বিষয়সুচি
ধ্বনিতত্ত্ব [
অক্ষর]

ভাষা
ইংরেজি : language, linguistic communication
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | যোগাযোগ | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}

ভাষা হলো দুই বা ততোধিক সত্ত্বার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম এই সত্ত্বা হতে পারে একাধিক প্রাণী, যন্ত্র ইত্যাদি মানবেতর প্রাণীর ভাষাকে আমরা ভাষার মর্যাদা দিতে অভ্যস্থ নই কিন্তু গাভীর ডাকে বাছুর যে ছুটে আসে, সে ডাককে ভাষা বলতে বাধা কোথায় ? কিম্বা মানুষের সাথে কম্পিউটার যোগাযোগ রক্ষার জন্য যে ইঙ্গিতময় প্রক্রিয়া রয়েছে, তাকে কি ভাষা বলা যাবে না ? এই প্রশ্নগুলো তখনই জাগবে, যখন আমরা প্রথাগত ব্যাকরণের বাইরে এসে সার্বিক অর্থে ভাষাকে বিবেচনা করতে বসবো এবং একটু বিস্তারিতভাবে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করলে দেখবো  মানুষের মুখের ভাষা ছাড়াও অসংখ্য রকমের ভাষা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে আমরা সে সকল ভাষার সাহায্যও নিচ্ছি এবং বিশ্লেষণও করছি ধরা যাক, কম্পিউটারের কথাই

কম্পিউটার হলো অসংখ্য লজিক গেটের সমন্বয়ে গঠিত একটি যন্ত্র বিশেষ এই যন্ত্রকে দিয়ে কাজ করার জন্য মানুষ যে যুক্তি প্রয়োগ করে থাকে, তারই উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে কম্পিউটারের আদি ভাষা একে বলা হয় কম্পিউটারের যান্ত্রিক-ভাষা মানুষ তার তৈরিকৃত এই যান্ত্রিক-ভাষার সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দ্বারাই কম্পিউটারকে দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজটুকু করিয়ে নিচ্ছে এইভাবে বিচার করতে গেলে বিভিন্ন ভাষার প্রকরণ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং এই তালিকায় আমরা পাব নানা রকমের ভাষা যেমন  নাচের ভাষা, চোখের ভাষা, প্রকৃতির ভাষা ইত্যাদি

মূলত মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য বিচিত্র ধরনের সংকেত ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে ব্যবহারিক প্রয়োজনে এ সঙ্কেত হতে পারে ইঙ্গিতময় অভিব্যক্তি, হতে পারে শব্দময় প্রকাশ কিন্তু মুখের সাহায্যে উৎপন্ন ধ্বনি সহযোগে অর্থবোধক শব্দের ব্যবহারবিধিকেই সাধারণত ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে এক্ষেত্রে 'অর্থবোধক' শব্দটি একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আমরা যদি 'অর্থবোধক' শব্দের ব্যবহার-বিধিকে বাক্য গঠনের প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করি, তা হলে দেখতে হবে এই বাক্যটি কার কাছে বোধগম্য হচ্ছে সারা পৃথিবীর সকল মানুষ একই বৈশিষ্ট্যের উচ্চারণযোগ্য বা লিখনযোগ্য ভাষা বুঝে না যেমন চীনাদের ভাষা আমরা বুঝি না এই বিচারে দেখা যাবে ভাষার সংজ্ঞায় কিছুটা ত্রুটি থেকে যাচ্ছে সুকুমার সেন তাঁর ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন  'মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা' সুকুমার সেন অবশ্য এক্ষেত্রে মানুষের উচ্চারিত ধ্বনি ছাড়া অন্য কোন সঙ্কেতকে ভাষা হিসাবে স্বীকার করেন নি যদি গোড়াতেই আমরা ধরে নিই যে মানুষের ব্যবহৃত সঙ্কেতই ভাষার উপকরণ, তা হলেও কথা থেকে যায় উচ্চারিত ধ্বনিই যদি ভাষা হবে, তা হলে অশোকলিপিকে ভাষা বলা যাবে না; কারণ পাথরে খোদিত ওই লিপি এখন আর কারো মুখে উচ্চারিত হয় না এক্ষেত্রে লিপিকে যদি বাঙ্ময় ধ্বনির চিত্ররূপ হিসাবে বিবেচনা করি, তা হলে কিছুটা আপোষ করা যায় তা হলে, নাচের মুদ্রায় যে বাণী ফুটে উঠে, তাকে কি ভাষা বলা যাবে না ?

