমন্বিত নামবাচক পদ হিসেবে সঙ্গীত শব্দটি, নিতান্তই সঙ্গীতশাস্ত্রের পারিভাষিক নাম
গীত, বাদ্য, নৃত্য
—
এই তিন-এর সমন্বয়ে গড়ে উঠা সঙ্গীত জগতে মানুষ বিচরণ করে এবং মানসিকভাবে আলোড়িত হয়,
এই কারণে সঙ্গীত বিমূর্ত। সঙ্গীতের উপাদানসমূহের ভর নেই এবং বস্তুজগতে জায়গা দখল
করে না। এই অর্থেও সঙ্গীত বিমূর্ত। যদিও নৃত্যকলায় নৃত্যশিল্পী জায়গা দখল করেন এবং
এদের ভরও আছে, কিন্তু নৃত্যশিল্পীরা নান্দনিক দৃশ্য রচনা করে, মনোজগতে যে স্থানটি
করে নেন, তা ভরহীন এবং তা বস্তুজগতের বাইরে ভিন্নতর বিমূর্ত মনোজগতের।
সঙ্গীতের বিকাশ:
সঙ্গীত মানুষের সহজাত মানসিক
ক্রিয়াত্মক উপাদান। এমন কোন মানবগোষ্ঠী নেই, যাদের ভাষা এবং গান নেই। মানুষের সহজাত
প্রবৃত্তি প্রকাশের জন্য, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তার কোষস্তরের জিনকোডে আছে। এই
সূত্রে মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ডিভাইস রয়েছে। একে বলা যায়, সঙ্গীতের উপলব্ধি এবং
প্রকাশের ডিভাইস। এই
উপকরণ আছে বলেই মানুষ সঙ্গীত সৃষ্টি করতে পারে এবং সঙ্গীতকে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু
সুর ও ছন্দের সমন্বয় সঙ্গীতর যে নান্দনিক রূপ ফুটে উঠে তা বিকশিত হয় অনুশীলনের মধ্য
দিয়ে। এই শিক্ষা ভাষার মতোই। শৈশব থেকে প্রতিটি মানব শিশু বড়দের সাহায্যে এক বা
একাধিক ভাষা শিখে নেয়। সঙ্গীতকেও তেমনি শিখতে হয়। মনুষ্য জাতি আজকের
সঙ্গীতশাস্ত্রে পৌঁছেছে ক্রমবিবর্তনের ধারায়।
মানুষের মস্তিষ্কে 'সঙ্গীত অর্জনের ডিভাইস' থাকার কারণে মানুষ সঙ্গীতকে
গ্রহণ করতে পেরেছিল। মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়া হোমো গণের অন্যান্য প্রজাতি
বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মানুষই সঙ্গীতের উত্তারিকারের দাবিদার হয়ে উঠেছে এবং
মানুষই চর্চার মধ্যদিয়ে আজকের বিশ্বসঙ্গীতের উৎকৃষ্টতর স্তরে আনতে সক্ষম হয়েছে।
আদিম বাঁশির এ সব নমুনা দেখে আমরা
এই সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে- আদিম নৃগোষ্ঠীর ভিতরে সুরবোধ জন্মেছিল আরো আগে।
সম্ভবত সুদূর অতীতে সঙ্গীতের তিনটি ধারাই ধীরে ধীরে বিকশিত
হয়েছিল।
সঙ্গীতের উৎস
সঙ্গীতের বিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষকদের কল্যাণে কয়েকটি
সূত্র পাওয়া যায়। এর ভিতরে প্রথম সুত্র হিসেবে ডারউনের তত্ত্বটি বহুদিন মানুষকে
আচ্ছন্ন করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রকাশিত The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex-গ্রন্থে,
তিনি দাবি করেছিলেন- যৌনমিলনের কারণে সুরেলা আহ্বানের সূত্রে সঙ্গীতের উৎপত্তি
ঘটেছিল। মানবেতর প্রাণী জগতে সহজাত প্রবৃ্ত্তির বশে সুরেলা আহ্বানের বিষয়টি ছিল বটে,
তবে আদিম মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছিল, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি
যৌনমিলনের সময় শীৎকার ধ্বনিও এই তথ্যকে সমর্থন করে না। এরূপ নানবিধ তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে উপস্থাপিত হলেও তা সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্বে
পরিণত হয়ে ওঠে নি।
ভাষা ও সঙ্গীত
মূলত
ভাষা হলো দুই
