প্রথম সঙ্গীতি:
গৌতম বুদ্ধের
জীবদ্দশায় যত ধরনের উপদেশ দিয়েছিলেন, তার সবই শ্রাবকরা কণ্ঠস্থ করেছিলেন। এই
উপদেশগুলো ছিল মূলত দুই ধরনের। এর একটি ছিল ধর্ম ও দর্শন, অপরটি ছিল
ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের করণীয় কাজ বা জীবন-বিধান ও বিনয় বিধান। সাধারণভাবে প্রথম ভাগটি
ধর্ম এবং দ্বিতীয় ভাগটি বিনয় নামে পরিচিত ছিল।
গৌতম বুদ্ধ
নির্বাণলাভের পর, অল্প দিনের ভিতরে মতাদর্শগত বিভেদ প্রকট হয়ে উঠে। তা ছাড়া এই
সময়ের ভিতরে বুদ্ধের যোগ্য শিষ্যদের অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। বুদ্ধের বাণী এবং তার
ব্যাখ্যা বিলীন হওয়া বা বিকৃত হওয়ার আশংকা তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সমস্যা
সমাধানের জন্য,
৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
মগধের মহারাজ
অজাতশত্রুর (৪৯৩-৪৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সহায়তায় মহাকাশ্যপ এক
বৌদ্ধসভার আয়োজন করেন। কথিত আছে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী নামক গুহায় এই সভায় যোগদান
করেছিলেন। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের নেতৃত্বে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্মাংশ
এবং আর বুদ্ধের অপর শিষ্য উপালি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিনায়ংশ। পরে এই দুই সংগ্রহকে
বিষায়ানুসারে ভাগ করে, তৈরি করা হয়েছিল বিনয়পিটক ও সূত্রপিটক। পরে সূত্রপিটকের একটি
অংশ পৃথক করে অভিধম্মপিটক নামক তৃতীয় পিটক তৈরি করা হয়। এই তিনটি পিটকের সংকলনই হলো
ত্রিপিটক।
উল্লেখ্য যে সব ভিক্ষুরা ধর্ম ও সূত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁদেরকে
সৌতান্ত্রিক নামে অভিহিত করা হয়। পক্ষান্তরে যাঁরা বিনয় সংরক্ষণের দায়িত্ব
নিয়েছিলেন, তাঁরা বিনয়ধর নামে পরিচিতি লাভ করেন।
দ্বিতীয় সঙ্গীতি:
প্রথম সঙ্গীতির প্রায় ১০০ বৎসর পর দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত
হয়।
এই সময়ের
ভিতরে বৌদ্ধ সাধকেদের ভিতরে তীব্র মতভেদের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বৈশালীর বজ্জীপুত্র
ভিক্ষুরা বিনয়-বিধি লঙ্ঘন করে নিজেদের মত করে ধর্মাচরণ শুরু করেছিলেন। শুধু
তাই নয়, এঁরা দশটি বিনয়-বহির্ভুত বিষয় প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর ফলে অবশিষ্ট
ভিক্ষুদের সাথে বিবাদের সৃষ্টি হয়।
এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য স্থবির যশ (মতান্তরে স্থবির যজ্ঞ) নামক একজন আচার্য
খ্রিষ্ট-পূর্ব ৩৮৩ অব্দে বৈশালীতে দ্বিতীয় সঙ্গীতির আয়োজন করেন। এই মহাসভার
উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ সাধকদের মতভেদের নিরসন করা হয়। প্রায় আট মাস এই সঙ্গীতি ধরে এই
সঙ্গীতিতে ভিক্ষুরা নিজ নিজ বক্তব্য রাখেন। কিন্তু ভিক্ষুরা একমত হতে না পারায়
আয়োজনটি ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর কিছু ভিক্ষু কৌশাম্বীতে মহাসঙ্ঘ নাম দিয়ে একটি পৃথক
সভা করেন। এই সভায় বিনয়-বহির্ভুত পৃথক ধর্ম-বিনয়ের সংকলন তৈরি করেন। এর ফলে
স্থবিরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দুটি নিকায় (সম্প্রদায়) বিভাজিত হয়ে যায়। এর ভিতরে
রক্ষণশীলরা থেরোবাদী বা স্থবিরবাদী নামে অভিহিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, পালি
শব্দ ‘থের’-এর অর্থ হলো
স্থবির, স্থিত, স্থিতধী, স্থিতিশীল ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্ম মতে যিনি সংসার
ত্যাগ করে ভিক্ষুত্বে উপনীত হন এবং এই অবস্থায় কমপক্ষে দশ বছর নিরন্তর ব্রহ্মচর্য পালনে স্থিতিশীল
থাকেন তাঁকেই বলা হয় ‘স্থবির’ বা ‘থের’। এই কারণে থেরবাদী এবং
স্থবিরবাদী সমার্থক নাম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই দুই সম্প্রদায় নানাভাবে
বিভাজিত হয়ে ১৮টি নিকায় বিভাজিত হয়ে যায়।
তৃতীয় সঙ্গীতি:
দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর উদ্ভুত বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ভিতর বিবাদ চলতেই থাকে।
ফলে বৌদ্ধ ধর্ম একটি বিশৃঙ্খল দশায় উপনীত হয়। এই দশা থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্য
তৃতীয় সঙ্গীতির আয়োজন করা হয়।
সম্রাট
অশোক
(২৬৯-২৩২
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পাটালিপুত্রের অশোকারামে
এই সঙ্গীতির আয়োজন করেছিলেন। এই মহাসভার অধ্যক্ষ ছিলেন ৭২ বছরের বৃদ্ধ আচার্য
মৌদ্গলিপুত্র তিষ্য। এই আয়োজনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে কিছু মৌলিক
প্রশ্ন প্রত্যেক ভিক্ষুকে করা হয়। এই প্রশ্নের যাঁরা উত্তর দিতে ব্যর্থ হন,
তাঁদেরকে শ্বেতবস্ত্র পরিয়ে সভা থেকে বের করে দেওয়া হয়। কথিত আছে এদের সংখ্যা ছিল
প্রায় ৬০ হাজার। এরপর প্রায় এক হাজার ভিক্ষুকে আলোচনার উপযুক্ত হিসেবে নির্বাচন করা
হয়।
এই সভা চলেছিল
প্রায় নয় মাস ব্যাপী। এই সভায়
তিষ্য
স্থবিরমত বিরোধীদের
মতামত খণ্ডন করে ‘কথাবত্থু’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটিকে পরে অভিধর্ম
পিটকের অঙ্গ হিসেবে মান্য করা হয়। এই সভয় ধর্ম-বিনয় অনুমোদিত হয় এবং আরও কিছু বাণীর
সংকলন করা হয়। এর ভিতর দিয়ে ত্রিপিটক একটি আদর্শ সংকলনে পরিণত হয়।
চতুর্থ সঙ্গীতি:
কুষাণবংশীয় রাজা
কণিষ্ক
(৭৮-১৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় বসুমিত্রের নেতৃত্বে,
এবং পার্শ্ব, অশ্বঘোষ প্রমুখ বৌদ্ধ আচার্যের সহায়তায়,
জলন্ধরে কুণ্ডলবন
বিহারে পাঁচশত ভিক্ষুর সমন্বয়ে চতুর্থ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়।
এটাই ছিলো বৌদ্ধধর্মের সর্বশেষ সঙ্গীতি।
এই মহাসভায় বসুমিত্র ছিলেন সভাপতি এবং
পাটলিপুত্র
থেকে আগত
অশ্বঘোষক ছিলেন
সহ-সভাপতি। এই মহাসভায় উপস্থিত আচার্যরা বৌদ্ধধর্মের সিদ্ধান্তগুলিকে স্পষ্ট করা
এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতরে ভেদাভেদকে দূর করা জন্য ত্রিপিটকের একটি ভাষ্য তৈরি
করেন। এই ভাষ্য ‘মহাবিভাষা’ নামে পরিচিত। এর ফলে পূর্বের বৌদ্ধসংঘের বিভাজিত
আঠারোটি সঙ্ঘের অধিকাংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে চারটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। এই
সঙ্ঘগুলো হলো আর্যসর্বাস্তিবাদী, আর্যসম্মিতীয়, আর্যমহাসাঙ্ঘিক এবং আর্যস্থবির।
সূত্র: