বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রখ্যাত সেতার বাদক
ওস্তাদ ইমদাদ খাঁ মসীদখানি বাজ-এর উপর ভিত্তি করে, একটি পৃথক বাদনরীতির সৃষ্টি
করেন। এই বাদনরীতিকে বলা হয় ইমদাদখানি বাজ।
পাঁচ তারের সেতারের সাথে জয়পুরের সেতারবাদকরা চিকারীর তার ব্যবহার করতেন না। মিঞা
তানসেনের পুত্রবংশীয় সেতারবাদক ওস্তাদ পিয়ার খাঁ এবং দৌহিত্র-বংশীয় ওস্তাদ ওমরাও খাঁ
সুরবাহারের সৃষ্টি করেন। সে সময় তাঁরা সুরবাহারের সাথে চিকারী এবং তরপের তার
ব্যবহার করেন। চিকারীর তারের সুরমাধুর্য শুনে, সেতারেও চিকারীর তার ব্যবহার করা শুরু হয়।
কিন্তু জয়পুরের সেনীয়রা তাঁদের সেতারে চিকারী সংযোজন করা থেকে দূরে ছিলেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে
সকল ঘরানার সেতারেই তরপ এবং চিকারীর তার ব্যবহার করা হয়।
সেতারের নিচের অংশে একটি বড় ধরনের লাউয়ের খোল ব্যবহার করা হয়। এই খোলটি একটি কাঠের খোলের সাথে যুক্ত থাকে। এই কাষ্ঠময় খোলককে বলা হয় তব্লী। এই তবলী অংশের সাথে যুক্ত থাকে একটি লম্বা, মোটা এবং সরল কাঠের দণ্ড। এই দণ্ডকে বলা হয় পটরী। নিচের খোলের সামনের দিকে থাকে সওয়ারি। এর উপর দিয়ে পটরীর অপরপ্রান্ত বরাবর ধাতব তারউলো টানা হয়। বর্তমানে সেতারে ৭টি তার ব্যবহার করা হয়। এর সাথে থাকে তরপের জন্য থাকে ১১টি বা ১৩টি তার। সেতারের দণ্ডের গায়ে বাঁকানো পিতলের ঘাট বাঁধা থাকে। সচল ঠাটের সেতারে ১৭টি এবং অচল ঠাটের সেতারে ২৩টি ঘাট থাকে। তবে বহুল প্রচলিত সেতারগুলোতে ঘাট থাকে ১৯টি। উল্লেখ্য ঊনিশ ঘাটের সেতারকে সাধারণভাবে অচল ঠাটের সেতার বলা হয়।
সেতারের মূল ৩টি তার মা সা পা-তে বাঁধা
থাকে। এরপর চতুর্থটি থাকে সা । এরপর থাকে কমপক্ষে ৩টি সঙ্গতকারী
তার, যেগুলোকে চিকারীর তার বলা হয়। এগুলো সা সা গা -তে বাঁধা থাকে। এছাড়াও ৯ থেকে
১৩টি তড়ফের তার থাকে মূর্ছনা ধরে রাখার জন্য। উভয় শ্রেণীর তারই তুম্বার উপরিস্থিত
বায়ার একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ডান্ডির উপরিভাগে গিয়ে শেষ হয়। অনেকটা
চাবির মতো দেখতে কুন্তি দিয়ে এ তারগুলোকে আটকে রাখা হয়।
বড় তরফের সেতারে সাধারণত দুটি লাউ ব্যবহার করা হয়। একসময় প্রধান লাউয়ের কাছাকাছি
আরও একটি লাউ ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে তিন-লাউযুক্ত সেতার দেখা যায় না।
কতিপয় উল্লেখযোগ্য সেতারবাদক
ওস্তাদ এনায়েত খান
ওস্তাদ বিলায়েত খান
ওস্তাদ ইমরাত খান
পণ্ডিত রবি শঙ্কর
পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়
ওস্তাদ মুস্তাক আলী খান
ওস্তাদ আব্দুল হালিম জাফর খান
বঙ্গদেশে সেতারবাদনের
ইতিহাস
রাগসঙ্গীত বাজানোর উপযোগী যন্ত্রের
ক্ষেত্রে আদি যন্ত্র হিসেবে বীণাকে চিহ্নিত করা হয়। সঙ্গীতের এই ক্ষেত্রে বঙ্গদেশেও
বীণাই প্রথম বাদ্যযন্ত্র। যতদূর জানা যায়,
রাগসঙ্গীত জগতে বিষ্ণুপুরে
ঘরানার আদি পুরুষ
পণ্ডিত
রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-
জ্যেষ্ঠ পুত্র মাধব ভট্টাচার্য বঙ্গদেশের আদি
বীণাবাদক ছিলেন। এঁর পূর্বে বীণাবাদক হিসেবে আর কোনো নাম পাওয়া যায় না। মাধব
ভট্টাচার্য কোন ধরনের বীণা বাজাতেন তাও বিশেষভাবে জানা যায় না।
কালানুক্রমের বিচারে রাগসঙ্গীত বাজানোর উপযোগী পরবর্তী যন্ত্রের যে নাম পাওয়া যায়,
তা হলো সেতার। কারো কারো মতে সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবে সেতারের ব্যবহার শুরু হয়েছিল
অষ্টাদশ শতকে। চুঁচুড়া অঞ্চলে আখড়াই গানে অন্যান্য যন্ত্রের সাথে সেতারও ব্যবহৃত
হতো। বিশেষ করে আখড়াই গানের সাজ বাদ্যের সাথে সেতার, ঢোল, বেহালা বাজানো হতো। সাজ
বাদনে সেকালের প্রখ্যাত সেতারবাদক ছিলেন মাধবচন্দ্র ঘোষ। কিন্তু তাঁর একক বাদন
সম্পর্কে কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