বা ততোধিক সত্ত্বার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম।
জীবজগতের সকল প্রজাতিই নিজেদের মধ্যে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। প্রজাতিগত
পার্থক্যের সূত্রে প্রতিটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব রূপ। জীবজগতের সদস্য হিসেবে মানুষের
ভাষারও রয়েছে স্বতন্ত্র রূপ। মানুষের ভাষার
জন্য রয়েছে দুটি প্রধান জৈবিক উপকরণ। এর একটি হলো বাক্প্রত্যঙ্গ।
অপরটি হলো বাক্য সংগঠনকারী মস্তিষ্কের সক্রিয় জৈবিক অংশসমূহ। যাকে বলা যায় ভাষা
সংগঠক ডিভাইস। এই দুটি প্রধান উপাদান মানুষের সহজাত। আদিম মানবগোষ্ঠীর ভিতর ভাষার
সাথে সাথে মস্তিষ্কের সুরবোধক অংশেরও বিকাশ ঘটেছিল। এই কারণেই ভাষা ও সঙ্গীতকে
সহোদরা বলা হয়। এই কারণেই এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষা শিখতে পারে এবং ওই ভাষার গানও
শিখতে পারে। এই বিচারে ভাষার ব্যাকরণ এবং এবং সঙ্গীতের ব্যাকরণ সকল মানুষের জন্য
একই। মোটা দাগে আমরা যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সঙ্গীতের পার্থক্য দেখি, তা হলে সময় এবং
আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার সূত্রে সৃষ্টি হয়েছে।
আদি মানুষ কিছু প্রতীকী ধ্বনি দিয়ে
মনের ভাব প্রকাশ করা শিখেছিল। গোড়ার দিকে তারা বাক্য তৈরি করতে শিখে নি। আদিম মানুষ
গুটিকয়েক শব্দ ব্যবহার করতো তার চারপাশের প্রাকৃতিক উপকরণকে প্রকাশ করার জন্য। তারা
শিকারী পশু, পানি, মেঘ, বৃষ্টি ইত্যাদির মতো জীবনঘনিষ্ট শব্দের ব্যবহার করা
শিখেছিল। এই সময় সৃষ্টি হয়েছিল
অন্তর্গামী ধ্বনি
(Ingressive sound),
বহির্গামী ধ্বনি
(Egressive
sound)
শব্দের আদি রূপ।
গোড়া থেকেই অবিচ্ছিন্ন
স্বরধ্বনির প্রাধান্য ছিল। তারা এর সাথে আ, উ জাতীয় শব্দ তৈরি করতো। এরপর বিচ্ছিন্ন
ধ্বনিধর্মী কিছু ব্যঞ্জনধ্বনী যুক্ত হয়ে ধ্বনিবৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছিল।
এর ভিতর দিয়ে শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল।
ভাষা ও সঙ্গীতের দ্বিতীয় ধাপে মানুষ ছোট ছোট বাক্য তৈরির প্রক্রিয়া শিখেছিল। একই
সাথে ভাব প্রকাশের জন্য বাক্যের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল সুর। এই সুর মানুষ ব্যবহার করা
শিখেছিল কণ্ঠস্বরের অবচ্ছিন্ন ধ্বনিপ্রবাহের বর্ধিত
ব্যবহারে। একাধিক শব্দের বিচ্ছিন্ন রূপকে অবচ্ছিন্ন ধারায় বহমান করে তোলে অবচ্ছিন্ন
ধ্বনি। ভাবের প্রকৃতি অনুসারে অবচ্ছিন্ন ধ্বনির-প্রকৃতি পাল্টায়। এর ভিতর দিয়ে জন্ম
নেয় প্রশ্নের সুর, বিস্ময়ের সুর, বেদনার সুর ইত্যাদি। সঙ্গীতের সুর হলো শব্দ ও
বাক্যের সুরের নান্দনিক উপস্থাপন। এই নান্দনিক বোধেই সেকালের মায়েরা শিশুদের শান্ত
করতো, শাসনও করতো। সেকালের মায়েরাও শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য কোমল স্বরে, কোমল সুরে
সম্মোহিত করতো। শিকারী পুরুষ ধনুকের টঙ্কারে সুরের সন্ধান পেয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়েছিল ততযন্ত্র।
ওষ্ঠাধরে গাছের পাতা চেপে ধরে, শ্বাসাঘাতে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির অভিজ্ঞতা লাভ
করেছিল। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল রিড জাতীয় যন্ত্র। আর নল খাগড়ার
