এই যন্ত্রটি বাজানোর সময় বাবু হয়ে বসতে হয়। এরপর যন্ত্রটি সামনে অনুভূমিক অবস্থানে রেখে উভয় হাতের সাহায্যে বোলবাণী তোলা হয়। এই যন্ত্রের বোলবাণী হিসেবে উল্লেখ করা হয়― ধা, দেন্, তা, তাগে, কৎ, তেটে, ঘেড়ে, নাক ইত্যাদি।
ধ্রুপদ বা ধ্রুপদাঙ্গের গানের সকল তালই এই যন্ত্রে বাজানো হয়। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য তালগুলো হলো― আড়াচৌতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল, তেওরা, ধামার, সুরফাঁকতাল ইত্যাদি।
বঙ্গদেশে পাখোয়াজ
খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে বঙ্গদেশে কিছু পাখোয়াজ বাদকের নাম পাওয়া যায়।
এঁরা মূলত সঙ্গতকারী ছিলেন। এঁদের দ্বারা কোনো বিশেষ বাদনরীতি প্রচলিত হয় নি।
তাছাড়া ঐতিহ্য পরম্পরা কোনো পাখোয়াজ-শিল্পীরও আত্মপ্রকাশ ঘটে নি। প্রথমদিকে
পাখোয়াজের চর্চা শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর, বিষ্ণুপুর, চন্দ্রকোণা, বহরমপুর প্রভৃতি
অঞ্চলে। সে সময় ধ্রুপদ গানের বেশ কদর ছিল এই অঞ্চলে। এই সূত্রে এই অঞ্চলগুলোতে
ধ্রুপদের তালরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে পাখোয়াজ বাদন চালু হয়েছিল। তবে যথাযথ তথ্য না
থাকায়, এই সময়ের পাখোয়াজ বাদনের ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যে জনৈক 'সমজ খেল' নামক মৃদঙ্গবাদকের নাম
পাওয়া যায়। সে সময়ের কালোয়াতি গান বলতে ধ্রুপদকেই বুঝানো হতো। এই গানের সাথে
মৃদঙ্গবাদক 'সমজ খেল' পাখোয়াজ বাজাতেন বলেই অনুমান করা যায়।
কালোয়াত গায়ন বিশ্রাম খাঁ প্রভৃতি।
মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি॥
ধারণা করা হয়, কৃষ্ণনগরের
পরে কালোয়াতি গানের চর্চা শুরু হয় বিষ্ণুপুরে। যতদূর জানা যায়, বিষ্ণুপুরের প্রথম
বাঙালি পাখোয়াজ বাদক ছিলেন বেচারাম চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিষ্ণুপুরী ঘরাণার ধ্রুপদের
প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত রামশঙ্কর এবং তাঁর তৃতীয় পুত্র রামকেশরের (জন্ম আনুমানিক ১৮০৮
খ্রিষ্টাব্দ) সাথে পাখোয়াজ সঙ্গত করেছেন। উল্লেখ্য, এঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গিরিশচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৬৮-১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ)
সঙ্গীত সভার বৃত্তিধারী পাখোয়াজবাদক ছিলেন। রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত
বিষ্ণুপুর নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বেচারাম বিখ্যাত মৃদঙ্গবিদ লালা
হীরালালজীর কাছে মৃদঙ্গবাদন শিখেছিলেন। সম্ভবত হীরালালজী ছিলেন অবাঙালি। বেচারাম
চট্টোপাধ্য এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া, তাঁর বংশের বা
শিষ্যের ভিতর আর কোনো পাখোয়াজ বাদকের নাম পাওয়া যায় না।
বিষ্ণুপুরের অপর প্রখ্যাত পাখোয়াজ ছিলেন রামমোহন চক্রবর্তী। এঁর দ্বারা একটি
পাখোয়াজ বাদন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তিনি পাখোয়াজবাদন শিখেছিলেন পীরবক্সের কাছে।
রামমোহনের শিষ্য ছিলেন জগৎ গোস্বামী। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ গায়ক যদুভট্ট
বিষ্ণুপুরে থাকার সময়, জগৎশেঠ তাঁর সাথে সঙ্গত করতেন। রামমোহনের অপর শিষ্য জগন্নাথ
মুখোপাধ্যায় ১৮৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ত্রিপুরার রাজ দরবারে যদুভট্টের সাথে সঙ্গত
করেছেন। রামমোহনের অপর শিষ্য অনন্তলাল মুখাপাধ্যায় পাখোয়াজবাদক হিসেবে কলিকাতায়
প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত ধ্রুপদ গায়ক শিবনারায়ণ মিশ্র, কান্তাপ্রসাদ
মিশ্র, গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, যদুভট্টের সাথে সঙ্গত করেছেন। এই তিন শিষ্যের
সূত্রে রামমোহন চক্রবর্তীকে বিষ্ণুপুরী ঘরানার পাখোয়াজ বাদনের স্থপতি বলা হয়।