সুন্দর ও সৌন্দর্য
ইংরেজি :
beautiful
and beauty
সুন্দর শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো সু-Öউন্দ্
(আর্দ্র হওয়া) +অর্।
সুন্দর শব্দের ব্যাখ্যা এই বিশ্লেষণের ভিতরেই পাওয়া যায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে অনুভূতি মনকে দ্রবীভূত বা আর্দ্র করে এবং একই সাথে
আনন্দ দান করে বা যে আনন্দ মনকে দ্রবীভূত বা আর্দ্র করে তাই সুন্দর। সুন্দর মূলত যে
কোনো সত্তার বাহ্যিকগুণ অর্থ যে গুণ বাইরে প্রকাশিত হয়। মূর্ত বা বিমূর্ত সকল
সত্তার জন্যই এটা প্রযোজ্য। একটি ফুলকে সুন্দর বলা হয় এর বাহ্যিকগুণকে। আবার যখন
বলা হয় একটি 'সুন্দর মন'। অর্থাৎ যখন মনের একটি সমন্বিত রূপ কারো কাছে প্রকাশ পায়,
তা অনুভব করেই বলা হয় সুন্দর মন। অপ্রকাশিত গুণ সুন্দর বা অসুন্দর কোনটিই নয়।
স্বস্তি-অস্বস্তি'র সূত্রে মানুষের মনের দশার পরিবর্তিন ঘটে। এর ভিতরে স্বস্তির ক্রমবর্ধমান কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় সুখবোধ। সুখানুভূতি চলমান একটি প্রক্রিয়া। যতখন এটি ক্রিয়াশীল থাকে ততক্ষণ মানুষ মন, এর দ্বারা আবেশিত হয় এবং মনের ভিতর ব্যাপ্তি লাভ করে। এই ছড়িয়ে পড়া সুখবোধই হলো আনন্দ। আর বহুবিধ আনন্দের সুসমন্বিত বোধই হলো সৌন্দর্য। বলাই বাহুল্য, একটি কার্যক্রম যখন এককভাবে কোনো আনন্দ তৈরি করে, তখন তা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে না। সে বিচারে আনন্দ হলো কোনো সুন্দরের অংশ আর আর সুন্দরের সামগ্রিক রূপ হলো সৌন্দর্য।
যাকে সুন্দর বলা হয়, তার ভিতরে এমন কোনো গুণ থাকে যা মনকে মুগ্ধ করে এবং এর দ্বারা 'আমি' আনন্দ লাভ করতে থেকে। কিন্তু একটি আনন্দের মধ্য দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ ঘটে না। সমন্বিত বহুবিধ আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষের মনে যে আনন্দময় প্রবাহের সৃষ্টি হয়, তার সমন্বিত অনুভূতিই হলো সুন্দর। মানুষের সৌন্দর্যবোধ সুন্দরকে অনুভব করতে পারে। সুতরাং কোনো সত্তাকে সুন্দর কি অসুন্দর হবে তা নির্ভর করবে কোনো ব্যক্তির সৌন্দর্য বোধের উপর। কোনো ব্যক্তি বিশেষ একটি অসাধারণ রাগ সঙ্গীত শোনার পর, বিবমিষা ভাব নিয়ে উঠে যেতে পারেন। আবার অন্য একজন ওই রাগটি দ্বিতীয়বার শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতে পারেন।
কোনো বিষয়বস্তুর ধর্ম এবং মানুষের সৌন্দর্যবোধের সমন্বয়ে মানুষের 'আমি' নামক সত্তা যা অনুভব করে, তাকে সৌন্দর্য বলা যায়। সাধারণভাবে আমরা যাকে সৌন্দর্য বলি, তার সাথে মস্তিষ্কের যান্ত্রিক ফলাফল এবং 'আমি' নামক সত্তার একটি নিবিড় যোগ রয়েছে। নন্দনতত্ত্বে মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় ব্যক্তি বিশেষের মানসিক প্রশান্তির। বলাই বাহুল্য, মানুষের মস্তিষ্ক এবং মন দুইই বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং একই সূত্রে মানুষের সৌন্দর্যবোধও বিবর্তনের ফল। এর ভিতরে দৈবত্ব যদি কিছু থাকে, তা হলো পুরো মানুষ সৃষ্টির কার্যক্রম। মানুষ নিসর্গের, মানুষের কল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গ, আর সেই সূত্রেই সৌন্দর্যবোধ স্বর্গীয়। মানুষ সৌন্দর্য দ্বারা আবেগাপ্লুত হয় তার সহজাত সৌন্দর্যবোধ থেকে, সেখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে না। আবার এই মানুষই যা অনুভব করে, তার গুপ্তরহস্য জানার চেষ্টা করে, ফলে এক সময় না এক সময় সে আবেগের মোহ থেকে বেড়িয়ে এসে সৌন্দর্যের কাটাছেঁড়া করে। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সৌন্দর্যের মৃত্যু ঘটে কিন্তু সৌন্দর্যবোধ ও তার সৃষ্টির পথ খুলে যায়।
ধরা যাক, একটি ফুলের চমৎকার রঙ মনের ভিতর আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করে। কিন্তু ফুলটির দোমাড়ানো হলে, তা আনন্দ দান করে না। উভয় অনুভূতির সমন্বয়ে কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে না। একটি সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে গান আনন্দ দান করছে, কিন্তু সহযোগী যন্ত্রটি হয়তো ঠিক সুরে বাঁধা নেই। এই দুয়ে মিলে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে না। এমনকি কোনো সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের অধিকারী কোনো শিল্পীর গান পরিবেশনের সময় কোনো একটি জায়গায় বেসুরো বা ভুল স্বর প্রয়োগ করলেও সৌন্দর্য নষ্ট হবে। মূলত শিল্পী চেষ্টা করেন তাঁর উপস্থাপিত বিষয়ের বিষয়ে অসংখ্য আনন্দের সমন্বিত রূপ মূর্তমান করে তোলার। বিমূর্ত বা দৈহিক সত্তা রয়েছে এমন সকল অবদানের ভিতরে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা বিমূর্ত। আর এই বিমূর্ত আনন্দসমূহকে সমন্বিত হয়ে মনের ভিতর যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, বিমূর্ত অবয়ব নিয়ে বিমূর্ত-মূর্তি তৈরি করে। শিল্পীর সাধনা সেই বিমূর্ত-মূর্তির সাধনা।
প্রতিটি একক আনন্দের একটি তরঙ্গ আছে এবং তা একবার চূড়ায় উঠে ধীরে ধীরে তার অগ্রমুখ নিম্নগামী হয়। কিন্তু একই সাথে যদি দুটি আনন্দ যদি 'আমি' উপভোগ করে, তখন আমি দুটি আনন্দই ভাগাভাগি করে ভোগ করবে। ফলে দুটি আনন্দের সূত্রে 'আমি' মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হবে। এরূপ একাধিক গতিময় আনন্দ একত্রে মিশ্রণে সৃষ্ট অনুভূতি 'আমি'র সানন্দ বা নিরানন্দ হতে পারে। ধরা যাক, একটি বাদ্যযন্ত্রের সাহয্যে একটি সুরের সৃষ্টি করা হলো। এর দ্বারা একজন শ্রোতার মনে আনন্দের সঞ্চার হলো। এবার প্রথম যন্ত্রটি থামিয়ে, অপর একটি যন্ত্রের সাহায্যে আরও একটি সুর বাজানো শুরু হলো। সেটিও শ্রোতার মনে আনন্দ সঞ্চার করলো। এবার দুটো যন্ত্র থেকে দুটি ধ্বনি একসাথে বাজানো শুরু হলো। এই দুটি স্বরের সমন্বয় শ্রোতাকে পৃথক আনন্দ দান করতে পারে আবার নিরানন্দও দান করতে পারে। যদি শ্রোতাকে মিশ্র স্বর আনন্দ দান করে, তবে দুটি আনন্দ তরঙ্গ একটি মিশ্র আন্তঃআনন্দধারায় আন্দোলিত করবে। এরই ফলে সৃষ্টি হবে সৌন্দর্য। পক্ষান্তরে মিশ্র সুরের প্রভাবে সৃষ্ট নিরানন্দ শ্রোতাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেবে এবং সৌন্দর্যের অপমৃত্যু হবে। সৌন্দর্যের জন্য সুসমন্বিত আনন্দসমূহের বিন্যাস। চিত্রশিল্পী রেখা এবং রঙের ভিতর দিয়ে মূলত অজস্র আনন্দের সমন্বয় সাধন করে থাকেন।
প্রায় সৌন্দর্যমণ্ডিত সুর |
সৌন্দর্যহীন সুর |
সৌন্দর্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকে আকর্ষণ বোধ। মানুষের এটি সহজাত স্বভাব। সৌন্দর্য মানুষকে আনন্দে উদ্বেলিত করে, কিম্বা বলা যায় উদ্বেলিত আনন্দের ভিতর দিয়ে মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করে। এই উপভোগের গভীরে রয়েছে স্বস্তিবোধ।
সৌন্দর্যের ক্রমবিকাশ
মানব শিশুর সৌন্দর্যবোধের জন্য যে যান্ত্রিক উপকরণ দরকার তা থাকে, কিন্তু
সৌন্দর্যবোধের ভাণ্ডার থাকে শূন্য। ভূমিষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে, মানবশিশু
তার ইন্দ্রিয় দ্বারা নানারকম তথ্য দিয়ে উপলব্ধি লাভ করে। আর এ সব উপলব্ধির দ্বারা
সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থেকে। ভূমিষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া মানবশিশুর দেহ সঙ্কুচিত হয়,
এর ফলে তার সারা দেহে তীব্র অস্বস্তির জন্মলাভ করে। একই সাথে মাতৃগর্ভের আরামদায়ক
উষ্ণতা থেকে প্রাকৃতিক উষ্ণতায় পৌঁছায়। এটিই তার জন্য আর একটি অস্বস্তিকর অনুভূতির
সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে তার কান্না করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। জন্মের পর
মানব শিশুর কান্নাটাই তার সুস্থ শরীরে জন্মলাভের শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জন্মের পর যে শিশু কাঁদে না, তাকে কাঁদিয়ে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চালানো হয়,
শিশুর জন্মটা মায়ের কাছে যেমন আনন্দের তেমনি, জন্মের পর শিশুর কান্নাটাও মায়ের কাছে
তেমনি আনন্দদায়ক।
শিশুর জন্মেমুহূর্তের এই স্মৃতি স্মৃতিভাণ্ডারে হয়তো থাকে, কিন্তু তা আর পরবর্তী সময় সে জাগ্রত করতে পারে না। শুধু সেই মুহূর্ত নয়, অনেক বড় হয়ে উঠা পর্যন্ত যত অভিজ্ঞতা লাভ করে, তার বেশিরভাগ অংশ শিশু স্মৃতিভাণ্ডার থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে না।
জন্মের পর, একসময় শিশু তার কান্না থামায়। পরমযত্নে পরিচর্যার ভিতর দিয়ে শিশুকে আস্বস্ত করা হয়, সে নিরাপদ। এই স্বস্তিবোধের ভিতর দিয়ে সে নিজেকে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত মানুষের এই প্রচেষ্টা সারাজীবন ধরেই চলে।
মানবশিশুর সৌন্দর্যবোধ জেগে উঠে দুটি মাধ্যমের সূত্রে। মাধ্যম দুটি হলো−
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য: প্রকৃতিকে বলা হয়, অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতির সন্তান
মানুষ। তাই এর সকল রূপ-রস-গন্ধ-শ্রতি-স্পর্শ-এর মধ্যে প্রবহমান আনন্দ ধারায়
অবিরত সৃষ্টি হয়ে চলেছে সৌন্দর্য। জগতের আনন্দযজ্ঞে 'আমি'র নিমন্ত্রণ। সে
