অর্ফিয়ুস
পশুপাখিরা মোহিত হয়ে অর্ফিয়ুসের গান শুনছে। এথেন্সের বাইজেন্টিয়ান এবং খ্রিষ্টান যাদুঘর |
খ্রিষ্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের প্রধান গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসাবে ইনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ইনি বীণা আবিষ্কার এবং তা প্রচলন করেছিলেন। কথিত আছে, তাঁর সঙ্গীতের সুরে বন্য পশুরা সম্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে যেতো। কখনো কখনো সম্মোহিত পশুরা তাঁকে অনুসরণ করতো। পাথরগুলো নৃত্য করতো এবং নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতো। থ্রেসের পাহাড়ের প্রাচীন ওক গাছগুলো নৃত্যভঙ্গিতে বেড়ে ওঠার কারণ হিসাবে অর্ফিয়ুসের বীণার সুর বা তাঁর গানকে ধরা হয়ে থাকে। কোনো কোনো মতে তিনি মানুষকে চিকিৎসায় ব্যবহাত বহু ঔষধের সন্ধান দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি মানুষকে লিখা ও কৃষিবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মীয় আচরণ অনুসরণ করে চলতেন। এছাড়া জ্যোতিষবিদ্যা ও যাদু-কৌশলের চর্চা করতেন নিয়মিত।
অধিকাংশ সূত্র মতে থ্রেসের রাজা
ওয়েগ্রাস ঔরসে
ক্যালায়োপি'র
(জনৈকা মিউজ, বীরোচিত কবিতা ও মহাকাব্যের দেবী) গর্ভে অর্ফিয়ুস জন্মগ্রহণ
করেছিলেন। মতান্তরে-
এ্যাপোলো'র ঔরসে ক্যালিয়োপির গর্ভে অর্ফিয়ুস ও
লিনাস-এর জন্ম হয়েছিল।
ক্যালায়োপি
উভয় সন্তানকে লিভিথ্রার এলিকটন পর্বতে প্রসব করেছিলেন।
অর্ফিয়ুস তাঁর মা ক্যালায়োপি'র কাছ থেকে কাব্য ও
সঙ্গীত উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গীতের প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছিলেন
এ্যাপোলো। কোনো কোনো মতে- লিনস অর্ফিয়ুসকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন
এবং সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য
এ্যাপোলো তাঁকে নিজের বীণা উপহার দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য
হের্মেজ
কচ্ছপের খোল থেকে এই বীণাটি তৈরি করে
এ্যাপোলোকে উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন।
জেসন যখন সোনার পশম উদ্ধারের অভিযানে যান, তখন কায়রন জেসনকে সাবধান করে দিয়ে
বলেছিলেন যে, অর্ফিয়ুস সাহায্য ছাড়া- সে সাইরনদের এড়িয়ে জাহাজ চালিয়ে নিতে পারবে
না। এই কারণে, জেসন অর্ফিয়ুসকে সাথে নেন।
অর্ফিয়ুস তাঁর সঙ্গীতের মাধ্যমে আর্গোনটদের (জেসনের জাহাজের অভিযাত্রীবৃন্দ) সকলের
মনোরঞ্জন করতেন। জেসন যখন জাহাজ নিয়ে সাইরনের এলাকায় এলেন, তখন সাইরনের যাদুকরী
সুরে আর্গোনটরা মোহিত হয়ে পড়েন। ফলে জেসন ইচ্ছার বিরুদ্ধে জাহাজ চালিয়ে সাইরনের
আস্তানার দিকে অগ্রসর হলেন। এই অবস্থায় অর্ফিয়ুস তাঁর বীণায় নূতন সুর তুলে সাইরনের