সেকালের অখণ্ড বঙ্গদেশের সেতার বাদন তিনটি অঞ্চলে বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল। এই
অঞ্চল তিনটি হলো−
ঢাকা, বিষ্ণুপুর ও কলকাতা। কিন্তু এসকল অঞ্চলের ভিতরে পারস্পরিক আদান-প্রদান ছিল
না। কলকাতার বহু আগে থেকে ঢাকা দীর্ঘদিন প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। ঢাকার রাজদরবারে
সঙ্গীতচর্চার সূত্রে সেতার চর্চা শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকে। তবে ঢাকার আদি
সেতারবাদকদের ভিতর কোনো মুসলমান ওস্তাদের নাম পাওয়া যায় না। ঢাকার প্রথম সেতার
বাদকের নাম পাওয়া যায় হরিচরণ দাস। তিনি দরবারের সেতারবাদক ছিলেন না। ঢাকার কাছাকাছি
কোনো এক স্থানে তিনি বাস করতেন। সম্ভবত স্ব-উদ্যোগে তিনি কোনো গুরুর কাছে শিক্ষা
গ্রহণ করেছিলেন। নবাব কোনোভাবে তাঁর সেতার বাদনের কথা জানতে পেরে দরবারে আমন্ত্রণ
করেছিলেন। নবাবের দরবারে বাজানো সূত্রে, ঢাকার সঙ্গীত জগতে তিনি মর্যাদার আসন
পেয়েছিলেন।
হরিচরণ দাসের পুত্র চৈতন্য দাস পিতার কাছেই সেতারে তালিম নেন। তিনি ঢাকাতেই তাঁর
সঙ্গীতজীবন অতিবাহিত করেন। এই সময় গুরুদাস সেনরায় (১৮১৩- ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) নামক
একজন সেতারীর নাম পাওয়া যায়। গুরুদাসের গুরুর নাম ছিল 'পাগলা হিঙ্গু'। ধারণা করা
হয়, পাগলা হিঙ্গু হরিচরণ দাসের সমসাময়িক ছিলেন।
চৈতন্য দাসের পুত্র ভগবান দাস (১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রথম জীবনে সেতার বাদনের পৈত্রিক
ধারাকে অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু পরে অন্যান্য কলাবতদের কাছে সেতার শিখেছিলেন। ফলে
তাঁর বাদনে একটি মিশ্রধারার সৃষ্টি হয়েছিল। সেকালে ঢাকা এবং কলকতায় সেতার বাদক
হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।
ঢাকার সেতার চর্চার কিছু
পরে কলকাতার সেতারিদের নাম পাওয়া যায়। কলকাতায় সেতার বাদকদের মধ্যে প্রথম নাম পাওয়া
যায় আশুতোষ দেব বা সাতুবাবু (১৮০৫-১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ)। আশুতোষের পিতা রামদুলাল সরকার
(১৭৫২-১৮২৫) প্রখ্যাত ছিলেন ধনী ব্যাক্তি হিসেবে। তাঁর দুই পুত্র আশুতোষ (সাতুবাবু)
এবং প্রমথনাথ (লাটুবাবু) বিখ্যাত হয়েছিলেন বিলাসিতার জন্য। এঁদের পিতার আমলে,
তাঁদের বাসভবনে সঙ্গীতসভার আয়োজন হতো। সে সভায় নানাধরনের সঙ্গীতগুণীরা অংশগ্রহণ
করতেন। পরবর্তী সময়ে সাতুবাবু এই সভা নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে গেছেন। এইসব গুণীদের
বাজনা শুনে এবং তাঁদের কাছে তালিম নিয়ে তিনি সেতারবাদক হয়ে উঠেন। যতদূর জানা যায়,
প্রখ্যাত সেতারবাদক রেজা খাঁ সাতুবাবুর দরবারে দীর্ঘদিন ছিলেন। তিনি রেজা খাঁর কাছে
নাড়া বেঁধে সেতার শিখেছিলেন। পরে তিনি সেতারবাদক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
উল্লেখ্য সাতুবাবুর গুরু রেজা খাঁ এবং রেজাখানি বাজের প্রবর্তক রেজা খাঁ একই
ব্যক্তি নন। কারণ রেজাখানি বাজের প্রবর্তক রেজা খাঁ অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের জীবিত
ছিলেন। আশুতোষ বাবু তথা সাতুবাবুর ভাগ্নে অতুল চাঁদ ছিলেন
তাঁর শিষ্য। কলকাতায় সাতুবাবুর মতই তিনি সেতার বাদনে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
অতুলবাবুর সেতারে প্রথমে হাতেখড়ি হয় সাতুবাবুর কাছে, পরে তিনি রেজা খাঁ'র কাছে
শেখেন। এরপর কলকাতায় সেতারের চর্চা চালু হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্য কেউ সাতুবাবু
এবং অতুলচাঁদের জায়গা দখল করতে পারেন নি।
কলকাতার পরে বিষ্ণুপুরের সেতার চর্চার কথা
জানা যায়।
সূত্র :
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত
রায়চৌধুরী। কথাশিল্প প্রকাশ। বৈশাখ ১৩৭২।
http://yellowbellmusic.com/instruments/string/history_sitar.php