যজ্ঞশালায় আমি আমন্ত্রিত আবার সেই সাথে আমার দৈহিক উপস্থাপনও আনন্দযজ্ঞের
উপাদান। আমি আছি বলেই এ আনন্দযজ্ঞ আরও পূর্ণ এবং আমি আছি বলেই এই আনন্দযজ্ঞ
সার্থক। এই যজ্ঞে আমি সৌন্দর্যের উপাদান এবং আমিই সৌন্দর্য-গ্রাহক।
প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করার উপযোগী হয়ে ওঠে শৈশব থেকে। কিছু বিষয়
মানবশিশুকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে। যে শিশু হামাগুড়ি দেওয়া শিখেছে, তার সামনে
একটি জ্বলন্ত প্রদীপ রাখলে, সে হাত বাড়িয়ে তার শিখা ধরার চেষ্টা করবে। কারণ সে
জানে না এর পরিণতি কি হতে পারে।
বড়রা তাকে থামায়। কিন্তু যদি না থামায়, তাহলে সে হাত দেবে এবং হাত পুড়িয়ে একটি
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লাভ করবে। এভাবে মানুষ অজস্র বিষয় শেখে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন
করে। ক্ষতিকারক বলে কোনো বিষয় থেকে নিজেকে বিরত করে বটে, কিন্তু মানুষ তাকে
সৌন্দর্যহীন বলে না। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সৌন্দর্য কিম্বা সুনামির বিশাল ঢেউই-এর
সৌন্দর্য মানুষকে একই সাথে আকর্ষণ করে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য মানুষ এদের থেকে
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করে। তার ছোটো উপকরণ আনন্দ
দেয় আর সম্মিলিতভাবে সৌন্দর্যবোধকে উজ্জীবিত করে। এর প্রধান কারণ বৈচিত্র্য।
খোলা আকাশ তখনই বেশি আনন্দ দেয়, যখন তাতে কিছু কিছু মেঘ থাকে। 'মেঘের ফাঁকে
আকাশ' আনন্দের দোলা তৈরি করে। সমুদ্র দেখতে দেখতে চোখ ধরে যায়, কিন্তু পাহাড়ের
সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি হয়ে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারায়।
বিবর্তনের ধারায় আমাদের চুল, চোখ কিংবা হাতের নখ বর্তমান দশায় পৌঁছেছে। এসব
দেখে আমরা অভ্যস্থ। এই সূত্রে আমাদের ভিতরে এক ধরনের সৌন্দর্য বোধ জন্মেছে। এর
বাইরে কিছু হলে আমরা তাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। সেক্ষেত্রে
সৌন্দর্য উপভোগ করার পরিবর্তে আমরা ভীত হয়ে পড়ি। প্রাকৃতিক কারণে কোনো শিশু
চারটি চোখ, নাকের অগ্রভাগে তীক্ষ্ণ দাঁত, মুখের একটি কান সাপের মতো হয়। আমরা
তাকে নিশ্চয়ই দেখতে সুন্দর বলবো না। কিন্তু সকল মানবশিশু যদি এমনই হতো, এবং
আমরা দেখে দেখে অভ্যস্থ হয়ে উঠতাম, তা হলে বর্তমান মানব শিশুই হয়তো কুৎসিত মনে
হতো।
বিবর্তনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌন নির্বাচন। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ
রয়েছে জীবের জিন-সঙ্কেতে। প্রাকৃতিক এই বিষয়টির সাথে জড়িত রয়েছে প্রজাতির
বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার জন্য। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হলো
প্রকৃতির এক ধরনের ছলনা। যৌনানন্দের মধ্য দিয়ে জীব জীবনকে উপভোগ করতে চায়। তার
জন্য লিঙ্গের বিচারে জীবদেহে সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। ময়ুর পেখম মেলে ময়ুরীকে
আকর্ষণের জন্য, গান গাওয়া পাখি গান গায়, তার প্রত্যুত্তর দেয় সঙ্গী বা
সঙ্গিনীকে কাছে পাওয়ার জন্য। মানবজগতে রূপচর্চার মূলে রয়েছে যৌনাবেদন। মানবজগতে
রূপচর্চার অনুশীলনের ভিতর দিয়ে সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা জন্মলাভ করেছে। বিপরীত
লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ,
মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা জাগিয়ে তোলার জন্য মানুষ এই চর্চা করে চলেছে আদিকাল থেকে।
কৃত্রিম সৌন্দর্য: যে সকল সৌন্দর্য মানুষ সৃষ্টি করে। চিত্র, সঙ্গীত, ভাস্কর্য এ সবই কৃত্রিম সৌন্দর্য।
শিশুর প্রাথমিক সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চর্চার ভিতর দিয়ে। যে কোনো শিশুকে ছবি আঁকতে দিলে, সে তার চারপাশের প্রকৃতি থেকে ছবির উপাদান সংগ্রহ করে। হতে পারে কম্পিউটার, টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক পাখার মতো একটি কৃত্রিম উপাদান। কিন্তু শিশুর কাছে তার সবই প্রাকৃতিক উপাদান। কোনটি মানুষের তৈরি আর কোনটি প্রকৃতির তা জানার চেষ্টা করে না। রঙের বিচারে শিশু তার মনের রঙ মিশায়। আমরা শিশুদের অদ্ভুত রঙ নির্বাচনে কৌতুকবোধ করি। কিন্তু শিশুর মনের রঙের মর্যাদা দিলে, সে কৌতুক মানানসই হয় না।
শিশুর ঘরের ভিতরের খেলনাগুলোকে নিজের মতো করে সাজায়। এই সাজানোর প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তার কৃত্রিম সৌন্দর্যবোধ জেগে উঠে। সবাই বড় হয়ে চিত্রশিল্পী বা সঙ্গীত শিল্পী হয় না। কিন্তু শৈল্পিক বোধ কিন্তু থাকেই। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নানা ধরনের এই শৈল্পিকবোধের জন্ম হয়। মানুষের সৌন্দর্যবোধের প্রকৃতি তৈরি হয় তার চারপাশের জগৎ থেকে। যে পরিবারে সঙ্গীতচর্চার হয়, সেই পরিবারের সন্তান সঙ্গীত শিল্পী হয়ে না উঠলেও সঙ্গীতের বোধ তার ভিতরে থাকে। ভৈরবীর রাগালাপ শুনে একজন দীনমুজুরের ভালো নাও লাগতে পারে। যদি ভালো না লাগে, তাহলে বুঝতে হবে এই জাতীয় সুর থেকে ভৈরবী শুনে আনন্দলাভের মতো সৌন্দর্যবোধ তার তৈরি হয় নি।
সৌন্দর্যের ভিতরে আছে মানসিক আকর্ষণ। সেই কারণে মানুষ সৌন্দর্যের কাছে বারবার ফিরে আসে বা আসতে চায়। এর ভিতরে থাকে একধরনের অতৃপ্ততা। যখন কবি বলেন, 'মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়'। তখন সৌন্দর্যের তীব্র আকাঙক্ষার অতৃপ্ত দশা থেকেই বলেন। এই অতৃপ্ততাজনীত আকাঙ্ক্ষার মৃত্য হলে, সৌন্দর্যেরও মৃত্যু ঘটে।
সৌন্দর্য
প্রতিযোগিতামূলক
যেকোনো বিষয়ের সৌন্দর্যের একটি আদি মান থেকে। এই মানটি মানুষ পায় প্রথম
অভিজ্ঞতা থেকে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত ওই সৌন্দর্য একটি বিশেষ স্থানে অবস্থান করে।
যদি কখনো এই জাতীয় সৌন্দর্যের সে মুখোমুখী না হয়, তাহলে, তার ওই বিষয়ের সৌন্দর্যবোধ
ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময়ই তা হয় না। জীবনের চলমান প্রক্রিয়ায়
