হেরাক্লেজের
প্রথম অভিযান (নেমিয়ান সিংহ বধ)হেরাক্লেজ প্রথম অভিযান হলো- নেমিয়ান সিংহ (Nemean lion) হত্যা। হেরাক্লেজ শুধু মাত্র তীর-ধনুক সাথে নিয়ে, একা এই অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। নেমিয়া নামক অরণ্যে প্রবেশের পর, প্রথমে ইনি শিকড়সহ একটি অলিভ গাছ উপড়ে নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ইনি এই সিংহের মুখোমুখি হলেন। সিংহটি গর্জন করতে করতে হেরাক্লেজের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে, ইনি প্রথমে তীর নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু সিংহের শক্ত চামড়ায় তা প্রতিহত হয়ে পড়ে গেল। এরপর ইনি হাতের অলিভ গাছের আঘাতে সিংহটির মাজা ভেঙে দিলেন। ফলে সিংহটি লাফানো বন্ধ করলো। এরপর ইনি তাঁর হাতের সকল অস্ত্র ফেলে দিয়ে খালি হাতে সিংহের গলা টিপে ধরে হত্যা করলেন এবং সিংহের মুণ্ডু ছিঁড়ে নিলেন। তারপর সিংহের মুণ্ডুটি তাঁর মাথায় বসিয়ে এবং সিংহের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের গায়ে চাপিয়ে দেশে ফিরে এলেন।
হেরাক্লেজের দ্বিতীয় অভিযান ছিল- লার্নার জলাভূমির হায়ড্রা (Lernaean Hydra) বধ। এই হায়ড্রার ছিল নয়টি মাথা। এর প্রতিটি মুখ থেকে বেরিয়ে আসত আগুনের স্ফুলিঙ্গ, বিষাক্ত নিঃশ্বাস ও লালা। এই হায়ড্রার মাথা সাধারণ অস্ত্র দ্বারা কাটা যেতো না। আর তেমন কোনো অস্ত্রের সাহায্যে কাটলেও মুহূর্তের মধ্যে ক্ষতস্থান থেকে দুটি করে মাথা গজিয়ে উঠতো। হায়ড্রা কখনো লার্নার জলাভূমিতে, কখনো বা জলাভূমি সংলগ্ন পাহাড়ের গুহায় থাকতো। হায়ড্রা হত্যার সময় হেরাক্লেজ ব্যবহার করেছিল এথেনার দেওয়া একটি দুশ্ছেদ্য বর্ম, দেবতা হার্মিসের দেওয়া অপ্রতিরোধ্য তরবারী, আর জিয়াসের অনুরোধে হেফ্যাস্টাস-এর তৈরি অসংখ্য সুতীক্ষ্ম তীর।
এবারের অভিযানে ইনি তাঁর ভাইপো আওলাউসকে সাথে নিলেন। লার্না পথ ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ ও দুর্গম। সে কারণে দ্রুত লার্নায় পৌঁছার জন্য ইনি একটি রথ সংগ্রহ করলেন। অবিলম্বে ইনি অরণ্যাচ্ছাদিত লার্নার পাহাড়ে পৌঁছে জলাভূমি খুঁজে বের করলেন। ইনি তাঁর ভাইপোকে রথে বসিয়ে রেখে একাকী তীর-ধনুক নিয়ে হায়ড্রার গুহা আবিস্কার করলেন। এরপর এই গুহা লক্ষ্য করে ইনি জ্বলন্ত তীর নিক্ষেপ করলেন। হাইড্রা তখন এই গুহায় অবস্থান করছিল। হেরাক্লেজের এই জ্বলন্ত তীরটি সরাসরি হাইড্রাকে আঘাত করলে, হাইড্রা গুহা থেকে দ্রুত বের হয়ে হেরাক্লেজের দিকে ধাবিত হয়। দ্রুত আক্রমণে ইনি হায়ড্রার মাথাগুলি কেটে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দুটি করে মাথা গজিয়ে উঠতে লাগলো। একসময় হায়ড্রা তার দেহ দিয়ে হেরাক্লেজকে পাক দিয়ে ধরলো। হার্কিলিউস হায়ড্রার কুণ্ডলি থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর ভাইপো আওলাউসকে ডাকলেন। হেরাক্লেজের নির্দেশে আওলাউস একটি মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে এলেন। এবার হেরাক্লেজ নূতন করে হাইড্রার মাথা কাট শুরু করলেন। এবার মাথা কাটার সাথে সাথে, আওলাউস দ্রুত হায়ড্রার ক্ষতস্থান মুছে ফেলতে লাগলেন। ফলে সেখান থেকে নূতন মাথা গজাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত হায়ড্রার প্রধান মাথাটি রয়ে গেল। কারণ কোনো অস্ত্র দ্বারা এই মাথা কাটা সম্ভব হলো না। ফলে ইনি একটি গদা বেছে নিলেন, সেই গদার আঘাতে হায়ড্রার এই প্রধান মাথাটি গুঁড়ো করে ফেললেন। এরপর এই ভাঙা মাথাটিকে মাটিতে পুঁতে ফেললেন। ফেরার সময় ইনি হায়ড্রার বিষাক্ত রক্তে তাঁর সকল অস্ত্র চুবিয়ে নিলেন।
হেরাক্লেজের তৃতীয় অভিযান ছিল- সেরিনেইয়ান নামক এক অদ্ভুত হরিণ হত্যা না করে ধরে আনা। সেরিনেইয়ান নামক এই হরিণের খুর ছিল হলুদবর্ণের এক প্রকার ধাতুর তৈরি। আর্কেডিয়ার পার্বত্য অরণ্যে এই হরিণ বিচরণ করতো। দেবী আর্তেমিসের আশীর্বাদধন্য এই হরিণকে কেউ হত্যা করতে পারতো না।
এই অভিযান সফল করতে হেরাক্লেজের দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ইনি এই হরিণের সন্ধানে এক বছর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালেন। এরপর ইনি গ্রিস ছেড়ে থ্রেসে এলেন। সেখানে না পেয়ে ইনি উত্তরাঞ্চলের গভীর বনে গেলেন। এই বনেরই এক জায়গায় ইনি হরিণটির সন্ধান পেলেন। প্রথমেই ইনি দূর থেকে তীর মেরে হরিণের একটি পা খোঁড়া করে দিলেন। এরপর তাড়া করে হরিণটি ধরে কাঁধে ফেলে রওনা দিলেন। পথে দেবী আর্তেমিস এই কাজের জন্য হেরাক্লেজের মুখোমুখি হলেন। কিন্তু হেরাক্লেজ বাকচাতুর্য্যে দেবীকে সন্তুষ্ট করে হরিণ নিয়ে ফিরে এলেন।
হেরাক্লেজের চতুর্থ অভিযান ছিল- একটি ভয়াবহ বন্য শুকর ধরা। এই ভয়ঙ্কর শুকরটি এ্যাট্রিকা থেকে এলিস পর্যন্ত ইউরিম্যানথিয়ার বিস্তৃত বিশাল পাবর্ত্য অঞ্চল জুড়ে বহু মানুষ ও জীবকে হত্যা করেছিল। বন্য শুকরটি ইউরিম্যানথিয়ারের শুকর নামে পরিচিত ছিল।
এই অভিযানে ইনি একাই অগ্রসর হয়েছিলেন। পথে ইনি সেন্টর রাজ্যের ফোলাস নামক সেন্টরের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। ফোলাস তাঁকে প্রচুর খাবার দ্বারা আপ্যায়িত করলেও এক ফোঁটা মদ দিলেন না। বিষয়টি হেরাক্লেজকে বিস্মিত করলো। এক সময় ইনি ফোলাসকে এর কারণ জিজ্ঞাস করলে- ফোলাস জানালেন যে, ঘরে এক পিপে মদ আছে এবং তা সমস্ত সেন্টরদের জন্য দান করেছেন ডাওনিসাস। তাই সমস্ত সেন্টর একত্র না হলে ইনি এই পিপে খুলতে পারবেন না। হেরাক্লেজ এই কথা অগ্রাহ্য করে ফোলাসকে মদের পিপে খুলতে বাধ্য করলেন। পিপে খোলার সাথে সাথে মদের তীব্রগন্ধযুক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সমস্ত সেন্টররা পিপে খোলার বিষয় অবগত হয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফোলাসের বাড়ি আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তখন হেরাক্লেজ তীর নিক্ষেপ করে করে সেন্টরদের হত্যা করতে লাগলেন। যুদ্ধে হেরে গিয়ে সেন্টরা