কর্তাভজা
খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে উদ্ভূত একটি উপধর্ম মত।
এই ধর্মের আরাধ্য দেবতাকে 'কর্তা' বলা হয়। 'কর্তার ভজনা' অর্থে
এই ধর্ম-সম্প্রদায়ের নাম 'কর্তাভজা' । নদীয়া জেলাত ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল এই ধর্মমতের মন্দির। প্রতি বৎসর দোল পূর্ণিমায় ঘোষপাড়ায় এই সম্প্রদায়ের মেলা
বসতো। এই কারণে অনেকে এই সম্প্রদায়কে ঘোষপাড়া মতালম্বী নামে অভিহিত করে থাকেন। আবার
এই মতের প্রতিষ্ঠাতা
আউলচাঁদের
নামানুসারে আউল বা আউলিয়া বলে থাকেন। এর পূর্বঙ্গীয় শাখা যশোহর-খুলনা অঞ্চলে 'ভগবানিয়া'
নামে পরিচিত। এছাড়া অনেকে মনে করেন 'গুরুসত্য' নামক সম্প্রদায় মূলত কর্তাভজার শাখা।
এই মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাধক
আউলচাঁদ।
কর্তাভজাদের মতে- গৌরচাঁদ (শ্রীচৈতন্য) তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য
আউলচাঁদ
হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা
তাঁর মতবাদকে একটি বিশেষ ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে
প্রচার শুরু করেন। জীবিতকালে
আউলচাঁদের
জীবদ্দশায় তাঁর অসংখ্য ভাবশিষ্য তৈরি হয়েছিল।
এঁদের ভিতরে উল্লেখ্য শিষ্য হিসেবে ২২জনকে বিবেচনা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর
প্রধান ৮ জন শিষ্য
রামশরণ পালকে
কর্তাভজা ধর্মের দ্বিতীয় কর্তবাবা পদে অভিষিক্ত করেন।
রামশরণ পাল
কর্তভজা ধরমকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য ঘোষপাড়ায় মেলার ব্যবস্থা করেন। প্রথমদিকে
এই মেলা ততটা জমে না উঠলেও, ধীরে ধীরে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশেষ করে
নিম্নবৃত্তের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।
রামশরণ পালের
মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী
সরস্বতী এই ধর্মের প্রধানা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
রামশরণের প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর, তিনি সরস্বতীকে বিয়ে করেন। কথিত আছে, সরস্বতী
আউলচাঁদের মতো একটি সন্তান কামনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি আউলচাঁদকে নিজের সন্তানের মতো
স্নেহ করতেন, কিন্তু ভক্তি করতেন গুরুর মতো। তিনি আউলচাঁদের অলৌকিক শক্তি লাভ
করেছিলেন। এই বিশ্বাস থেকে সরস্বতী শরণপালের মৃত্যুর পর কর্তাভজাদের পরিচালিকা
পদে অধিষ্ঠিতা হন। ভক্তরা তাঁকে দেবীর মতো মান্য করতেন। এই সূত্রে ঘোষপাড়ায়
প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি 'সতী মায়ের মন্দির' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সরস্বতী ঠাকুরের মতো সন্তান লাভের যে আজ্ঞালাভ করেছিলেন, তা তিনি
লাভ করেছিলেন ঠাকুরের মৃত্যুর প্রায় ৬ বছর পরে। তাঁর পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল
দুলালচাঁদ (রামদুলাল)।
সরস্বতীর মৃত্যুর পর, দুলালচাঁদ কর্তাভজাদের প্রধান মহাশয়ের পদ লাভ করেন। তিনি
কর্তাভজাদের সংঘবদ্ধ করে, বৃহত্তর সম্প্রদায়ে পরিণত করেন। এই সম্প্রদায়ের অনুসরণীয়
কোনো গ্রন্থ নাই। এঁদের দর্শনের গুরুতত্ত্ব গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রচারিত।
সাধারণভাবে এঁদের মত প্রচারিত হয়ে থাকে কর্তভজা গানে। প্রাথমিক পর্যায়ে কর্তাভজাদের
জন্য গান রচনা করেছিলেন দুলালচাঁদ। ধারণা করা হয় দুলালচাঁদের গানের সংখ্যা প্রায় ৫
শতাধিক।
কর্তাভজা ধর্মমত
কর্তাভজারা নিজেরদেরকে 'সত্য-ধর্ম'-এর অনুসারী হিসেবে দাবি করেন।
এই কারণে সত্য কথা বলা তাঁদের ধর্মের মূলমন্ত্র। আবার এঁরা সত্যকে পরমাত্মার অপর
নাম হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এঁরা নিজেদের ভিতরে পরমাত্মার অস্তিত্ব অনুভব করেন।
এদিক থেকে এঁদের মতবাদ দাঁড়ায় বাউল মতবাদের মতো। এঁরা বৌদ্ধ ধর্মের মতো বিশ্বাস
করেন যে, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলনে নির্বাণ লাভ হয়। এই নির্বাণের মধ্য দিয়ে
তাঁরা নিজেদেরকে পরমাত্মা বা পরমস্রষ্টার অংশভাগী হয়ে যান। কখনো কখনো নিজেদের ভিতরে
পরমস্রষ্টাকে অনুভব করেন। সুফিবাদের 'আনাল হক' তথ্য 'আমিই খোদা' মনে করেন। এঁরা
শুক্রবারকে ধর্মপালনের দিন হিসেবে মনে করেন এবং পাঁচবার স্রষ্টার নাম জপ করেন।
আচারের দিক থেকে এঁরা ইসলামি রীতি অনুসরণ করেন। সব মিলিয়ে এঁদের মত বৈষ্ণব,
বৌদ্ধ এবং সুফি দর্শনের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
এঁরা এঁদের গুরুকে বলেন 'মহাশয়', আর শিষ্যদের বলেন 'বরাতি'। মহাশয় বরাতিদের দীক্ষা
দেন। এই দীক্ষায় রয়েছে ১০টি নিষেধাজ্ঞা। এগুলো হলো-
- কায় কর্ম (৩ প্রকার):
পরস্ত্রীগমন, পরদ্রব্য হরণ এবং পর হত্যাকরণ
- মনঃকর্ম: (৩ প্রকার): পরস্ত্রীগমনের ইচ্ছা, পরদ্রবহরণের ইচ্ছা এবং পর-হত্যাকরণের ইচ্ছা
- বাক্যকর্ম: (৪
প্রকার): মিথ্যা কথন, কটু কথন, অনর্থক বচন ও প্রলাপ বচন।
সূত্র:
- কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত। দেবেন্দ্রনাথ দে। জিজ্ঞাসা
এজেন্সিজ্ লিমিটেড। কলকতা-৯। মে ১৯৫০।
- বাংলার বাউল ও বাউল গান। অধ্যাপক উপেন্দ্রেনাথ
ভট্টাচার্য। ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি। কলকাতা ১২।
- ভারত-বর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় (প্রথম ভাগ)। অক্ষয়কুমার
দত্ত।