মানুষ নানা রকম ভাবে একই জাতীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখী হয়। এর ফলে আদি সৌন্দর্য
বিন্দুর সৌন্দর্যমানের হেরফের ঘটতে থাকে। ধরা যাক কোনো একজন প্রথমবার একটি
গাঁদা ফুল দেখে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো। এরপর আবার অন্য একটি ফুল দেখে আগেরটির
চেয়ে আরও ভালো লাগলো। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ফুলটি প্রথম স্থানে
উঠে আসবে।
যিনি সৌন্দর্য তৈরি করেন তাঁর সৃষ্টির ভিতর দিয়ে, তিনি শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টি যিনি অনুভব করতে পারেন তিনিও শিল্পী। শিল্পীর সৃষ্টি অনুভব করে দর্শক-শ্রোতা তৃপ্ত হন, কিন্তু শিল্পী তৃপ্ত হন না। যিনি নিজের সৃষ্টিতে নিজেই পূর্ণতার অনুভব করেন তিনি শিল্পী নন। কারণ, শিল্পী মাত্রেই প্রতি নিয়ত নিজের সৃষ্টিতে অপূর্ণতা খুঁজে পান। আর সেই অপূর্ণতা পূরণের তাগিদে শিল্পী আত্মতাড়িত হন। অন্য কারো কাছে শিল্পীর দায়বদ্ধতা নেই। সে সৌন্দর্যের সেবক বা দাস। তাই সৌন্দর্যের জন্যই শিল্পী। শিল্পী পরম সৌন্দর্যের সন্ধানে তাড়িত হন। যদি কেউ সেই পরম সৌন্দর্যকে ধারণ করতে পারেন, সেটাই হবে পরম সত্য। আর পরম সত্যই তাঁকে তুলে নেবে পরম স্রষ্টার আসরে। সেখানে সত্য-সুন্দর-সষ্টা একাকার হয়ে যাবে।
সৌন্দর্য সৌন্দর্য-বোধ
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
মানুষের সৌন্দর্য বোধ জন্মে তার পরিবেশ থেকে। ক্রমে ক্রমে তা মানুষের সহজাত
অনুভূতির অংশ হয়ে যায়। এই সহজাত অনুভূতি স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ
লাভ করে। সহজাত এই সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় মূলত সৌন্দর্য চর্চার ভিতর দিয়ে। একই
সঙ্গীত কারো ভালো লাগে, কারো লাগে না। তার অর্থ ওই সঙ্গীতের সৌন্দর্য কেউ সৌন্দর্য
হিসেবে গ্রহণ করতে পারছেন কেউ পারছেন না।
সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা, তার অনুভূতির তীব্রতা যে আনন্দ দান করে, তা মানুষের বিকশিত মননের অংশ। এই বিচারে বলা যায়, সৌন্দর্যবোধ হলো মানুষের মনের অভিযোজিত রূপ। এই রূপটি বিকশিত হয় অনুশীলনের ভিতর দিয়ে।
সৌন্দর্যবোধ দান করা যায় না, যদি না সে ওই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। ব্যাপারটা উল্টোও হয়। যে বিষয় আগে ভালো লাগতো না, ওই বিষয়ের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে এক ধরনের ভালো লাগা বোধ জন্মে। এই ভালোলাগা বোধ থেকে আনন্দ পেতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ওই বিষয়ে তাঁর সৌন্দর্যবোধ জন্মে। অনেকেই বলে থাকেন ভারতীয় রাগ সঙ্গীত আগে তাঁর ভালো লাগতো না, কিন্তু শুনতে শুনতে রাগ সঙ্গীতের প্রতি তার যে অনুরাগ এতটাই তীব্রতর হয়েছে যে, তাঁর কাছে অন্য গান অতটা ভালো লাগে না। শোনা যায় জাপানের মানুষ বিটোভেনের সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অথচ জাপানে বিটোভেনের জন্ম হয় নি।
সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। প্রকৃতির ক্ষমতা যাই থাক, মূল কথা মানুষের ওই সৌন্দর্য গ্রহণের ক্ষমতা আছে বা অর্জিত হয়েছে। সেই ক্ষমতার গুণে মানুষ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করে। এই ক্ষমতায় নিজ দেশে যা নাই, তাকেও ভালো লাগে। নায়েগ্রার প্রবল জলপ্রপাত, কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণালী রূপ, আফ্রিকার খোলা প্রান্তর, বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ সব কিছুর ভিতরই মানুষ সৌন্দর্য খুঁজে পায়। শুধু তাই নয়, ওই সব বিষয় যখন কোনো শিল্পী সুচারুরূপে ফুটিয়ে তোলেন, তাও ভালো লাগে। প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপের সাথে শিল্পী যখন সুসমন্বয়ে বাড়তি কিছু যুক্ত করেন তখনও অন্যভাবে দেখার আনন্দ দর্শক পান। চিত্রের এই চর্চার বিকাশ ঘটেছে সৌন্দর্য চর্চার বিবর্তনের ধারায়। শাওভে (Chauvet) গুহাগুলি প্রায় বত্রিশ হাজার বছর পুরানো, কেভ পেইন্টিং ছাড়াও একই সময়ের তৈরি কিছু নারীমূর্তি ও পশুপাখির আকৃতি পাওয়া গেছে গুহাগুলিতে। তবে শৈল্পিক অলঙ্করণের চর্চা কিন্তু এই সময়েরও অনেক আগের। ঝিনুক বা শামুকের মালা যা এখন আমরা প্রায়ই আর্ট ও ক্রাফট-এর মেলাগুলিতে দেখি এবং বডি পেইন্টের নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রায় এক লক্ষ বছরেরও আগে থেকে। উল্লেখ করতে হয় ভারত প্রজাতন্ত্রের মহারাষ্ট্র নামক প্রদেশের আওরঙ্গবাদ জেলায় অবস্থিত ইলোরার গুহামুর্তি এবং মন্দিরের অলঙ্করণের কথা।
সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়-প্রকৃতি নির্ভর এবং পরিবেশ নির্ভর।
ইন্দ্রিয়বাহিত বা দেহাভ্যন্তরীণ
অনুভূতির সূত্রে যে সৌন্দর্যের
অভিজ্ঞতা হয়, তা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতির কারণে পার্থক্য গড়ে তোলে। দেখা, শোনা, স্বাদ
গ্রহণ করা, স্পর্শ লাভ করা, ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের উপস্থাপনকে ভিন্নভাবে
গ্রহণ করে। ছবির সৌন্দর্য কখনোই সঙ্গীতের মতো নয়। আবার একাধিক ইন্দ্রিয়গ্রাহী
অনুভূতি মিশ্র সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সঙ্গীতসহযোগে নৃত্য
পরিবেশনা। কিম্বা একটি সুগন্ধী বৈঠকখানা। এই মিশ্র সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনেক সময়
রসভঙ্গ হয়। প্রায়ই আমরা নৃত্যানুষ্ঠানে সঙ্গীতের তারিফ করি কিন্তু নাচের করি না। বা
নাচের অংশটিকে ভালো বলি, গানের অংশকে ভালো বলি না। প্রকৃতির কোনো নান্দনিক রূপ দেখে
যখন বিমুগ্ধ, তখন পচাগলা কোনো গন্ধ তার রসভঙ্গ করে। অতি প্রিয়গান প্রিয়জনের
মৃত্যুতে বেদনার সৃষ্টি করতে পারে। সৌন্দর্য থাকাটাই সৌন্দর্য উপভোগের একমাত্র তার
শর্ত নয়। এর সাথে দরকার উপযুক্ত পরিবেশও। এই পরিবেশ শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নয়।
মনের অবস্থাও মনের পরিবেশকে বলা হয় মেজাজ। কারণ মনের মেজাজ যে দশায় থাকে, তা কোনো
পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সৌন্দর্য পরিবেশ সৃষ্টকারক