তাদের প্রবীন নেতা শেরিয়নকে বললেন এবং তাঁর গুহায় আশ্রয় নিলেন। উল্লেখ্য শেরিয়ন ছিলেন হেরাক্লেজের ভূতপূর্ব শিক্ষক। হার্কিলিউস তাঁর এই শিক্ষককে চিনতে না পেরে- হায়ড্রার রক্তমাখা তীর শেরিয়নে গুহায় নিক্ষেপ করলেন। ফলে তীরের আঘাতে শেরিয়ন মৃত্যুবরণ করেন। এই যুদ্ধের সময় অসর্তকতাবশত একটি তীর ফোলাসের পায়ে লাগে। ফলে ফোলাসের মৃত্যু ঘটে। যুদ্ধের পরে শেরিয়ন ও ফোলাসের জন্য অশেষ দুঃখ প্রকাশ করে তাঁদের শেষকৃত্য করলেন।
সেন্টরদের রাজত্ব পেরিয়ে ইউরিম্যানথিয়ায় এসে পৌঁছুলেন। এখানকার এক বনে হেরাক্লেজ শুকরটিকে দেখার সাথে সাথে তাড়া করা শুরু করলেন। বন ছেড়ে এই শুকর অনাবৃত মাঠ ও বরফ ঢাকা প্রান্তরে দৌড় শুরু করলো। অনবরত তাড়া খেতে খেতে এই শুকরটি একসময় ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লো। এরপর হেরাক্লেজ শুকরটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফিরে এলেন।
হেরাক্লিজের পঞ্চম অভিযান ছিল, ঈলিস রাজ্যের রাজার আস্তাবল পরিষ্কার করা। উল্লেখ্য, অজিয়েসের নেশা ছিল পশুপালন। তাঁর আস্তাবলে মোট পশুর সংখ্যা ছিল তিন হাজার। ৩০ বৎসর ধরে সেই আস্তাবলে জমা হয়েছিল পশুর যাবতীয় ময়লা। ফলে পুরো আস্তাবল হয়ে উঠেছিল একটি ময়লার পাহাড়ের মতো। হেরাক্লিজের পঞ্চম পরীক্ষায়- রাজা ইউরিসথেউস তাঁকে অজিয়েসের এই গো-শালা একদিনের মধ্যে পরিষ্কার করা ভার দেন।
এই অভিযানে বেরিয়ে হেরাক্লেজ প্রথমে রাজা অজিয়েসের কাছে গিয়ে একদিনে এই আস্তাবল পরিষ্কারের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা শুনে- রাজা এই কাজ অসম্ভব জ্ঞান করে হেরাক্লেজকে জানালেন যে, সে যদি একদিনের ভিতর এই কাজ শেষ করতে পারে, তবে রাজা তাঁকে তাঁর পশুর এক দশমাংশ দান করবেন।
হেরাক্লেজ রাজবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পেনেউস ও আলফিয়স নামক দুটি নদীর স্রোতকে গোপন সুরঙ্গ দ্বারা আস্তাবলে নিয়ে এসে, আস্তাবলের মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত করলেন। ফলে, একদিনের মধ্যেই সমস্ত আস্তাবল সাফ হয়ে গেল। এই কাজের শেষে, হেরাক্লেজ রাজার কাছে পুরস্কার দাবি করলে, রাজা তা দিতে অস্বীকার করলেন। এরপর হেরাক্লেজ রাজপুত্র ফাইলেউসকে সাক্ষী মানলেন। রাজা তবুও অস্বীকার করলেন এবং হেরাক্লিজের সাথে তাঁর পুত্রকেও রাজ্য থেকে বিতারিত করলেন। অন্যমতে পুরস্কারের দাবি অস্বীকার করার কারণে, হেরাক্লেজ অজিয়েসকে হত্যা করে, রাজপুত্র ফাইলেউসকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।
হেরাক্লেজের ষষ্ঠ অভিযান ছিল- স্টিমফ্যালাইদেস নামক পাখি গ্রিস থেকে তাড়ানো। এই শিকারী পাখিগুলির গায়ে ছিল তীরের মতো কাঁটাওয়ালা পালক। গ্রিক সমুদ্র উপকুলে এই পাখিগুলি দল বেঁধে বসবাস করতো এবং জাহাজীদের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করতো। এদের মূল বাসস্থান ছিল আর্কেডিয়ার স্টিমফ্যালিস হ্রদে। এই হ্রদের নামানুসারে পাখিগুলির নামকরণ হয়েছিল স্টিমফ্যালাইদেস।
হেরাক্লেজ এই পাখিগুলির অনুসন্ধান করতে করতে স্টিমফ্যালিস হ্রদের কাছে এলেন। এই পাখিগুলির গায়ের রঙ ছিল কালো। অজস্র পাখি দ্বারা এই হ্রদ পূর্ণ ছিল বলে, পুরো হ্রদটি কালো বর্ণ ধারণ করেছিল। এই বিশাল সংখ্যক পাখিকে কি ভাবে তাড়াবেন এই বিষয় নিয়ে যখন ভাবছিলেন, তখন দেবী এথেনা তাঁকে হেফ্যাস্টাস-নির্মিত একজোড়া করতাল প্রদান করলেন। হেরাক্লেজ এই করতাল বাজাতেই সমস্ত অঞ্চল করতালের শব্দে নিনাদিত হতে থাকলো। হেরাক্লেজ একটি উঁচু পর্বতে উঠে অনবরত এই করতাল বাজাতে থাকলেন, ফলে অতীষ্ট হয়ে পাখিগুলি আকাশে উড়তে শুরু করলো। এরপর হেরাক্লেজ বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে করে পাখিগুলি হত্যা করতে লাগলেন। বহু পাখির তীরের আঘাতে নীচে লুটিয়ে পড়লো। বাকি পাখিগুলি প্রাণভয়ে গ্রিস ছেড়ে চিরকালের মত চলে গেল।
হেরাক্লেজের সপ্তম অভিযান ছিল- ক্রিট-এর কুখ্যাত একটি ষাঁড় ধরে আনা। এই ষাঁড়টি সারা ক্রিট অঞ্চল ঘুরে বেড়াতো এবং সারা দেশ জুড়ে ধ্বংসলীলা চালাতো। হেরাক্লেজ প্রথমেই ক্রিটের রাজার কাছে এই কাজের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাজা হেরাক্লেজের এই প্রস্তাবে এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলেন।
এবার হেরাক্লেজ এই পাগলা ষাঁড়টির সন্ধানে বের হলেন। এক সময় ইনি ষাঁড়টির সন্ধান পেয়ে তার কাছে যেতেই ষাঁড়টি তার সুতীক্ষ্ণ শিং বাকিয়ে হেরাক্লেজকে আক্রমণ করলো। হেরাক্লেজ দুই হাতে ষাঁড়ের শিং দুটি ধরে অবিলম্বে কাবু করে ফেললেন। এরপর ইনি উক্ত ষাঁড়ের পিঠে চড়ে দেশে ফিরে এলেন। ইউরিস্থেয়ুস ষাঁড়টি ছেড়ে দিতেই, ষাঁড়টি আবার সারাদেশে অত্যাচার শুরু করলো। সারা গ্রিসে এই ষাঁড়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে, হেরাক্লেজ এক ম্যারাথন অনুষ্ঠানে এই ষাঁড়টিকে হত্যা করেন।
হেরাক্লেজের অষ্টম অভিযান ছিল- থ্রেসিয়ের রাজা ডাওমিডাসের হিংস্র ঘোটকীগুলোর বশীভূত করে ধরে আনা। উল্লেখ্য ডাওমিডাস নিজে নরমাংস খেতেন এবং তাঁর ঘোটকীগুলোকে নরমাংস খাইয়ে সেগুলিকে হিংস্র ও দুর্ধর্ষ করে তুলেছিলেন। এই অভিযানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবদেরাস।
হেরাক্লেজ ডাওমিডসের দেশে গিয়ে প্রথমেই ডাওমিডসকে পরাজিত করে বন্দী করলেন। তারপর তাকে একটি কারাগারে রাখলেন। কিন্তু তার ঘোটকীগুলো বশীভূত হলো না, বরং আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠলো। হেরাক্লেজ এবার কয়েকটি হত্যা করলেন। এরপর উক্ত ঘোটকীগুলোর মাংস জোর করে ডাওমিডসকে খাওয়ালেন। এরপর ইনি ডাওমিডসকে হত্যা করে তার মাংস ঘোটকীদের খাওয়ালেন। মালিকের মৃত্যুর পর, ঘোটকীগুলো বশীভূত হলো।