মতো খোলা নলে শ্বাসাঘাতে উৎপন্ন সুরেলা ধ্বনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বাঁশি।
আদিম মানুষ কাঠে কাঠে বাড়ি দিয়ে বা হুঙ্কার দিয়ে হিংস্র পশুদের ভয় দেখাতো।
শব্দ সৃষ্টির আরও একটি মাধ্যম তৈরি হয়েছিল পশুর চামড়া দিয়ে আবৃত
আনদ্ধ যন্ত্র। এরই উন্নত সংসকরণ ব্যবহৃত হতো যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাক,
কাড়া-নাকাড়ার মতো গম্ভীর ধ্বনি উৎপদক যন্ত্র।
ঘাতযন্ত্রের মাধ্যমে ছন্দের দোলা অনুভব করেছিল তারা। আদিম দেখেছিল বায়ু প্রবাহে ঘাসের
ভরা মাঠে জেগে ওঠা দোলা,
কিম্বা বৃক্ষশাখা আন্দোলন, জলাশয়ে
জলতরঙ্গমালা। সে দোলা লেগেছিল
মানুষের মনে। সে দোলা থেকে উদ্ভব হয়েছিল ছন্দের আরও পরে ছন্দ থেকে উদ্ভব হয়েছিল
তালের। ছন্দের দোলা লেগেছিল আদিম মানুষের আদি ভাষায় এবং আদিম
গানে। তারা সুরের ছন্দকে শ্রবণযোগ্য করে তুলেছিল করাঘাতে কিম্বা কঠিন
বস্তুতে আঘাত করে। যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুক্ত
হয়েছিল নানাবিধ আনদ্ধ যন্ত্র।
আদিম মানুষ মনের ভাবকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শব্দের দুঃষ্প্রাপ্যতার অভাব
পূরণ করতো হাতের নানারকম ভঙ্গী দিয়ে। আধুনিক মানুষও সেই রীতিতেই ধ্বনি এবং
হস্তভঙ্গী মিশিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে।
ধ
ধ্বনির ছন্দে
দেহে ছন্দ জাগবে, এটিও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ।
এই প্রবৃত্তির
সূত্রে মানুষের আদিম নৃত্যের সূচনা
ঘটেছিল।
।
মানুষ প্রথম বাদ্য যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শিখেছিল তার নিজের বাক্যন্ত্রকে।
বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণিকরণে একে বলা যায় শুষির যন্ত্র
(wind instrument)
।
মানুষ তার শারীর যন্ত্রের বাইরে সুর সৃষ্টি করেছিল পাতার বাঁশি,
নলখাগড়া বা এই জাতীয় নলাকার বস্তুর ব্যবহারে। আদিম কালের সে সকল উপকরণ কালের গর্ভে
হারিয়ে গিয়েছে। অবশ্য হাড়ের তৈরি কিছু দু চারটি বাঁশির নমুনা পাওয়া যায়।
গাছের পাতায় ঠোঁটে চেপে বাতাসের প্রবাহে সুরেলা ধ্বনি তৈরি করা যায়। গ্রামে অনেক
শিশুদের কাছে এটা খেলার সামগ্রী। এই খেলা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল পাতার বাঁশি।
প্রাগৈতিহাসিক হোমো গণের কিছু কিছু প্রজাতি পশুর হাড় ব্যবহার করতো নানা কারণে। এর
ভিতরে নরমবস্তি থ্যাঁৎলানোর জন্য, শিকারের জন্য এরা শক্ত এবং বড় বড় হাড় ব্যবহার
করতো। ছোটো ছোটো হাড় পাথরে ঘষে ধারালো করতো এবং তা বর্শার মাথায় ব্যবহার করতো।
সেটাও ছিল শিকারের জন্য। এরা লক্ষ্য করেছিল বড় বড় হাড়ের ভিতরে থাকে ফাঁপা অংশ। হয়তো
খেলাচ্ছলেই এই হাড়ের ভিতর ফুঁ দিয়ে সুরেলা ধ্বনির সন্ধান পেয়েছিল। পরে এর গায়ে ফুটো
তৈরি করে সুরের বৈচিত্র্য এনেছিল এরা।
মানুষের মস্তিষ্কে 'সঙ্গীত অর্জনের ডিভাইস' থাকার কারণে মানুষ সঙ্গীতকে গ্রহণ করতে পেরেছিল। মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়া হোমো গণের অন্যান্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মানুষই সঙ্গীতের উত্তারিকারের দাবিদার হয়ে উঠেছে এবং মানুষই চর্চার মধ্যদিয়ে আজকের বিশ্বসঙ্গীতের উৎকৃষ্টতর স্তরে আনতে সক্ষম হয়েছে। আদিম বাঁশির এ সব নমুনা দেখে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে- আদিম নৃগোষ্ঠীর ভিতরে সুরবোধ জন্মেছিল আরো আগে। সম্ভবত সুদূর অতীতে সঙ্গীতের তিনটি ধারাই ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এই তিনটি ধারার ক্রমবিমূর্তন বর্ণনা করা মতো যথেষ্ঠ নমুনা আমাদের কাছে নেই।
সঙ্গীত মাত্রেই উপস্থাপনযোগ্য এবং তা সময়ের
সাথে বাঁধা। সঙ্গীতের যে কোন বিষয় উপস্থাপিত হয় সময়ের প্রবহমান ধারায়।
বর্তমান নামক ক্ষুদ্র সময়ে মানুষ সঙ্গীতের একটি ক্ষুদ্র অংশকে উপলব্ধি করতে পারে।
এরপর তা হয়ে যায় অতীত। কিন্তু সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া অংশের একটি রেশ রয়ে যায় তাঁর
স্মৃতিতে এবং পরে তা স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। সঙ্গীতের প্রবহমান ধারায় এই ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র অংশগুলো একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করে, মনে জগতে একটি বিমূর্ত চিত্র রচিত হয়।
আর সেই বিমূর্ত চিত্রের অসংখ্য আনন্দের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়, সঙ্গীতের সৌন্দর্য।
চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য ইত্যাদির মতো কলাগুলোর সাথে সঙ্গীতের বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি
করে সময়। রঙ-তুলিতে চিত্রশিল্পী যে ছবি আঁকেন, ওই শিল্পী ওই চিত্রকে বার বার
একইভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এবং তা দর্শক উপলব্ধি করতে পারেন এবং দর্শক তা বার বার
একই ভাবে দেখতে পারেন বা অন্যকে দেখাতে পারেন। সঙ্গীত-চিত্রটি যন্ত্রে সাহায্যে বার
বার উপস্থাপন করা যায় বটে। কিন্তু
প্রতিবারেই দর্শক বা শ্রোতাকে এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে একটি ক্রমিক ধারা অনুসরণ করেই
উপলব্ধি করতে হয়। এই চিত্রকর্মটি ত্রিমাত্রিক জগতে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে অভিজ্ঞ করে
তোলে। পক্ষান্তরে সময়ের প্রবহমান ধারায় সঙ্গীত
বাঙময় হয়ে উঠে, ফেলে যাওয়া স্মৃতির লেজ ধরে ধরে। যেন সুরের বাঁদরগুলো লেজ ধরে ধরে
চলেছে। আমরা বর্তমানের বাঁদরটাকে দেখি, অতীতের বাদরগুলোকে মনে রাখি লেজের সূত্রে। এইভাবেই
তৈরি হয়, শ্রোতার মনে শ্রবণের নান্দনিক শৃঙ্খল এবং শৃঙ্খলা।
গীতের প্রধান মাধ্যম কণ্ঠস্বর। এর বাণী মূলত গীত-বাদ্য ও
নৃত্যের মধ্যে কণ্ঠসঙ্গীতই প্রধান। বাণী, সুর ও ছন্দের মিলনে গীত হয়ে ওঠে পূর্ণ ও
মহিমান্বিত। এই পূর্ণতার দাবীতে গীত শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠে সঙ্গীত।
সঙ্গীতের শ্রেণিবিভাজন
পৃথিবীর নানা প্রান্তে চর্চিত সঙ্গীতের ধারা- সুর, বাণী,
বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য আঙ্গিকে বিকশিত হয়েছিল। সঙ্গীতের গীত অংশের বাণী বিভাজিত হয়েছিল
স্থানীয়ভাবে বিকশিত ধর্মাদর্শন, প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য, যাপিত-জীবনের লৌকিক
সংস্কারের সূত্রে। অঞ্চলভেদের আদিম বাঁশি বা রিড জাতীয় যন্ত্র, তালযন্ত্র,
ততযন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল। স্বাভাবিক সাংসারিক লোকজীবনে এসকল বাদ্যযন্ত্রের অধিকাংশই