সুরের মোহ ভঙ্গ করে দেন। ফলে জেসন জাহাজ নিয়ে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে সমর্থ
হয়েছিলেন।
এই অভিযান শেষে ইনি ইউরিডিসি নামক এক নৃত্যরতা সুন্দরী পরী দেখে মুগ্ধ হন। পরে ইনি
ইউরিডিসিকে বিবাহ করেন। কিন্তু বিবাহের পর স্বল্প-কালের মধ্যে সাপের কামড়ে ইউরিডিসি
মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।
মত-১ : ওভিডের মতে- বিবাহ অনুষ্ঠানে ইউরিডিসি একজন জলপরীর (নেইরিড) এর সাথে যখন নৃত্য করছিলেন, তখন সাপের কামড়ে ইনি মারা যান।
মত-২ : বিবাহ অনুষ্ঠানের পর অর্ফিয়ুস এবং ইউরিডিসি একটি তৃণভূমির ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ভাইপার নামক সাপের কামড়ে ইনি মারা যান।
মত-৩ : বিবাহের কিছুদিন পর ইউরিডাইস পেনেয়াস নদীর তীরে ভ্রমণকালে আরিস্টেয়স নামক জনৈক ব্যাক্তির সাথে দেখা করতে যান। আরিস্টেয়াস জোর করে তাঁকে ভোগ করার চেষ্টা করে। এই সময় ভাইপার নামক সাপের গায়ে পা পড়লে, সাপটি তাঁকে দংশন করে। ফলে তাঁর মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার পর অর্ফিয়ুস পরম দুঃখে ভেঙে পড়েন। ইনি
সিদ্ধান্ত নেন যে- স্ত্রীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি মৃত্যুর দেবতা হেডিজ-এর
কাছে যাবেন। এরপর ইনি পাতালের নরকপুরীর উদ্দেশ্যে রওনা হন।
অর্ফিয়ুস নরকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে প্রথমে স্টাইক্স
(Styx)
নদীর তীরে এসে পৌঁছান। এই নদী হলো পৃথিবী ও
মৃত্যুজগতের মধ্যবর্তী সীমা। মৃত আত্মাদের নদী পার করার জন্য ক্যারন নামক এক মাঝি
নিযুক্ত ছিলেন। অর্ফিয়ুস তাঁর গান দিয়ে ক্যারনকে মুগ্ধ করে এই নদী পার হন। এরপর ইনি
উপস্থিত হন নরকের দ্বার প্রান্তে। ইনি তাঁর সঙ্গীত দিয়ে এই দ্বার খুলে ফেলতে সমর্থ
হন। এরপর ইনি নরকের কুকুর সার্বেরাসের
(Cerberus)
মুখোমুখি হন। সঙ্গীতের সাহায্যে এই কুকুরকেও ইনি মোহিত করেন এবং নরকের ভিতরে
প্রবেশ করতে সমর্থ হন। এরপর অর্ফিয়ুস বীণা বাজাতে বাজাতে
হেডিজ-এর সামনে আসেন। উল্লেখ্য এই পথে ইনি দেখতে পান- শাস্তিপ্রাপ্ত বিভিন্ন
নরকবাসীদের।
হেডিজ এবং তার পাশে বসে থাকা নরকের রানী পার্সিফোনি তাঁর গানে মুগ্ধ হলেন।
এরপর ইউরিডিসি প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হেডিজের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু
পার্সিফোনের পরামর্শে
হেডিজ
এর সাথে একটি শর্ত জুড়ে দেন। শর্তটি হলো―
অর্ফিয়ুসের পিছে পিছে ছায়ার মতো ইউরিডিসি অনুসরণ করবে। কিন্তু নরকের এলাকা অতিক্রম
করার আগে ইউরিডিসির সাথে কথা বলা যাবে না বা পিছন ফিরে ইউরিডিসির ছায়ার দিকে
তাকানো যাবে না।
এই শর্তে রাজি হয়ে―
অর্ফিয়ুস অন্ধকারের ভিতর পৃথিবীর দিকে রওনা হন। বহু কষ্ট করে অর্ফিয়ুস নরকের শেষ
প্রান্তে পৌঁছেন। কিন্তু এই সময় অর্ফিয়ুসের মনে সন্দেহ হয় যে, ইউরিডিসি তাঁর পিছে
পিছে যথার্থই এসেছে কিনা। পরীক্ষার জন্য অর্ফিয়ুস পিছন ফিরে তাকিয়ে- আবছাভাবে
ইউরিডিসিকে দেখতে পেলেন। কিন্তু তার পরে ইউরিডিসি মিলিয়ে গেলেন। শেষবারের মতো
ইউরিডিসি বিদায় বলে পুরোপুরি নরকে চলে গেলেন।
এরপর অর্ফিয়াস চরম হতাশায় ভেঙে পড়লেন এবং নিজের ভুলের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন।
এরপর ইনি নরকে থেকে যাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন জীবিত মানুষ নরকে থাকতে পারেন
না, তাই নরকরক্ষীরা তাঁকে বের করে দিলো।
অর্ফিয়ুসের মম্তক। চিত্রকর্ম। Gustave Moreau 1885 |
এরপর অর্ফিয়ুস ফিরে এসে গভীর দুঃখে কাল কাটাতে
লাগলেন। বীণা বাজানো ও গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে তিনি থ্রেসের নির্জন পার্বত্য এলাকায়
চলে গেলেন। এখানে তিনি সূর্যদেবতার আরাধান করে কাটাতে থাকেন। এসক্লাইলাসের হারিয়ে
যাওয়া নাটক Bassarids-এর
এক সারমর্মে বলা হয়েছে―
একবার অর্ফিয়ুস সকালের সূর্যকে পূজা করলে, (ডায়োনাইসস) অনুসারিণী থ্রেসিয়ান অপদেবী
মায়েনাড্স (Maenads
ডায়নিসাসের পূজারিণী অপদেবী) সম্মান না দেখানোর জন্য অর্ফিয়ুসের দেহের
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফেলেন। অভিডের মতে―
মীনাডস (Maenads)
নামক অপদেবী তাঁর সাথে সঙ্গীতে অংশ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলে, অর্ফিয়ুস তা
প্রত্যাখ্যান করেন। এর পর মীনাডস অর্ফিয়াসের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো
করে ফেলেন এবং নিকটস্থ হেবরস
(Hebrus) নদীতে অর্ফিয়ুসের মাথা ছুঁড়ে
ফেলে দিলেন। কথিত আছে, অর্ফিয়ুসের মাথা ও তাঁর বীণা এই নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বলে,
এই নদী সংলগ্ন এলাকায় অর্ফিয়ুসের গান শোনা যায়।
কথিত আছে, অর্ফিয়ুসের মাথা ঢেউ ও বাতাসের তাড়নায় লেসবিয়ান (লেসবিয়ান) সৈকতে
পৌঁছালে, সেখানকার অধিবাসীরা এঁর মাথাকে কবরস্থ করেন এবং এর উপরে একটি স্মৃতিসৌধ
(আন্টিসসা) নির্মাণ করেন। অন্যদিকে
মিউজরা
তাঁর বীণা স্বর্গে নিয়ে যান এবং নক্ষত্রমণ্ডলের ভিতরে তা স্থাপন করেন। এরপর
অর্ফিয়ুসের দেহ
অলিম্পাসের পাদদেশে কবর দেন। এরপর
এই কবরের উপর একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। কথিত আছে, এই স্মৃতিফলকের উপর প্রতিদিন
একটি নাইটেঙ্গল এসে গান গাইতো। এঁর আত্মা
হেডিজ-এর কাছে পৌছুলে,
হেডিজ
ইউরিডিসির সাথে মিলনের ব্যবস্থা করে দেন।
সূত্র :
http://www.paleothea.com/
greek myth/Robert Graves, cassel & comoany, fourth edition 1995
Mythology/Edith Hamilton/New American Library, 1969
http://www.pantheon.org/areas/mythology/europe/greek/