ঘোটকীগুলো নিয়ে হেরাক্লেজ অগ্রসর হয়ে কিছু দূর আসার পর, থ্রেসীয়বাসীরা পিছন থেকে আক্রমণ করলো। এবং এই আক্রমণের সাথে সাথে ঘোটকীগুলো আবার হিংস্র হয়ে উঠলো। হেরাক্লেজ যখন থ্রেসীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যস্ত তখন, ঘোটকীগুলো তাঁর সঙ্গী আবদেরাসকে হত্যা করলো। ইতিমধ্যে হেরাক্লেজ থ্রেসীয়দের পরাজিত করে, ফিরে এলে ঘোটকীগুলো আবার বশীভূত হয়ে যায়। এরপর ইউরিসথেউস তাঁকে নবম অভিযানে পাঠালেন।
হেরাক্লেজের নবম অভিযান ছিল- আমাজানের রানী হিপ্পোলাইটের সোনার কটিবন্ধনী করায়াত্ত। এই রানীর রাজত্ব করতোআমাজান অঞ্চলে। যে রাজ্যে ছিল বিশাল এক নারী বাহিনী। এঁরা পুরুষদের বন্দী করে রাখতো বা তাদের অধীনস্ত পুরুষদের সাহায্যে গর্ভবতী হতো। এই রাজ্যে কন্যা সন্তানদের সযত্নে প্রতিপালিত করা হতো এবং অধিকাংশ পুত্র সন্তানদের শৈশবে হত্যা করা হতো। এরা ছিল যুদ্ধে সুচতুর ও পারদর্শিনী। রাণী হিপ্পোলাইটেকে যুদ্ধ দেবতা এ্যারস একটি সোনার কটিবন্ধ উপহার দিয়েছিলেন। সেই কটিবন্ধ আনার জন্য হেরাক্লেজ অগ্রসর হলেন।
ইনি আমাজানে পৌঁছে প্রথমে নারীবাহিনীর মুখোমুখী হলেন। পরে এই নারী বাহিনী তাঁকে সরাসরি রানীর কাছে গিয়ে পৌঁছে দিল। হেরাক্লেজের অমিত শক্তিশালী দেহসৌন্দর্য ও সাহস দেখে রানী অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়লেন। রানী সরাসরি হেরাক্লেজের কাছে তাঁর এদেশে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হেরাক্লেজে তখন রানী কটিবন্ধ দাবি করলেন। উত্তরে রানী বললেন, যদি সে কটিবন্ধ না দেয় সে ক্ষেত্রে হেরাক্লেজ কি করবেন। উত্তরে হেরাক্লেজ জানালেন, যে সেক্ষেত্রে যুদ্ধ করে কটিবন্ধ অধিকার করবেন। রানী হেরাক্লেজের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে কটিবন্ধ দিতে অগ্রসর হলে, দেবী হেরা রানীর মন বিষিয়ে তুললেন। ফলে মুহূর্তে রানী মন পরিবর্তন করে হেরাক্লেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে। এরপর হেরাক্লেজের সাথে নারী বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হলো। যুদ্ধে নারীবাহিনী পরাজিত হলো এবং রানী হিপ্পোলাইটে নিহত হলেন। এরপর হেরাক্লেজ কটিবন্ধ নিয়ে গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
ফেরার পথে ইনি হেরাক্লেজ যখন ট্রয় নগরী অতিক্রম করছিলেন, তখন জানতে পারলেন যে, একটি দানব একটি সুন্দরী মেয়েকে তার থাবার নিচে ধরে রেখেছে। হেরাক্লেজ খবর নিয়ে জানলে এই কন্যাটি রাজা লাওমেডানের (Laomedon) কন্যাটি হেসিয়োনে (Hesione)। রাজা এক ঘোষণায় জানিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারবেন, তাঁর হাতে এই কন্যাকে সমর্পণ করবেন। হেরাক্লেজ উক্ত দানবকে আক্রমণ করে হত্যা করে কন্যাটিকে উদ্ধার করলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুসারে রাজা লাওমেডান তাঁর কন্যাকে হেরাক্লেজের হাতে সমর্পণ করলেন না। এরপর হেরাক্লেজ দশ বৎসর পরে এসে এর প্রতিশোধ নেবেন বলে উক্ত স্থান ত্যাগ করলেন।
হেরাক্লেজের নবম অভিযান ছিল- এরিথিয়া দ্বীপের একপাল লালরঙের গবাদি পশু আনয়ন। এই পশুগুলি ছিল উক্ত দ্বীপের গেরিয়োন নামক এক রাক্ষসের। রাক্ষস গেরিয়োনের পশুগুলি যখন মাঠে চরতো তখন ওর্থ্রুস নামে দুই মাথাওয়ালা একটি অদ্ভুত কুকুর তাদের পাহারা দিত। আর গেরিয়োন স্বয়ং ছিল আরও ভয়ঙ্কর। গেরিয়োনের ছিল তিনটি শরীর। এই শরীরগুলো যুক্ত ছিল কোমরের কাছে। এই তিনটি দেহের সাথে ছিল তিনটি মাথা। প্রতি দেহের সাথে ছিল দুটি করে হাত। অর্থাৎ মোট হাতের সংখ্যা ছিল ছয়টি। কোমরের কাছে তিনটি দেহ সংযুক্ত থাকলেও কোমরের নিচ থেকে বের হয়েছিল ছয়টি পা।
হেরাক্লেজ এই যাত্রায় বহু বন্যশুকর হত্যা করেছিলেন। টার্টেসাস-এ এসে তিনি পর্বত উৎপাটন করে দুটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এই স্তম্ভ দুটি হেরাক্লেজ-এর স্তম্ভ নামে পরিচিত। এ কাজটি করেছিলেন পথের বাধা দূর করে সহজে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য। অবশ্য এ নিয়ে মতানৈক্য আছে। এরপর ইনি প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ক্রমাগত চলতে লাগলেন। এই সময় সূর্য দেবতা হেলিয়াস (Helius) নিচে নেমে এসে তাঁর উপর তীব্র উত্তাপ বর্ষণ করতে থাকেন। ফলে এক সময় ক্রোধান্বিত হয়ে তিনি সূর্যের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করেন। হেলিয়াস এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। পরে হেরাক্লেজ হেলিয়াসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। হেলিয়াস হেরাক্লেজের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, জলপদ্মের আকারের একটি স্বর্ণ নির্মিত বাহন পাঠিয়ে দেন। এই বাহনে চড়ে তিনি এরিথিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু সাগর দেবতা ওসিনাস তীব্র ঢেউ উৎপন্ন করেন। এই কারণে হেরাক্লেজ তাঁকে আঘাত করার জন্য তীর নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিলে, ইনি ভয়ে সমুদ্রকে শান্ত করে দেন।
হেরাক্লেজ এ্যাবাস পর্বতের কাছে পৌঁছুলে, ওর্থ্রুস নামক পাহারাদার কুকুর তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। হেরাক্লেজ প্রথমে একটি আঘাতেই এই কুকুরকে হত্যা করেন। গেরিয়োনের পশুপালক ইউরিটিয়োন ওর্থ্রুসের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলে, হেরাক্লেজ তাকেও একইভাবে হত্যা করে। এরপর হেরাক্লেজ গবাদি পশুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে গ্রিসের দিকে রওনা দেন। এই সময় তিনি মেনোয়েটেস নামক অপর পশুপালককে হেরাক্লেজ আঘাত করলেন না। এই গবাদি পশু হরণের বিষয়টি গেরিয়োনকে জানানোর জন্য হেরাক্লেজ মেনোয়েটেসকে পাঠালেন। এরপর গেরিয়োন দ্রুত ঘটনাস্থলে এলে, হেরাক্লেজ গেরিয়োনের একপাশ দিয়ে তীর দ্বারা এত তীব্রভাবে আঘাত করেন যে, তিনটি দেহ ভেদ করে তিরটি বেরিয়ে যায়। কোনো কোনো মতে- হেরাক্লেজ তিনটি দেহকে আঘাত করার জন্য তিনটি তীর ব্যবহার করেছিলেন। গেরিয়োনের সাথে হেরাক্লেজের যুদ্ধ চলাকালে দেবী হেরা গেরিয়োনের পক্ষালম্বন করেছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হেরাক্লেজের একটি তীর হেরার বক্ষে আঘাত করে। ফলে হেরা যন্ত্রণায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। এরপর হেরাক্লেজ লাল পশুগুলিকে নিয়ে গ্রিসের পথে রওনা দিলেন।
হেরাক্লেজ পশুগুলোকে নিয়ে লিগুরিয়া অতিক্রম করার সময় পোসাইডেনের দুই পুত্র আয়ালেবিয়োন এবং ডের্কিনাস এই পশু চুরি করার চেষ্টা করলে, হেরাক্লেজ তাদেরকে হত্যা করেন। যখন ইতালির পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন, ক্যাকাস (cacus) নামক এক দৈত্য রাত্রিবেলায় পশুর পাল থেকে কয়েকটি পশু নিয়ে তার গুহায় লুকিয়ে রাখে। সকালে উঠে হেরাক্লেজ কয়েকটি পশু না দেখতে পেয়ে কিছুটা খোঁজাখুজি করলেন। কিন্তু পশু হারানোর কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে ইনি আবার যাত্রা শুরু করলেন। হেরাক্লেজের যাত্রাপথে একজায়গায় তার হারানো পশুর আর্তনাদ শুনে ক্যাকাসের গুহার সন্ধান পান। এরপর ক্যাকাসের গুহা আক্রমণ করলে, ক্যাকাস তার গুহা থেকে বেড়িয়ে এসে- হেরাক্লেজকে আক্রমণ করে। যুদ্ধে ক্যাককাস নিহত হওয়ার পর রাজা এভ্যান্ডারের সহায়তায় জিউসের একটি বেদী তৈরি করেন। এবং উদ্ধারকৃত কিছু পশু এই বেদীতে উৎসর্গ করেন। এরপর বাকি পশুগুলো নিয়ে গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর দেবী হেরা কিছু মাছি পাঠিয়ে দিলেন। মাছির উৎপাতে পশুগুলি দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল। একসময় হেরাক্লেজের হাতের ঝাপটায় সকল মাছি পালিয়ে গেলে ইনি আবার পশুগুলিকে একত্রিত করে অগ্রসর হলেন। এরপর হেরা একটি উদ্দাম জলস্রোতকে হেরাক্লেজের পথে প্রবাহিত করে দিলেন। এবার হেরাক্লেজ বড় বড় পাথর এনে উক্ত জলস্রোতের উপর সেতু নির্মাণ করে পশুগুলোকে নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথে স্কাইথিয়ার গভীর অরণ্যে এসে ইনি তাঁর সকল পশুগুলোকে হারিয়ে ফেললেন। উক্ত অরণ্যে পশুর সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একটি অদ্ভুত দানবীর দেখা পান। এই দানবীর উধ্বাংশ ছিল নারী আর নিম্নাংশ ছিল সাপ। এই দানবীকে হেরাক্লেজ তাকে হত্যা করেন। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে ইনি পশুগুলোকে আবার একত্রিত করলেন।
হেরাক্লেজ যখন স্ট্রাইমোন নদী অতিক্রম করার উদ্যোগ নিলেন, তখন এ্যাল্কিয়িনেয়াস (Alcyoneus) নামক দানব হেরাক্লেজের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। এ্যাল্কিয়িনেয়াস বিশালাকার শৈলখণ্ড নিক্ষেপ করে হেরাক্লেজের অনুসারী সৈন্যবাহিনীর ১২টি রথ, ২৪ জন অশ্বারোহীকে হত্যা করে। এরপর হেরাক্লেজ পাল্টা একটি শৈলখণ্ড দ্বারা আঘাত করলে, এ্যাল্কিয়িনেয়াস সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। এ্যাল্কিয়িনেয়াস তার জন্মভূমিতে অমর ছিল বলে, এই আঘাতে মৃত্যুবরণ না করায়, হেরাক্লেজ তাকে টেনে জন্মভূমির বাইরে এনে হত্যা করেছিল। এরপর ইনি বাকি পশুগুলোকে নিয়ে গ্রিসে পৌঁছাতে সক্ষম হলেন।