বাঙালির
নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
বাঙালির জাতিগত পরিচিতির একটি অন্যতম
উপাদান হলো- বাঙালির নৃতাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচিত
নৃতাত্ত্বিক সূত্রে বাঙালি মিশ্র জাতি। মানুষের মহাজাতি-সত্তার কমবেশি মিশ্রণ ঘটেছে
বাঙালি জাতিতে।
-
নেগ্রিটো : ভারতীয় অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মতই এই জাতিসত্তার আদি বিকাশ শুরু
হয়েছিল ৭৫-৬০ হাজার বৎসর আগে থেকে নেগ্রিটোদের মাধ্যমে
নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে—
প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা
Homo
sapiens
(হোমো স্যাপিয়েন্স)
নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব
ঘটেছিল আফ্রিকার ইথিওপিয়া অঞ্চলে। প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে
এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে
পড়া শুরু করে। ভারতবর্ষে এরা প্রবেশ করে প্রায় প্রায় ৭৫-৬০
হাজার বৎসর আগে। মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। এদের মাথার গড়ন ছিল লম্বাটে এবং নাক
ছিল চ্যাপ্টা।
-
প্রোটিও-অস্ট্রালয়েড
: ৬৫ হাজার বৎসর আগে অন্যান্য মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই
দ্বিতীয় দলটি প্রটো অস্ট্রালয়েড নামে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। ৫০-৬০ হাজার
বৎসর আগে এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার
বৎসর আগে এরা, সাগর পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়।
-
দ্রাবিড় : নৃবিজ্ঞানী এবং
ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর পরে এবং আর্যদের ভারতে প্রবেশের আগে এরা ভারতবর্ষে
প্রবেশ করেছিল। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব
৫০০০ বৎসর বা তার কিছু আগে থেকে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার
সূত্রে যে সকল নমুনা এই অঞ্চলের হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া গেছে, তার
ভিত্তিতে এই সভ্যতাকে সামগ্রিকভাবে 'সিন্ধু সভ্যতা' নামে অভিহিত করা হয়। আবার
J. Bloch
এবং
M.
Witzel
-এর মতো অনেকে গবেষক মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল আর্যদের অগ্রবর্তী দল
এবং এদের দ্বারা ঋগ্বেদের আদি অংশ রচিত হয়েছিল। এরপর এরা ধীরে ধীরে দক্ষিণ ভারতে
স্থান নিজেদের বসতি স্থাপন করা শুরু করে। অনেক মনে করেন বেলুচিস্তানের ব্রাহুই
ভাষাভাষীরা দ্রাবিড়দের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী।
থমসন, কাফম্যান এবং
অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতে- খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের পরে, দ্রাবিড়রা আর্যদের দ্বারা
ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চল থেকে বিতারিত হয়ে দক্ষিণ ভারতে ব্যাপকভাবে
প্রবেশ করেছিল। দক্ষিণ ভারতে আগে থেকেই থাকা দ্রাবিড় এবং বিতারিত দ্রাবিড়দের
সমন্বয়ে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আর্যরা এই বিশাল দ্রাবিড়
অঞ্চলকে পদানত করতে পারে নি। কিন্তু ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর
(নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়) আরেকটি অংশ থেকেই গিয়েছিল। এদেরকে আর্যরা
অনার্য হিসেবে অভিহিত করতো।
-
মঙ্গোলীয় : ভারতবর্ষে এরা
প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের
পাহাড়ী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত,
ভুটান এবং হিমালয়ের ভারতবর্ষে অভিমুখী অঞ্চল নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন অঞ্চলে
ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলের মঙ্গোলীয়রা প্রবেশ করেছিল বার্মা
দিয়ে। স্থানীয়
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড -ও দ্রাবিড়দের সাথে সংমিশ্রণও ঘটেছিল। বাঙলি
জাতিগোষ্ঠীর সাথে এদের সংমিশ্রণ ঘটেছে পূর্ব-ভারতের পাহাড়ী মঙ্গোলয়েডদের সাথে।
- ককেশীয়
: মধ্য এশিয়া থেকে ইরানের ভিতর দিয়ে
এই মহাজাতির লোকেরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এদেরকে অনেক সময় ককেশীয়দের
ইউরোপীয়ড বলা হয়। ভারতবর্ষে এর
যে শাখাটি প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে আর্য নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।