মেসোপটেমিয়া
গ্রিক: Μεσοποταμία (দুটি নদীর মধ্যবর্তী ভূমি) 
আরবি:  بلاد الرافدين‎

গ্রিক মেসো শব্দের অর্থ হলো- মধ্যবর্তী এবং পটেমিয়া শব্দের অর্থ নদী। সাধারণ অর্থে মেসোপটেমিয়া বলতে- বুঝায় বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস (দজলা)ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা প্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিরিয়ার উত্তরাংশ, তুরস্কের উত্তরাংশ এবং ইরানের খুযেস্তান প্রদেশের অঞ্চল জুড়ে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই বিস্তৃত অঞ্চলের কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে বর্তমান ইরাককে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এর প্রাচীন সীমানা ছিল- উত্তর পশ্চিম জাগ্রোস পর্বতমালা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে আরব উপত্যাকা পেরিয়ে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত।

উল্লেখ্য তুরস্কের আনাতোলিয়ার হাজার হ্রদ থেকে
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে সিরিয়া অতিক্রম ইরাকে প্রবেশ করেছে। পরে এই দুই নদীর মিলিত স্রোত শাতিল আরব নাম গ্রহণ করে পারশ্য উপসাগরে পতিত হয়েছে। এই অঞ্চলটি উত্তরে প্রলম্বিত হয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নেমে গিয়ে প্রায় ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হয়। বাঁক বিশিষ্ট এই অঞ্চলটিকে "উর্বরা অর্ধচন্দ্রাকৃতিক ভূমি" হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস
আফ্রিকা থেকে উদ্ভুত মানবগোষ্ঠীর এশিয়া এবং ইউরোপগামী সকল দলই এই অঞ্চল হয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলে খ্রিষ্টাপূর্ব ৪,৫০,০০০ বৎসর আগে, হোমো ইরেক্টাস-দের সাথে নব্য হোমোগণের প্রজাতিগুলো এই অঞ্চলে মিশ্র সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই সভ্যতাকে নিম্ন পাথুরে সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। মধ্য পাথুরে যুগে
হোমো হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস -রা এই অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল পুরোপুরি। উত্তর ইরাকের শানিদার গুহায় এই প্রজাতির একটি খুলির জীবাশ্ম পাওয়া যায়। এর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন রালফ সোলেকি (Ralph Solecki)। প্রাপ্তিস্থানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে- Shanidar 1। এই বিচারে বলা যায় প্রাচীন ইরাক তথা মেসোপটেমিয়ায় নিয়ানডার্থালেনসিস-মানবগোষ্ঠী বসতি স্থাপন করেছিল। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫,০০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫,০০০ অব্দের ভিতরে এরা মেসোপটেমিয়ায় বসবাস করতো।

নিয়ানডার্থাল-মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপনের  মধ্য দিয়ে প্রাক্-প্রস্তরযুগের সূচনা হয়েছিল। এরা পাথুরে অস্ত্র ব্যবহার করতো। এই সূত্রে এরা শিকারে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে তারা কুঠার, বর্শা ব্যবহার করতো। বর্শাফলকের সাথে তারা কাঠের দণ্ড ব্যবহার করার কৌশল আয়ত্ব করেছিল। এদের অস্ত্রের গঠন দেখে ধারণা করা হয়েছে যে, এরা ম্যামথ (বিলুপ্ত হাতীজাতীয় প্রাণী) বড় বড় প্রাণী হত্যা করতে পারতো। পরবর্তী সময়ে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে সংঘাতের ফলে, এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

প্রাক্-মেসোপটেমিয়া সভ্যতা
টায়ুরুস এবং জার্গস পারবত্য অঞ্চল এবং ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীয়ের উজানে সৃষ্ট উপত্যাকায় মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিল। এরা প্রধান খাদ্য উৎস ছিল পশুর মাংস। তবে উদ্ভিজ খাবারেও অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে জানা যায় জানা যায় যে, ১২,৫০০ থেকে ৯,৫০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে একদল শিকারী মানবগোষ্ঠী বসবাস শুরু করেছিল। সাধারণভাবে এই অঞ্চলকে বলা হয় লেভান্ট
(Levant)। এই সময়ের প্যালেস্টাইন অঞ্চলের মানবগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে নাটুফিয়ান সভ্যতা মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময় পৃথিবীর শেষ বরফযুগের অন্তিম দশায় ছিল। এর দক্ষিণে ছিল জুদাহ সাম্রাজ্য, মোয়াব সাম্রাজ্য এবং মৃত সাগর, পূর্বে ছিল আম্মান সাম্রাজ্য।  ৯৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বরফযুগ শেষ হয়ে গেলে সেকালের প্যালেস্ট্যান অঞ্চল বেশ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল।  ৯০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে  জেরিকো অঞ্চলে কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছিল। এর ভিতর দিয়ে জেরিকা সভ্যতা শুরু হয়েছিল।

প্যালেষ্টাইন এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত ছোট ছোট মানব গোষ্ঠী বর্তমান ইরাকের ইউফ্রেটিস (ফোরাত) টাইগ্রিস (দজলা) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রাক্-মেসোপটেমিয়াম সভ্যতা। এই সভ্যতায় গড়ে উঠেছিল পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। এগুলো হলো-

মূলত উবাইদ (Ubaid) সভ্যতার পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০-৩১০০ অব্দের মধ্যে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের সভ্যতাকে সাধারণভাবে বলা হয়- সুমেরিয়ান সভ্যতা এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল উরুক-নগর রাষ্ট্যের সূত্রে।

উত্তর মেসেপোটেমিয়ায় বিকশিত সভ্যতা :
উত্তর মেসোপটেমিয়ার স্বাধীন রাজত্ব কাল ছিল ৫৩০০ থেকে ৪৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।

দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা
সামার্‌রা (Samarra): এই সভ্যতার সময় ধরা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০০ থেকে ৪৮০০ অব্দ পর্যন্ত। মূলত এই সভ্যতা হাস্সুনা সভ্যতার সাথে মিশে গিয়েছিল। এই কারণে একে অনেক সময় একে সামারা-হাস্সুনা সভ্যতা বলা হয়। ধারণা করা হয় এই সভ্যতার শেষের দিকে সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা সংসগঠিত হয়েছিল। এরা মাটির পাত্র, পাথুরে মূর্তি ও অন্যান্য গৃহস্থালি ও কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। এই সভ্যতার স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় উত্তর মেসেপোটেমিয়াকে। এই সভ্যতার উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্তিক এলাকা- তেল শেমশারা, তেল এসসাওয়ান।
মেসোপটেমিয়ার ধর্ম
মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়, আক্কাদীয় এবং ব্যাবিলনীয় শাসনামলে ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মমত। সময়ের সাথে সাথে এই ধর্মমতের নানা দেব-দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো কোনো দেবদেবী ভাষা পরিবর্তনের সাথে সাথে নামের পরিবর্তন হয়েছে। মেসোপটেমিয়ার ধর্মতত্ত্বগুলোর উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় মাটির ফলকে লিখিত পাঠ্যসমূহ। এই পাঠ্যগুলো ছিল-
  • আডাপার পুরাণকথা
  • গিলগামেশ মহাকাব্য
  • এনুমা এলিস পুরাণকথা
মেসোপটমিয়ার দেবদেবী

মেসোপটেমিয়ার সঙ্গীত
মেসোপটেমিয়ার সঙ্গীতের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়াদি। শিল্পকর্ম এবং লিখিত নমুনা অনুসারে এই অঞ্চলের সঙ্গীত সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই সময় গায়কবৃন্দ সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনা সঙ্গীত পরিবেশন করতো।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম সহস্রাব্দের একটি হাড়ের তৈরি ততযন্ত্র আবিষ্কারের পর, মেসোপটেমিয়ায় সঙ্গীত সংস্কৃতির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশেষ ধারণা লাভ করা যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মাটির ফলকে লিখিত পাঠ্য থেকে জানা যায়, লাগাশ নগরীর নিঙ্গারাসু মন্দিরে সমবরত সঙ্গীত পরিবেশিত হতো। তাতে ধারণা করা যায়, এই সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য সঙ্গীতশিক্ষক এবং সঙ্গীত-পরিচালক পদে সঙ্গীতজ্ঞরা এই গানের সাথে থাকতেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে নগর-বিলাপ সঙ্গীতের প্রচলন হয়েছিল। উল্লেখ্য হারিয়ে যাওয়া, পরিত্যক্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের জন্য রচিত হতো এই গান। এর কাহিনি রচিত হতো এই সকল নগরের পুরোহিতদের ভাষায়।

মেসোপটেমিয়ার ধর্মীয় সঙ্গীতের বিশেষ প্রভাব ছিল। উদাহারণস্বরূপ বালা যায়  নিনিগিজিবারা। সেকালের মেসোপটেমিয়ায় নিনিগিজিবারা ছিল মূলত দেবী।

প্রাচীন ব্যবিলনীয় যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৯৪-১৫৯৫ অব্দ) গালা যাজকরা (সুমেরীয় দেবী ইনানার পুরোহিত) সুমেরীয় উপভাষা হিসেবে পরিচিত এমেসাল ভাষায় গান গাইতেন। এই ভাষার গানের বালাগ এবং এরশেমা নামক দুটি প্রকারণ ছিল।

  • বালাগ: এটি ছিল মূলত সাহিত্য ও সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা। প্রতিটি বালাগ একটি সুনির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হতো।।
  • সুমেরীয় সভ্যতায় ইনান্না দেবীর পুরোহিতদের বলা হতো গালা। এরা সঙ্গীতে পারদর্শী ছিল। ব্যবিলিনের পাঠ্য থেকে জানা যায়, ইনান্নাকে গান শোনানোর জন্যই এনকি গালাদের তৈরি করেছিলেন। এই গানকে বলা হয় নগর-বিলাপ সঙ্গীতের উত্তরসূরী

    অনেক সময় ধর্মীয় উৎসবে সঙ্গীতশিল্পীদের সাথে নর্তকীরা নৃত্য পরিবেশন করতো।
     
    খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৫০ অব্দে মারি'র ইনান্না দেবীর মন্দিরে প্রাপ্ত দুইজন গালা

    ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে সামাজিক অনুষ্ঠানে, যুদ্ধ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মেসোপটেমীয়রা শিল্পীরা গান গাইত। এসব গানের সাথে ব্যবহৃত হতো নানা ধরনের তালযন্ত্র, তারযন্ত্র, বাঁশী ইত্যাদি। এর উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলির মধ্যে রয়েছে উর নগরীর প্রাচীনতম বীণা।

    খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে মাটির ফলকে প্রাপ্ত হুরিয়ান সঙ্গীতের স্বরলিপি। এই স্বরলিপি লেখা হয়েছিল- কীলক লিপিতে।


সূত্র:

https://en-m-wikipedia-org.translate.goog/wiki/Music_of_Mesopotamia?_x_tr_sl=en&_x_tr_tl=bn&_x_tr_hl=bn&_x_tr_pto=tc

 

https://en.wikipedia.org/wiki/Music_of_Mesopotamia