গানের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে বাঁশির একক বাদনের প্রচলন ছিল। এছাড়া
যুদ্ধবিগ্রহে চামড়া আচ্ছাদিত গম্ভীর শব্দ-উৎপাদক ঢাক জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
ছিল। আদিম লোকনৃ্ত্যের বিকাশ ঘটেছিল ধর্মোৎসবে, লৌকিক জীবনযাত্রা আনন্দ উৎযাপনের
সূত্র। এদের আনন্দোৎসবের উপলক্ষ ছিল, নবান্ন, শিশুর অন্নপ্রাসন, বিবাহ ইত্যাদিতে।
প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন এবং খাদ্যসঙ্কটের সূত্রে মানুষ যখন
দলবদ্ধভাবে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল, তখন কাছাকাছি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সাম্য ছিল।
কিন্তু বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিতরে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সূচনা হয়েছিল।
ক্রমান্বয়ে কোনো নৃগোষ্ঠী যখন মূল নৃগোষ্ঠী থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, তখন
সাংস্কৃতিক সত্তার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছিল। এই পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল-
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই সূত্রে আঞ্চলিক ভাষা ও সঙ্গীতের
ধারাই বিচ্ছন্ন স্বত্ন্ত্র ধারায় পরিণত হয়েছিল। মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির
প্রাগৈতিহাসিক স্তর পেরিয়ে যখন প্রাচীন ঐতিহাসিক স্তরে প্রবেশ করেছিল, ভাষা ও
সঙ্গীত ভূখণ্ড-ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য রূপ লাভ করেছিল এবং যাকে আমরা বড় ধরনের
সাংস্কৃতিক একক হিসেবে অভিহিত করে থাকি। যেমন- প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি, প্রাচীন
ভারতীয় সংস্কৃতি, প্রাচীন আফ্রিকান সংস্কৃতি ইত্যাদি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে
ওঠা সংস্কৃতির বিকাশের সূত্রে গড়ে উঠছে অঞ্চলভিত্তিক ভাষা, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম
ইত্যাদি। সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরণে সঙ্গীতের স্বরূপ উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে-
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সভ্যতার নাম অনিবার্যভাবে চলে আসে। যেমন- গ্রিক/রোম, চিন,
পারশ্য, ভারতবর্ষ, মায়া, মিশর ইত্যাদি। সঙ্গীতের ক্রমবিকাশের ধারায় আঞ্চলিকাতার
বিচারে নানাভাগে ভাগ করে থাকি।
মানুষের পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিভিন্ন অঞ্চলে সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল নানা
ভাবে। আঞ্চলিক পরিবেশ এবং আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির সূত্রের সঙ্গীতের প্রখৃতি ভিন্ন
ভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। এই বিচারে সঙ্গীতের ক্রমবিকাশের ধারা হয়ে পড়ে- আঞ্চলিক
সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তিত ইতিহাস। বড় ভৌগোলিক অঞ্চলের বিচারে সাধারণভাবে কয়েকটি ভাগে
ভাগ করা যায়। আবার বিষয়াঙ্গ সুরাঙ্গের বিচারে সঙ্গীতকে নানাভাগে ভাগ করা যায়।
][বিস্তারিত সঙ্গীতের শ্রেণি-বিভাজন