আর পাঁচরকম ভাষা থেকে যে কোন ভাষাকে পৃথকভাবে বিচার করতে হলে  গোড়াতেই ভাষাগত ধারণার বিশাল অঙ্গনের বাইরে এসে একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্গনে পা রাখতে হবে এক্ষেত্রে ভাষার সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে  ওই বিষয়ের বিচারে মানুষের মুখের ভাষাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য আমরা গোড়াতেই  ভাষাকে দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি এই ভাগ দুটো হলো  মানুষের ভাষা ও অন্যান্য ভাষা এক্ষেত্রে মানুষের ভাষা বলতে বুঝবো  মানুষের মুখনিঃসৃত ভাব-প্রকাশক ধ্বনি এবং তার ব্যবহারবিধি আর অন্যান্য ভাষা বলতে বুঝতে হবে  মানুষের মুখের ভাষা ছাড়া অন্যান্য আর সকল ভাষা এই বিচারে ভাষার সাধারণ সংজ্ঞা ও তার বিভাজন যেরূপ দাঁড়ায়, তা হলো মানুষের ভাষা ও অন্যান্য ভাষা                           

মানুষের ভাষা বা কথিত ভাষা
ইংরেজি :  speech, speech communication, spoken communication, spoken language, language, voice communication, oral communication
ঊর্ধ্বক্রমবাচকত { | শ্রবণ যোগাযোগ | যোগাযোগ | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}

মানুষের মুখনিঃসৃত ভাব-প্রকাশক ধ্বনি এবং তার ব্যবহারবিধি-কে এক কথায় মানুষের ভাষা বলা হয়। মানুষের ভাষাকে কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ শর্ত দ্বারা নির্দেশিত করা হয়।  যেমন

শর্ত-১ মানুষের ভাষার প্রধান উপকরণ হবে  মানুষের বাক্-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে উৎপন্ন ধ্বনি এক্ষেত্রে ইঙ্গিত, স্পর্শ ইত্যাদির সাহায্যে ভাব-প্রকাশের রীতি মানুষের ভাষার অন্তর্গত হবে না কিম্বা মানুষ হাতের তালিতে, আঙুলের চুটকিতে যে ইঙ্গিত করে, তাও ভাষা নয় একই কারণে, মানুষ যখন কথা বলার পাশাপাশি হাত, চোখ, মুখ ইত্যাদিতে যে ‌‌অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে, তাও ভাষা নয় অবশ্য বাক্-প্রত্যঙ্গজাত ভাষার ধ্বনি প্রকৃতির বিচারে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ধর দুটি হলো
                          ১.
অন্তর্গামী ধ্বনি (Ingressive sound) জাত ভাষা।
                          ২.
বহির্গামী ধ্বনি (Egressive sound) জাত ভাষা।
            

শর্ত-২ বাগ্‌যন্ত্রজাত ধ্বনির অর্থ থাকতে হবে প্রাথমিকভাবে দুই বা ততোধিক সত্তার ভিতর যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে কাজ করতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক অর্থে এই মাধ্যমটি একটি বড় গোষ্ঠীর কাছে অর্থবহ হতে হবে কিংবা জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ দ্বারা স্বীকৃত হতে হবে


ভাব-প্রকাশক কিছু ধ্বনি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য হতে পারে
যেমন  বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত তাই বাঙালি মাত্রেই ভাত শব্দটির সাথে পরিচিত এখানে ভাত শব্দটি ভাষা নয়  শুধু একটি শব্দ মাত্র যখন ভাত বা এই জাতীয় শব্দের সাথে অন্যান্য কিছু শব্দ যুক্ত হয়ে এমন একটি ভাবগত রূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে, এবং তা বৃহৎ কোনো জনগোষ্ঠী বুঝতে পারবে, তখন তা ভাষার উপকরণ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করবে

 

 একটি ভাষা-গোষ্ঠীর সকল মানুষ ওই ভাষার সকল শব্দ বুঝবে এমন কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় না যেমন  আমি ভাত খাই খাদ্য হিসাবে ভাত সবাই বুঝবেন কিন্তু যদি বলা হয়      
                            আমি যামিনী তুমি শশী হে  ভাতিছো গগন মাঝে


এখানে ভাত শব্দ আলোকিত হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে
ভাতিছো অর্থ হলো আলোকিত হচ্ছো রূপকার্থে উদ্ভাসিত হচ্ছো বা প্রকাশিত হচ্ছো-ও বলা যায় এই ভাত (ভাতো) শব্দটির সাথে  অন্ন-অর্থের ভাত-এর উচ্চারণগত পার্থক্য আছে কিন্তু যথার্থ উচ্চারণ করলেই যে বাঙালি মাত্রেই আলোকিত হওয়া অর্থটি বুঝে ফেলবেন তা কিন্তু নয় অনেক সময় মূল শব্দটির অর্থ অনেকে বুঝতে না পারলেও উক্ত শব্দ থেকে উৎপন্ন বা সাধিত শব্দ বুঝতে পারেন যেমন অনেকের ক্ষেত্রেই ভাত (আলোকিত হওয়া) বুঝতে অসুবিধা হলেও প্রভাত (প্রকৃষ্টরূপে ভাত) বুঝতে অসুবিধা হয় না তাই কোনো শব্দ অপ্রচলনের কারণে, বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের শব্দভাণ্ডার যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ না হওয়ার কারণে, কোনো বিশেষ শব্দ কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির কাছে অর্থহীন মনে হলেও  যদি উক্ত শব্দের গ্রহণযোগ্যতা একটি সুনির্দিষ্ট ভাষায় থাকে, তবে তা একটি ভাষার উপকরণ হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হবে     


আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধুমহলে প্রচলিত ইঙ্গিতময় শব্দ, গোয়েন্দা বিভাগের সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণযোগ্য হলেও তা মূল ভাষার অন্তর্ভুক্ত হবে না
কিন্তু যদি এই জাতীয় শব্দ ব্যাপক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তবে তা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে ব্যবহরিক ক্ষেত্রের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো কোনো শব্দ সকল ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করি না বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করে কোনো সুনির্দিষ্ট জাতির সংস্কৃতির উপর বা কোন জাতির অংশবিশেষের শব্দ ব্যবহারের উপর যেমন  বাঙালি বহু পরিবারের ভিতর প্রথাগত নিয়মে মুরুব্বিদের সামনে যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহারের রীতি নেই কিন্তু কোনো কোনো পরিবার বা গোষ্ঠর কাছে তা আছে আবার একই শব্দ কোনো গোষ্ঠীর কাছে সাধারণ ব্যবহারযোগ্য শব্দ হিসাবে বিবেচিত হলেও  অন্যত্র তা গালি হিসাবে বিবেচিত হয় 

শর্ত-৩
উচ্চারণযোগ্য ধ্বনির প্রকাশ হতে পারে অন্যকোন মাধ্যমে কিন্তু উক্ত মাধ্যম থেকে যদি প্রমিত উচ্চারণযোগ্য মানে পৌছানো যায়, তবে তা ভাষার বিকল্প প্রকাশ-মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হবে এক্ষেত্রে যে কোন ভাষার নিজস্ব বর্ণলিপিকে উক্ত ভাষার বিকল্প মাধ্যম হিসাবে ধরা হবে কারণ, উক্ত লিপি পাঠ করে মূল ভাষাকে অবিকৃতভাবে উচ্চারণ করা যায় প্রতীকী চিত্র যদি একাধিক উচ্চারিত রূপ প্রকাশ করে, তবে তা একটি সুনির্দিষ্ট ভাষার  অংশ হবে না ধরা যাক কেউ এক গ্লাস পানির ছবি আঁকলেন এই ছবি দেখে কেউই বলবেন, এক গ্লাস পানি, কেউ বলবেন এক গ্লাস জল এক্ষেত্রে অর্থগত দিক থেকে সমার্থ মান প্রদান করলেও উচ্চারণের বিচারে তা সমান হবে না কিন্তু প্রচলিত বাংলা বর্ণ এবং লিখন রীতির সাহায্যে  এক গ্লাস পানি বা এক গ্লাস জল লিখলে, তা পাঠ করে যথার্থ ধ্বনিগত মান প্রদান করা যাবে যদি ভাবলিপিতে (Ideogrph) রচিত কোন শব্দ সুনির্দিষ্ট কোন ধ্বনিকে প্রকাশ না করে, তা হলে তা কোন সুনির্দিষ্ট ভাষার বাহক হিসাবে বিবেচিত হবে না চীন, কোরিয়াতে চিত্রলিপিতে লিখার চল বহুদিন ধরে চলে আসছে চীনের অঞ্চল বিশেষে কোন বিশেষ চিত্রকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পাঠ করা হয়ে থাকে কিন্তু সুনির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের সকলেই একটি চিত্রকে একই রকমভাবে উচ্চারণ করেন তাই সুনির্দিষ্ট ভাবলিপিটি একটি শব্দের ধ্বনির প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে


এক সময় ভাষার লেখ্যরূপটি ছিল একমাত্র যথার্থ প্রকাশ মাধ্যম আধুনিককালে এর যথার্থ মান পাওয়া যায় বাণী-ধারণ করা যায় এমন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত টেপ, সিডি, ডিভিডি ইত্যাদি একটি ভাষার ধ্বনিরূপকে প্রকাশ করতে পারে কম্পিউটারের প্রোগ্রামের সাহায্যে লিখিত ভাষাকে পাঠ করানো যায় এই সকল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সৃষ্ট ধ্বনি দ্বারা একটি ভাষাকে প্রকাশ করা যেতে পারে
 

