প্যাথে-এইচ বোসেজ রেকর্ড
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মিত রেকর্ড।


এই রেকর্ডের জনক ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯০-৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'কুন্তলীন কেশ' তৈল নিয়ে ব্যবসায় অবতীর্ণ হন। এইচ. বোস পারফিউমার কারখানা থেকে সে সময় তৈরি হতো
কুন্তলীন, দেলখোস, ল্যাভেণ্ডার ওয়াটার, ও-ডি কোলন, মিল্ক অফ রোজ প্রভৃতি সুগন্ধি দ্রব্য। পরে তিনি কলকাতার হ্যারিসন রোডে সাইকেলের দোকান খুলেছিলেন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি  টু-সিটার ড্যাকার গাড়ি কিনেন। এই সূত্রে পরে তিনি গ্রেট ইষ্টার্ন মোটর কোম্পানি স্থাপন করেন। গাড়ি মেরামতের জন্য পার্ক স্ট্রীটে গ্রেট ইষ্টার্ন মোটর ওয়ার্কস নামে তাঁর একটি মেরামতির কারখানা ছিল।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি একটি ফোনোগ্রাফ যন্ত্র কেনেন। এই সূত্রে তাঁর ভিতরে এই যন্ত্রের ব্যবসার বাসনা জেগে উঠে। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইংল্যন্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি রাশিয়া ইত্যাদি দেশে যখন সঙ্গীতের রেকর্ডের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল,
সেই সময় ভারতীয় শিল্পীদের গানের চাহিদা বুঝে হেমেন্দ্রনাথ বসু কলকাতাস্থ 'ধর্মতলার মার্বেল হাউসে দ্য টকিং মেশিন হল (The Talking Machine Hall) নামে রেকর্ড তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এই রেকর্ড ছিল ফনোগ্রামের সিলিন্ডার। পরে বৌবাজার স্ট্রীটের দেলখোস হাউসে এই কারখানা স্থানান্তরিত হয়। তাঁর রেকর্ড কোম্পানির নাম ছিল এইচ.বোসেস।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ফ্রান্সের প্যাথেফোন কোম্পানির সঙ্গে হেমেন্দ্রমোহনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ হয়। এরপর ৪১ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের, মার্বল হাউসে শুরু হয় সিলিন্ডার রেকর্ড ও ফোনোগ্রাফের ব্যবসা। সেই দোকানের নাম ছিল ‘টকিং মেশিন হল’। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে হেমেন্দ্রমোহন শুরু করেছিলেন তাঁর নিজস্ব রেকর্ডের প্রতিষ্ঠান ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’। সে সময়ে সংবাদপত্রে ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’-এর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। সেই সময় এই কোম্পানির শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন স্টার থিয়েটারের নরী সুন্দরী, বসন্তকুমারী কিংবা কাশীবাবু। শুরুর দিকে, শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এছাড়া এই কোম্পানির শিল্পী তালিকায় ছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পীরা। এঁরা ছিলেন ওস্তাদ রমজান খান, মেটিয়াবুরুজের পিয়ারা সাহেব ও লালচাঁদ বড়াল

গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডের জন্য শব্দে গ্রহণ করা হতো কলকাতায়। কিন্তু রেকর্ড হিসেবে মুদ্রিত হতো জার্মানের হ্যানোভারে। এতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হতো। এই অসুবিধা দূরীকরণে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামোফোন কোম্পানি কলকাতার বেলেঘাটায় গ্রামোফোন ডিস্ক রেকর্ড উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে। এর ফলে ভারতবর্ষে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ডের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। গ্রামোফোন কোম্পানির বাণিজ্যের প্রসার দেখে ভারতে আরও নানা কোম্পানি রেকর্ড ব্যবসার জন্য আসে। ফলে সিলিন্ডার রেকর্ডের চাহিদা কমে যেতে থাকে। এই অবস্থায় হেমেন্দ্রনাথ প্যাথে কোম্পানির সহায়তায় ডিস্ক রেকর্ড বাজারজাত করার উদ্যোগ নেন।

 

এই রেকর্ড কোম্পানি শুরু থেকেই তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত বিরোধী রেকর্ড বা স্বদেশী রেকর্ড প্রকাশ করা শুরু করেছিল। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর, এই কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গানের রেকর্ড ধারণ করেছিল মোমের সিলিন্ডার রেকর্ডে। এরপর ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই কোম্পানি বন্দে মাতারম্ রেকর্ড প্রকাশ করে। ফলে সরকারের বিষদৃষ্টি পড়ে এই কোম্পানির উপর। কয়েকবার এদের অফিসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। সরকারের বিরোধিতা এবং বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এইচ বোস রেকর্ডস কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়।
 



সূত্র: