সঙ্গীতের ইতিহাস

জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- হোমো গণের উন্নততম প্রজাতি হিসেবে স্যাপিয়েন্সের তথা মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ
(Jebel Irhoud ) অঞ্চলে। মানুষের আবির্ভাবের পুরো সময়টকুকেই 'প্রাক্-মানব অধ্যায়' হিসেব গ্রহণ করা উচিৎ হলেও- কিন্তু সঙ্গীতের ইতিহাসের বিচারে সুপ্রাচীন 'প্রাক্-মানব অধ্যায়' গ্রহণ করাটা সঙ্গত হবে না। মূলত সৃজনশীল ক্ষমতার মধ্য দিয়ে মানুষ অন্য সকল প্রজাতির মধ্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জীবজগতের এই ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃজনশীল প্রজাতির আবির্ভাবের সূচনার মধ্য দিয়ে জীবজগতে মনুষ্যের আবির্ভাবের ক্ষেত্রটি উন্মোচিত হয়েছিল। এই ক্ষমতার সূত্রে মানুষ অর্জন করেছিল সঙ্গীত নামক একটি অনন্য সৃজশীল বিদ্যা। মূলত মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতাটি অর্জিত হয়েছিল- মানুষের পূর্ববর্তী মানবেতর প্রজাতির মধ্য দিয়ে। মানুষের ক্রমবির্তনের ধারায় সৃজনশীল প্রজাতি হিসেবে প্রথম কোনো বিশেষ প্রজাতিকে চিহ্নিত করাটা যথাযথ তথ্য প্রমাণাদির অভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়।
 
সঙ্গীতের প্রতি হোমো গণের আদিম প্রজাতির ভিতরে কখন আগ্রহ জন্মেছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। সুমিষ্ট ধ্বনি যে বিশেষভাবে মোহিত করে, তারই চর্চার ভিতর দিয়ে সুরের উদ্ভব হয়েছিল। একই সাথে ছন্দ ও নৃত্যের বিকাশ ঘটেছিল ধীরে ধীরে। সুরের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং চর্চার ভিতর দিয়ে এদের মাধ্যমে পাতার তৈরি রিড জাতীয় বাদ্যকৌশল। একই সাথে উদ্ভব হয়েছিল নলাকার নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়েছিল নলাকার বাশি। এদের কেউ কেউ উদ্ভিজ নলাকার বস্তুর পরিবর্তে অস্থি থেকে বাঁশি তৈরি করেছিল। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি উল্লেখ্য, ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্লোভেনিয়ার ডিভ্‌জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের একটি অনুভূমিক গুহা থেকে এদের তৈরি একটি বাঁশির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বাঁশি ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি নামেই প্রচলিত। উল্লেখ্য, প্রায় ৪৩,০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল।  প্রাপ্ত বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে। এই বাঁশিকে যদি সেকালের একটি আদর্শ নমুনা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে একথা মানতেই হবে যে, নিয়ানডার্থলদের মধ্যে সুর ও সুরেলা বাঁশির চর্চা শুরু হয়েছিল লক্ষ বা হাজার বছর আগে। ধারণা করা যায় নিয়ানডার্থলদের আবির্ভাবের সূচনালগ্নই সঙ্গীত বিকশিত হতে থাকে। মোটা দাগে বলা যায় আনুমানিক ৩ লক্ষ থেকে ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সঙ্গীতের প্রাথমিক বিকাশ শুরু হয়েছিল। ৪৩,১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এই বাঁশিটি ছিল এদের একটি আদর্শিক নমুনা মাত্র।

মানুষের সঙ্গীত সাধনার প্রাথমিক পর্ব (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫,০০০ অব্দ)
আফ্রিকার শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য ছেড়ে, ভাগ্যান্বেষে  প্রায় ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ইউরোপে আধুনিক মানুষ প্রবেশ করেছিল।আদিম মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির সূত্রে এবং এদের পূর্ববর্তী নিয়ানডার্থলদের অনুসরণে সঙ্গীত ক্রমবিকাশের ধারায় চলমান ছিল। আফ্রিকার আদিম নরগোষ্ঠীদের কোন সঙ্গীতযন্ত্রের নমুনা না পাওয়া গেলেও সঙ্গীতচর্চা এদের ভিতরে ছিল, এমটা অনুমান করাই যায়। এই সময়ের ভিতরে সঙ্গীতোপযোগী কোনো যন্ত্রের নমুনা পাওয়া না গেলেও চিত্রকর্মের নমুনা পাওয়া গেছে বিভিন্ন পর্বতগুহায়। এদের হাতে তৈরি হয়েছিল প্রাচীনতম শিল্পকর্ম। এরা পাহড়ের গুহা বাস করতো। আর সেই গুহাকে অলঙ্কৃত করতো চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে।  

মূলত ইউরোপে আগত ক্রো-ম্যাগনান তথা আদিম মানুষের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এরা ইউরোপের উল্লেখযোগ্য সকল নিয়ানডার্থালদের গুহাই এরা দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময়ের ভিতরে ভিতরে এরা ইউরোপে অন্যতম জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এরা ইউরোপের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ (জিব্রাল্টার) থেকে রাশিয়ার উরাল অঞ্চল পর্যন্ত নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে প্রায়য় ৩৫০টি চিত্রকর্ম-গুহা। এর ভিতরে প্রায় অর্ধেক নমুনা পাওয়া গেছে উত্তর স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে। সামগ্রিকভাবে ইউরোপে আগত ক্রো-ম্যাগনানদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল চারটি পর্যায়ে। এই পর্যায় চারটি হলো-

  • অরিগ্ন্যাসিয়ান সভ্যতা: ব্যাপ্তীকাল ৪৩ থেকে ২৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই সময়ের ভিতরে ইউরোপের বিভিন্ন গুহায় পাওয়া পাওয়া গেছে- মূর্তি এবং সঙ্গীতযন্ত্র হিসেবে বাঁশি। ক্রো-ম্যাগনান সভ্যতার বিকাশকালের আদিম পর্যায়ে মানুযের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল চিত্রকর্ম এবং মৌখিক ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে এর চিত্রকর্মের নমুনা পাওয়া গেলেও- মৌখিক ভাষার নমুনা পাওয়া যায় না। সে সময়ে নির্মিত মাতৃমূর্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- ভাষ্কর্য তৈরিতে এরা পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি বিকাশলাভ করেছিল চিত্রকর্ম। এই সময়ে প্রাপ্ত বাঁশি এবং নৃত্যশীলা মূর্তি। এগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য নমুনাগুলো হলো-
    • গেইসেঙ্ক্‌লোস্টের্ বাঁশি: জারমানির  গেইসেঙ্ক্‌লোস্টের্লে (Geissenklösterle) গুহায় পাওয়া গিয়েছিল হাতির দাঁতের তৈরি বাঁশি। এই বাঁশিটির বয়স ধরা হয়েছে- আনুমানিক ৪৩ থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
    • হোহলে ফেল্স বাঁশি:  খ্রিষ্টপূর্ব ৪০ থেকে ৩৫ হাজর অব্দের ভিতরে  গ্রিফোন শকুনের ডানার হাড় থেকে এই বাঁশিটি তৈরি করা হয়েছিল।
    • গালগেনবার্গের ভেনাস: এটি একটি নৃত্যশীলা নারীমূর্তি। সর্পমণির দ্বারানির্মিত এই মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে।
  • গ্রাভিটিয়ান সভ্যতা: ব্যাপ্তীকাল ২৫ থেকে ২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই সময়ে সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত কোনো উপকরণ পাওয়া যায় নি। তবে প্রচুর ভাস্কর্য ও গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। এদের ভিতর মাতৃদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এই বিচারে বলা যায়- সমগ্র ইউরোপ জুড়ে প্রধান আরাধ্য দেবী ছিল মাতৃদেবতা।
  • সোলুট্রিয়ান সভ্যতা: ব্যাপ্তীকাল ২০ থেকে ১৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই সময়ের মানুষ চকমকি পাথর দিয়ে উন্নতর অস্ত্র তৈরি করার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। ধারালো ও শক্ত অস্ত্রের আঘাতে এরা অতিকায় এবং প্রাণী হিংস্র প্রাণী শিকার করতে পারতো। এদের গুহায় পাওয়া গেছে বিশালাকার হাতির অস্থি। এ ছাড়া এদের শিকারের তালিকায় ছিল গণ্ডার, সিংহ, ভল্লুক, ঘোড়া ইত্যাদি। সম্ভবত বন্যপশুদের পোষ মানানো শুরু হয়েছিল এই সময় থেকে। এই সময়ের সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি।
  • ম্যাডালেনিয়ান সভ্যতা : ব্যাপ্তীকাল ১৫ থেকে ৮ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ১৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সোলুট্রিয়ান সভ্যতা শেষে এই সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে অঞ্চলের লা ম্যাগডালেলেনিয়ান প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ প্রাপ্তির সূত্রে এই সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে। এই সভ্যতার শুরুর দিকে ফ্রান্সের 'ট্রোইস ফ্রেরেস' গুহায় বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর ভিতরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল বলেই অনুমান করা হয়। এই গুহায় পাওয়া গেছে ধনুকাকার ততযন্ত্র (bow instrument) নামে অভিহিত করা হয়েছে।