১.৩ ভাষার রূপান্তর ও অস্তিত্ব

সমগ্র মানুষজাতি প্রকৃত অর্থে ধ্বনিময় সঙ্কেতের সাহায্যে যে সকল ভাষা জন্ম দি্য়েছিল, তার সবগুলোই এখন আর প্রচলিত নয় মূলত ভাষা জীবিত থাকে মানুষের মুখে মুখে সেই কারণে, যে সকল ভাষায় এখন আর কোন মানুষই কথা কথা বলে না, সেগুলোকে মৃতভাষা বলা হয় কোন ভাষার মৃত্যু বা রূপান্তরের পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকে

ভাষার মৃত্যুর কারণ :
ভাষার মৃত্যু ঘটে, মানুষের মুখে মুখে চলাচলের অভাবে এক্ষেত্রে যে কারণগুলোকে দায়ী করা হয়, তা হলো

. জনসংখ্যার বিলুপ্তি : একটি সুনির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে এমন সব মানুষ মারা গেল, উক্ত ভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে যে সকল ভাষায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কথা বলে, এদের বেলায় তা খাটে না কিন্তু এই ঘটনাটি ঘটতে পারে অতি অল্পসংখ্যক মানুষ কথা বলে এমন ভাষার ক্ষেত্রে যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে শাস্তা (Shasta) নামের একটি ভাষা ১৯৮০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল এই সময় মাত্র দুইজন প্রবীন ব্যক্তি এই ভাষা ব্যবহার করতে পারতেন ১৯৯০ সালের ভিতর এই দুইজনের মৃত্যু হলে- এই ভাষাকে মৃত ভাষা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে


. ভাষাগত বিবর্তন : একটি ভাষা কোন কারণে বিবর্তিত হয়ে নূতন ভাষায় পরিণত হতে পারে ফলে আদি-ভাষাটির মৃত্যু হতে পারে বিবর্তনের ফলে- আদিভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে কয়েকটি কারণে যেমন


   
স্থানীয়ভাবে বিবর্তন : একই স্থানের এই ঘটনাটি একই স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে ঘটতে পারে।  দীর্ঘদিনের বিবর্তনের কারণে একটি ভাষা পরিবর্তিত হয়ে এক বা একাধিক নূতন রূপ লাভ করে থাকে কালক্রমে এই নূতন ভাষাগুলোর পরিবর্তন এত বেশি হয় যে, ভাষা বিজ্ঞানীরা আদি ভাষা এবং নব্য ভাষাগুলোকে পৃথকভাবে শনাক্ত করে থাকেন আদি ভাষায় কথা বলে এমন জনগোষ্ঠীর একজনও না জীবিত থাকলে, তা মৃত ভাষায় পরিণত হবে


   
স্থানান্তরজনীত কারণে বিবর্তন : কোন একটি ভাষার জনগোষ্ঠী ঘটনাক্রমে ভৌগলিক দূরত্বের বিচারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে এবং এদের ভিতর যোগাযোগ ব্যাহত হলে, কালক্রমে প্রতিটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর ভিতর পৃথক কথনরীতি গড়ে উঠে এবং কালক্রমে তা পৃথক পৃথক পৃথক ভাষায় পরিণত হয় ফলে উক্ত ভাষা সমূহের আদিরূপটি হারিয়ে যায় যেমন ল্যাটিন ভাষা উল্লেখ্য ল্যাটিনের রূপান্তরিত ভাষাগুলো হলো- ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ইত্যাদি


   
অপর ভাষা দ্বারা বিলুপ্ত : কোন বহুলব্যবহৃত ভাষার সংস্পর্শে এসে একটি আদি-ভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঞ্চলের আদিবাসীদের একটি ভাষা ছিল টোনকাওয়া (Tonkawa) বর্তমানে টোনকাওয়া জাতির সকল মানুষ ইংরেজি ভাষায় অভ্যস্থ বর্তমানে টোনকাওয়া ভাষার দু-একটি শব্দ ছাড়া টোনকাওয়া জাতির কেউই তাদের ভাষায় কথা বলতে পারে না ফলে এই ভাষটিকে বর্তমানে মৃত ভাষা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে

   
মিশ্রণ : অনেক সময় বহিরাগত কোন ভাষার সাথে স্থানীয় ভাষা মিশ্রিত হয়ে নূতন ভাষার সৃষ্টি হতে পারে এক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষাটির মূলরূপটি বিলুপ্ত হতে পারে এই বিচারে বর্তমানে প্রচলিত সকল ভাষারই প্রচীন রূপের মৃত্যু ঘটেছে এই পদ্ধতিতে তবে উভয় ভাষার সার্বিক মিলনে যে সকল মিশ্র ভাষার সৃষ্টি হয়, ভাষা-শাস্ত্রে এদেরকে জারগন (Jargon) বলা হয় যেমন- বীচ-লা-মার, পিজিন, মরিশাস ক্রেওল, চিনুক জারগন ইত্যাদি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ
 

মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে, তার নিজস্ব এলাকার বাইরে এলাকার সাথে যোগাযোগ করে কিম্বা অন্য গোষ্ঠী তাদের প্রয়োজনে এসে হাজির হয় যে কোন কারণেই হোক না কেন, দুই ততোধিক ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখনই উভয় ভাষার ভিতর পরিবর্তনের সূত্র গড়ে উঠে এই পরিবর্তনের ধারায় যে বিষয়গুলো ঘটতে পারে, তা হলো  

. উভয় ভাষার লোকেরা উভয় ভাষা থেকে শব্দ সঞ্চয়ন করবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে শব্দ গৃহীত হবে অজ্ঞাত বস্তুর নাম যেমন কম্পিউটারের মতো একটি যন্ত্রের অস্তিত্ব বাঙালীর কাছে অজ্ঞাত ছিল বাইরের জগত থেকে আগত এই যন্ত্রটির নাম অবিকৃতভাবে বাংলাভাষায় গৃহীত হয়েছে

. কোন কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে একটি ভাষার নিজস্ব শব্দ থাকলেও, জনসাধারণ বিদেশি ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে থাকে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা থেকে বহু শব্দ এইভাবে প্রচলিত হয়েছে বা এখনো হচ্ছে একই কারণে, সংস্কৃত পণ্ডিত শব্দটিও ইংরেজিতে pundit  হিসাবে গৃহীত হয়েছে
 

২০০৩ সালের হিসাব অনুসারে ধারণা করা হয়েছে, জীবিত ভাষার মোট সংখ্যা ছিল ৬,৮০৯ দশ লক্ষ এবং এর বেশি লোক কথা বলে, এমন ভাষার সংখ্য প্রায় ২০০ ৩৫৭টি ভাষার ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাত্র ৫০ জনের কম বলার লোক কথা বলে ১৯৯৬ সালের আদমশুমারীতে উত্তর আমেরিকার লোয়ার চিনুক ভাষার Kiksht আঞ্চলিক বা উপভাষায় কথা বলার লোক পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ১২ জন ৪৬টি এমন ভাষা পাওয়া গেছে, যার জনসংখ্যা মাত্র ১ জন বলাই বাহুল্য এই একটি মাত্র লোকের মৃত্যুর সাথে সাথে ৪৬টি ভাষার মৃত্যু ঘটবে গত ৫০০ বৎসরের ভিতর ৪.৫% ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এর ভিতর উত্তর আমেরিকার ১৭৬টি ভাষার ৫২টি এবং অস্ট্রেলিয়ার ২৩৫টি ভাষার ৩১টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে
 

১.৪ ভাষাগত ব্যবধান : পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বিবিধ ভাষার প্রচলন রয়েছে এত সব ভাষার সৃষ্টির একমাত্র কারণ- ভাষার ক্রমবিবর্তন একটি সুনির্দিষ্ট ভাষার ক্রমবিবর্তন খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ধরা যায় না কিন্তু অন্তত ১০০ বৎসর পর পর কোন ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করলে, এই পরিবর্তনের ধারা কিছুটা উপলব্ধি করা যায় কিন্তু এই সময়ের ব্যবধান যত বাড়তে থাকে, ততই ভাষাগত অসামঞ্জস্য বৃদ্ধি পেতে থাকে

কই সময়ে দূরবর্তী দুটি অঞ্চলে একই ভাষা প্রচলিত হলেও সময় ও আঞ্চলিক দুরত্বের বিচারে দুটি অঞ্চলের ভাষার ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে থাকে তবে এই পরিবর্তনের ধারা হয় একটু ভিন্ন রকম বড় ধরনের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে, একই ভাষার যে পরিবর্তন হতে পারে তার উদহারণ ইংরেজি ভাষা ইংল্যাণ্ড, অস্ট্রেলিয়ার ও উত্তর আমেরিকার ইংরেজির দিকে তাকালে এর অজস্র উদাহরণ মেলে

মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে যথার্থ যোগাযোগের অভাবে এবং সুদীর্ঘ কালের বিচারে পৃথক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল মধ্য এশিয়ার আর্যদের আদি ভাষার সাথে ভারতে প্রবেশকারী আর্যদের ভাষা গোড়াতে একই ছিল কিন্তু সময়, ভৌগোলিক দূরত্ব ও যথার্থ যোগাযোগের অভাবে, উভয় মানব গোষ্ঠীর ভিতর যে ভাষাগত অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে পৃথক পৃথক ভাষার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় এই সময় রোমের রাষ্ট্রভাষা ছিল ল্যাটিন এই সময় ল্যাটিনভাষীরা রোম ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিনের ব্যবধানে, বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া মানুষদের ভিতর পৃথক কথনরীতি গড়ে উঠেছিল তার চেয়ে বড় কথা এই সকল জনগোষ্ঠী নিজেদের ভিতর যোগাযোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল ফলে এই অঞ্চলে প্রধান পাঁচটি ভাষার জন্ম নিয়েছিল এই ভাষাগুলো হলো ইটালিয়ান, ফরাসি, স্পেনিশ, পর্তুগিজ এবং রোমানিয়ান বর্তমানে একটি ভাষা ভেঙ্গে নূতন কোন শাখা-ভাষার উৎপত্তি হওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ প্রতিটি ভাষার আঞ্চলিক ভাষার লোকেরা একটি প্রমিত কথন ও লিখনরীতির কাছে আসার চেষ্টা করছে আর একাজে সাহায্য করছে রেডিও, টেলিভিশন সংবাদপত্র ইত্যাদি এই যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার না ঘটলে, চট্টগ্রাম বা সিলেট আঞ্চলিক ভাষা একসময় পৃথক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতো বর্তমানে তা একটি অসম্ভব কল্পনা হিসাবে মনে হতে পারে একটি ভাষা ভেঙে নূতন কোনো ভাষার সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে- প্রভাবশালী কোন বড় ভাষা ছোট ছোট ভাষাগুলিকে গ্রাস করে ফেলছে ফলে দুর্বল ভাষাগুলো বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে

 

একই ভাষার পরিবর্তনে আঞ্চলিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, ধর্মীয় প্রভাব ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এর ফলে প্রমিত ভাষার ভিতরও পৃথক আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয় যেমন বাংলা ভাষার কথাই ধরা যায় পানি বা জল সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন পানি শব্দটি হিন্দিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় হিন্দিতে এটি ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দ বাংলাভাষায় এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন মুসলমান সম্প্রদায় বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এবং এই কারণেই পানি শব্দটি বাংলাদেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় প্রচলিত রীতিকে অনুসরণ করে, এই শব্দটি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করছেন কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এই শব্দটি জল হিসাবে ব্যবহৃত হয় যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তাই ধর্মীয় আচরণের সাথে সাথে নামাজ, জায়নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে


অনেক সময় কাছাকাছি দুটি ভাষার লিখন পদ্ধতি ভিন্ন হয়ে যেতে পারে
যেমন হিন্দি এবং উর্দু ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় এর সাথে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, পরিবেশ ইত্যাদির কারণে পৃথক ভাষার সৃষ্টি করে থাকে যেমন ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যে সাইবেরিয়ান এবং ক্রোয়েশিয়ান ভাষার কথ্য রীতি খুবই কাছাকাছি কিন্তু এই দুটো ভাষার বর্ণমালা একই নয় এছাড়া ক্রোয়েশিয়াবাসীরা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, পক্ষান্তরে সাইবেরিয়াবাসীরা হলেন অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্মীয়, রাজনেতিক দর্শন ও বর্ণমালার বিচারে এক্ষেত্রে দুটি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে একই ভাবে ম্যাসেডোনিয়া এবং বুলগেরিয়ার কথন রীতি প্রায় একই বুলগেরিয়ার মানুষ মনে করেন যে, ম্যাসেডোনিয়ার ভাষা বুলগেরিয়ান ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ বিশেষ কিন্তু ম্যাসেডোনিয়ার অধিবাসীরা তাঁদের ভাষাকে একটি পৃথক ভাষা হিসাবেই বিবেচনা করেন উত্তর জার্মানীর আঞ্চলিক ভাষা এবং নেদারল্যান্ডের ডাচ ভাষা একই কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, এ দুটোকে পৃথকভাষা হিসাবে বিবেচনা করা হয় অন্যদিকে উত্তর জার্মানীর আঞ্চলিক ভাষার সাথে সুইস জার্মানীর ভাষাগত প্রভেদ অনেক থাকার পরও এই দুটি ভাষাকে জার্মান ভাষার অংশ হিসাবেই বিবেচনা করা হয় ইউরোপীয় ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে- ড্যানিশ, নওরয়েন এবং সুইডিশ ভাষার ভিতর যেটুকু পার্থক্য রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পার্থক্য রয়েছে ইটালির বিভিন্ন শহরের ভিতরকার ভাষার ভিতরে তারপরেও রাজনৈতিক কারণে ইটালির অন্তর্গত সকল ভাষা ইটালির ভাষা হিসাবেই বিবেচিত হয় পক্ষান্তরে রাজনৈতিক কারণে ড্যানিশ, নওরয়েন এবং সুইডিশকে পৃথক ভাষা হিসাবেই বিবেচনা করা হয়
 

১.৫ ভাষার উৎপত্তি ও তার ক্রমবিবর্তন

কবে থেকে মানুষের ভাষার সূচনা হয়েছিল কবে, তা নির্ণয় করাটা সত্যই দুরূহ ভাষার কথা বাদ দিলেও- বিজ্ঞান সম্মতভাবে মানুষের উৎপত্তির সময়ই সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করা যায় নাই ভাষার উৎপত্তি, এর ক্রমবিকাশ বা ক্রমবিবর্তন নিয়ে বিস্তর মতবাদ রয়েছে প্রকৃতপক্ষে, মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সভ্যতার বিকাশ এবং তার অংশ হিসাবে ভাষার ক্রমবির্তন সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে- শুরু করা উচিৎ আদিপ্রাণের সূচনালগ্ন থেকে

বিজ্ঞানীদের মতে ৩৮০ কোটি বৎসর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠে আদি-প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রবিবর্তনের ধারায়
আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ২ লক্ষ হাজার বৎসর আগে

আদিম মানুষের মস্তিষ্ক ছিল সুগঠিত, কিন্তু আধুনিক মানুষের বিচারে এদের বুদ্ধির স্তর ছিল বেশ নিচুতে পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের দৈহিক পরিবর্তন যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষের বুদ্ধির স্তরে এই বুদ্ধির স্তর যতই কম থাক, তারা যে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতো তা জানা যায় আর দলবদ্ধভাবে থাকার জন্যই দলের ভিতরে, তথ্য আদান-প্রদানের জন্য জন্ম নিয়েছিল আদিম ভাষার

জীবজগতের ভাষার ক্রম বিবর্তনের রূপরেখাটি আদি-জীব থেকে টানা শুরু করলেও, সুনির্দিষ্টভাবে একটি জায়গায় এসে বলতেই হবে- এখান থেকে মানুষের ভাষা শুরু কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় কারণ, আমরা জীবের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- কোন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণকে এইভাবে নির্দেশিত করতে পারি না যে, এটাই হলো মানবজাতির জন্মদিন একই কারণে বলতে পারি না, এটাই ছিল ভাষার জন্মদিন। 

ধর্মগ্রন্থগুলোর মতে মানুষ তার শরীর ও আত্মার সাথে সাথে ভাষাজ্ঞানও পেয়েছিল স্রষ্টার কাছ থেকে বাইবেলের মতে "আর সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকা হইতে সকল বন্য পশু ও আকাশের সকল পক্ষী নির্মাণ করিলেন; পরে আদম তাহাদের কি কি নাম রাখিবেন, তাহা জানিতে সেই সকলকে তাঁহার নিকটে আনিলেন, তাহাতে আদম যে সজীব প্রাণীর নাম রাখিলেন, তাহার সেই নাম হইল আদম যাবতীয় গ্রাম্য পশুর ও খেচর পক্ষীর ও যাবতীয় বন্য পশুর নাম রাখিলেন......." সূত্র : পবিত্র বাইবেল। আদিপুস্তক ২:১৯-২০। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি

মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে কোরানের মতও একই রকম
ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে আদমের ভাষায় প্রকৃতি জানা যায় না কিন্তু ধারণা পাওয়া যায় আদমের ভাষায়ই ছিল আদি-ভাষা অন্যান্য ধর্ম-বিশ্বাসগুলো থেকেও মোটামুটিভাবে এই ধারণাই পাওয়া যায় 

ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে
আদিপিতা আদম সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে ভাষা শিখেছিলেন এবং তা ঘটেছিল একবারে একালে কম্পিউটারে আমরা যেভাবে সফটওয়ার ইনস্টল করি, আদমের মাথায় ভাষা রোপিত হয়েছিল এই ভাবে কিন্তু স্বর্গচ্যুত আদমের সন্তানরা সেই আদি ভাষার আদ্যরূপ ধরে রাখতে পারে নাই ফলে কালক্রমে বহুভাষার জন্ম হয়েছে বাইবেলে অবশ্য এই ভাষা বিভেদের একটি চমৎকার গল্প আছে বাইবেলের মতে
 

'সমস্ত পথিবীতে এক ভাষা একরূপ কথা ছিল পরে লোকেরা পূর্বদিকে ভ্রমণ করিতে করিতে শিনিয়র দেশে এক সমস্থলী পাইয়া সে স্থানে বসতি করিল; আর পরস্পর কহিল, আইস, আমরা ইস্টক নির্মাণ করিয়া অগ্নিতে দগ্ধ করি; তাহাতে ইস্টক তাহাদের প্রস্তর ও মেটিয়া তৈল চূণ হইল পরে তাহারা কহিল, আইস, আমরা আপনাদের নিমিত্তে এক নগর ও গগনস্পর্শী এক উচ্চগৃহ নির্মাণ করিয়া আপনাদের নাম বিখ্যাত করি, পাছে সমস্ত ভূমণ্ডলে ছিন্নভিন্ন হই পরে মনুষ্য-সন্তানেরা যে নগর ও উচ্চগৃহ নির্মাণ করিতেছিল, তাহা দেখিতে সদাপ্রভু নামিয়া আসিলেন আর সদাপ্রভু কহিলেন, দেখ, তাহারা সকলে এক জাতি ও এক ভাষাবাদী; এখন এই কর্মে প্রবৃত্ত হইল; ইহার পরে যে কিছু করিতে সঙ্কল্প করিবে, তাহা হইতে নিবারিত হইবে না আইস, আমরা নীচে গিয়া, সেই স্থানে তাহাদের ভাষার ভেদ জন্মাই, যেন তাহারা এক জন অন্যের ভাষা বুঝিতে না পারে আর সদাপ্রভু তথা হইতে সমস্ত ভূমণ্ডলে তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিলেন, এবং তাহারা নগর পত্তন হইতে নিবৃত্ত হইল এই জন্য সেই নগরের নাম বাবিল ভেদ থাকিল; কেননা সেই স্থানে সদাপ্রভু সমস্ত পৃথিবীর ভাষার ভেদ জন্মাইয়াছিলেন, এবং তথা হইতে সদাপ্রভু তাহাদিগকে সমস্ত ভূমণ্ডলে ছিন্নভিন্ন করিয়াছিলেন'
সূত্র : পবিত্র বাইবেল। আদিপুস্তক। বাবিলের ভাষা-ভেদ ১১। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি
 

বাইবেলের ভাষাভেদের বিবরণ পাঠ করে মনে হয়, মানুষের একতা দেখে সদাপ্রভু ভয় পেয়েছিলেন তাই মানুষের একতা নষ্ট করার জন্য যে ভাষা-ভেদ সৃষ্টি করলেন এবং এই কারণেই বলতেই হয়, মানুষের ভিতর জাতিগত ঐক্য বিনষ্ট করার চেষ্টা যদি কেউ করেন, তা হলে তিনি সদাপ্রভুর ইচ্ছাই পূরণ করবেন

বিজ্ঞানীরা সভ্যতা শনাক্ত করেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত কিছু উপকরণের বিচার করে এই উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন মানুষের অস্ত্রশস্ত্র, আবাসস্থলের নমুনা এবং প্রাচীন গ্রন্থসমূহ এ সকল উপকরণ থেকে মোটামুটিভাবে মানুষের সভ্যতার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় বটে, কিন্তু প্রকৃষ্ট সত্যে উপনীত হওয়া যায় না বনমানুষ থেকে মানুষ যখন সভ্য-মানুষে পরিণত হচ্ছিল, তখন তার ভাষার বিকাশ ঘটেছিল সে ভাষার রূপ কেমন ছিল, তার নমুনা পাওয়া যায় না বিজ্ঞানীরা তাই এর একটি প্রাথমিক শনাক্তকারী নাম দিয়েছেন এর নাম প্রাগ-ভাষা (Proto-language)

 

ধারণা করা যায়, মানুষ প্রথম দিকে কোন বস্তুকে প্রতীকী ধ্বনি দ্বারা নির্দেশিত করত শিখেছিল এই সকল প্রতীকী ধ্বনির সাথে অঙ্গভঙ্গী দ্বারা মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো ক্রমে ক্রমে মূল শব্দের সাথে অঙ্গভঙ্গী প্রতীকী ধ্বনি যুক্ত করলো ফলে ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিলো বাক্যরীতি সব মিলিয়ে সৃষ্টি হলো একটি ভাষার অবশ্যই এ কথা ভাবার কোন কারণ নেই যে, বর্তমানে প্রচলিত সকল ভাষার উৎপত্তি ঘটেছিল একটি মূল ভাষা থেকে কারণ মানুষের আদি গোষ্ঠীগুলোর বিকাশ ঘটেছিল আফ্রিকা, জাভা, চীন ইত্যাদি অঞ্চলে নৃতাত্তিক বিচারে এরা ঠিক হোমো স্যাপিয়েন্স নয়, কিন্তু এরা ছিল হোমো স্যাপিয়েন্স-এর উত্তর পুরুষ সুতরাং বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ভিতর যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছিল এটা মানতেই হবে

আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স বা এর কাছাকাছি প্রজাতিগুলো সুদূর অতীতে কি ধরনের ভাষা ব্যবহার করতো তার নমুনা আমাদের কাছে নেই
আমরা একটি সময়ে এসে মানুষের ভাষার কিছু নমুনা পাই প্রাচীন মৃত্তিকা-ফলকে উৎকীর্ণ রচনা থেকে এই বিচারে আমরা ভাষাকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি ভাগ দুটি হলো প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক ভাষা

১ প্রাগৈতিহাসিক ভাষা: যে সকল ভাষার ইতিহাস এবং নমুনা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং পুরোটুকুই অনুমান দ্বারা সত্যকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়।  [দেখুন: প্রাগৈতিহাসিক ভাষা ]

২. ঐতিহাসিক ভাষা: যে সকল ভাষার ইতিহাস এবং নমুনা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এই জাতীয় ভাষার ঐতিহাসিক সত্যের পাশাপাশি কিছু অনুমান করা হয়। আমাদের জ্ঞাত বা নামধারী সকল ভাষাই ঐতিহাসিক ভাষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।