ধনুকাকার ততযন্ত্রর বাদ্য যন্ত্রে মূল কাঠামো হয়ে থাকে ধনুকের মতো বাঁকানো। আদি ধনুকাকার বাদ্যযন্ত্রে ধাতব তারের পরিবর্তে, প্রাণীর অন্ত্র ব্যবহৃত হতো।

এই জাতীয় বাদ্যযন্ত্র এখনো আফ্রিকায় ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে আফ্রিকা নাইজেরিয়া ওবু জনগোষ্ঠীর শিল্পীরা ধনুকাকার ততযন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। এই যন্ত্রের কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা কাঠের তৈরি বাঁকা দণ্ড এবং ক্রিয়াত্মক অংশ ব্যবহার করা হয় একটি ধাতব তার। এই জাতীয় যন্ত্রে সর্বপ্রাচীন নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়- ফ্রান্সের 'ট্রোইস ফ্রেরেস' গুহায় খোদিত চিত্রকর্মটিকে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৩,০০০ অব্দের দিকে এই চিত্রকর্মটি অঙ্কিত হয়েছিল।

সাইবেরিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার ভিতর দিয়ে মূল চীন ভূখণ্ডে মানুষ প্রবেশ করেছিলম আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫ হাজার অব্দের দিকে।  ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে চীনের হেনান প্রদেশের উয়ান কাউন্টির জিয়াহুতে নিওলিথিক জিয়াহুতে খনন করা সময় পাওয়া যায়- খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দের একটি বাঁশি । প্রাচীন চীনা বাদ্যযন্ত্রে নমুনা পাওয়া গেছে প্রায় ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে।

চিনের জিয়াহু গুডি বাঁশি

এই বাঁশিটি জিয়াহু গুডি নামে পরিচিত। লালমুকুট ক্রেনের লম্বা ঠ্যাং দিয়ে এই বাঁশিটি তৈরি করা হয়েছিল।এর পরিপাম ২০সেমি × ১.১ সেমি (৭.৯ ইঞ্চি × ০.৪ ইঞ্চি)। এই বাঁশির গায়ে ুটোর সংখ্যা এক থেকে আট পর্যন্ত হতো। চার চিত্র যুক্ত বাঙশিতে উপরের দিকে ৩টি ফুটো এবং নিচের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলের জন্য ১টি ফুটো থাকতো।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ অব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া উর নগররাষ্ট্রের রাজকীয় কবরস্থানে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির ভিতরে ছিল বহু বাদ্যযন্ত্র। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য বাদ্য যন্ত্র ছিল বীণা। এই যন্ত্রগুলির বেশিরভাগই কাঠের তবে তাতে রূপালী আস্তরণ যুক্ত করা হয়েছিল। নীল এবং সাদা মোজাইকযুক্ত বীণার সাউন্ড বক্স তৈরি করা হয়েছিল। এতে যুক্ত ছিল রূপার ঢালাইকৃত গরুর মাথা এবং রূপার তৈরি বাদন দণ্ড। আরেকটি বীণার আকার ছিল সমুদ্রগামী জাহাজের মতো ।

রানি পুয়বির বীণা

রানি পুয়বির বাঁশি

১৪০০ অব্দের দিকে প্রাচীন আমোরিটে প্রাপ্ত লিপি

খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে প্রাচীন আমোরিটে বর্তমান সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন নগরীতে যে সকল ফলক পাওয়া গেছে, তাতে কীলকলিপিতে লেখা গান লিপিবদ্ধ ছিল। একে সাধারণভাবে বলা হয় হুররিয়ান সঙ্গীত। এটি ছিল মূলত নিক্কাল দেবীর প্রশস্তিমূলক গানের স্বরলিপি।

 [কাজ চলছে]