কর্নওয়ালিস, লর্ড চার্লস
Cornwallis, Lord Charles
(১৭৩৮-১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ)

ব্রিটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র অধীনস্থ বাংলার দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল। উল্লেখ্য প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন  ওয়ারেন হেস্টিংস তিনি ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলায়  ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র  প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার রূপকার।

১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের গ্রোসভেনর স্কোয়ার (Grosvenor Square Mayfair, London) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চার্লস কর্নওয়ালিস (পঞ্চম ব্যরোন কর্নওয়ালিস), মায়ের নাম এলিজাবেথ। তিনি ক্যাম্ব্রিজ-এর এটোন ও ক্লেয়ার কলেজে লেখাপড়া করেন।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সামরিক বাহিনীতে প্রবেশ করেন।
১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি আর্লের (ব্রিটেনের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবিশেষ) পদমর্যাদায় হাউস অব লর্ডসে বাবার স্থলাভিষিক্ত হন।

পলাশীযুদ্ধের পর প্রায় ৮ বছর উত্তর বঙ্গ কোম্পানির শাসনের বাইরে ছিল। এই সময় মুসলমান ফৌজদার মীর করম আলী এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল ঘোড়াঘাট। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই ফৌজদারের বিরুদ্ধে কোম্পানির সেনাপতি কোর্টিল অভিযান চালায়। এই যুদ্ধে করম আলী পরাজিত হলে, ঘোড়াঘাট-সহ সমগ্র উত্তরাঞ্চল কোম্পানির অধীনে আসে।

১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মেজর জেনারেলের পদে পদোন্নতি লাভের পর, তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর একজন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান।

১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মেজর জেনারেল হিসাবে তাঁর মার্কিন ভূমিতে আসেন এবং কয়েক বৎসরের মধ্যেই তিনি দক্ষিণের প্রধান সামরিক অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে সাউথ ক্যারোলাইনাতে ব্যাটল অব ইয়র্কটাউনে মার্কিন ও ফরাসী বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। কিন্তু যুদ্ধে বীরত্ব দেখানোর জন্য ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে নাইট খেতাবে ভূষিত করা হয়।

১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পিট-এর ভারত আইন এর অধীনে কর্নওয়ালিস ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। এই সময় বাংলায় কোম্পানির কর্মাচারীদের দুর্নীতির কারণে শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং অস্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থা দূর করে  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ লর্ড কর্নওয়ালিসকে বাংলার গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্ষমতা লাভের পর তিনি দ্রুত প্রশাসনিক দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নেন। তিনি প্রথমেই প্রশাসন থেকে কোম্পানির বাণিজ্যকে আলাদা করেন। পরে প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য উচ্চ বেতনভোগী ও পেশাগতভাবে সুশৃঙ্খল ‘সিভিল সার্ভিস’ গঠন করেন। এরই সূত্র ধরে, তিনি জেলা পর্যায়ে প্রশাসন ব্যবস্থাকে তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তাঁর সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনার জন্য, কাউন্সিলের একজন সদস্যকে সভাপতি করে ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন একটি রাজস্ব পরিষদ (বোর্ড অব রেভিনিউ) স্থাপন করা হয়। তিনি জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দকে রাজস্ব পরিষদের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীনে আনেন। এছাড়া বেসামরিক প্রশাসনের বাইরে কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড দেখা-শুনার জন্য ‘বোর্ড অব ট্রেড’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করা হয়।

চার্লস কর্নওয়ালিস বিচার এবং পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থার উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তিনি চারস্তর বিশিষ্ট বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের সর্ব নিম্নে ছিল মুনসিফ আদালত এবং সর্বোচ্চ স্থানে ছিল সদর আদালত। এই দুই স্তরের মাঝে ছিল জিলা আদালত এবং কোর্ট অব সার্কিট। প্রতিটি আদালতের ছিল দুটি শাখা দেওয়ানি আদালত (সিভিল কোর্ট) এবং নিজামত আদালত (ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের আবার দুটি বিভাগ ছিল সদর দেওয়ানি আদালত এবং সদর নিজামত আদালত। বিচার কার্যে সহায়তা প্রদান ও দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য, তিনি একটি নিয়মিত পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলেন। তিনি প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে শ্বেতাঙ্গদের বিষয়ে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। বেসামরিক উচ্চ ও নিম্নপদগুলি ইউরোপীয়দের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। স্থানীয়দের জন্য রাখা হয়েছিল শুধু অফিস সহকারী বা অফিস সহকারীর সহায়ক পদগুলি। এর কারণ হলো- শেতাঙ্গ প্রশাসকরা কর্নওয়ালিসকে দৃঢ়ভাবে বেলছিল যে, এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং দেশীয় কর্মচারীরা দুর্নীতিপরায়ণ। এদের ভিতরে দেশীয় কর্মচারীরা ছিল অসংশোধনযোগ্য। 

প্রকৃতপক্ষে, তাঁর পূর্ববর্তী গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং-এর শাসনামলে কাউন্সিলের সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস প্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে ধারণা দেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিং-এর শাসনামলে এটিকে অযৌক্তিক বলে ফেলে রাখা হয়। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজস্ব ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে, নীতি-নির্ধারকগণ ফিলিপের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলার ভূমি ব্যবস্থা জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী ভিত্তিতে করতে হবে। নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্কের পর,
১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিস ঘোষণা করেন যে, দশশালা বন্দোবস্তের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর, জমিদাররা তাদের নিজ নিজ জমিদারির নির্ধারিত রাজস্বের রদবদল করা হবে না। এছাড়া, তাদের ওয়ারিশ ও আইনগতভাবে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদেরকে এ পরিমাণ প্রদেয় রাজস্বের ভিত্তিতে চিরস্থায়িভাবে তালুকের ভোগদখল করার অনুমতি দেওয়া হবে (ইস্তাহার অনুচ্ছেদ ৩, ধারা ৪, প্রবিধান ১, ১৭৯৩)।

লর্ড কর্নওয়ালিস আশা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্থা ইংল্যান্ডের ভূ-স্বামীদের মতোই বাংলায় জমিদারদেরকে তাদের উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করবে। এবং এঁরা নিজেদের স্বার্থেই কৃষি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করবেন এবং একই সাথে রায়তদের স্বার্থ রক্ষা করবেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়াও, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানকে সংযত রাখার জন্য কর্নওয়ালিসের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে কর্নওয়ালিস নিজে মহীশূরের সুলতানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং মহীশূর রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোম্পানি রাজ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। টিপু সুলতানকে পরাজিত এবং একটি আরোপিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে কর্নওয়ালিস কোম্পানি রাজ্যের নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি করেন।

১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁর কাজের সার্বিক মূল্যায়ন করে তাঁকে ‘মার্কুইস’ উপাধি প্রদান করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের পরপরই কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স, বোর্ড অব কন্ট্রোল, এবং পার্লামেন্ট তাঁকে বীরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করে।

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর তিনি গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে অব্যহতি নেন।
 
১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি উক্ত পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।  

১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ওয়েলস্লে-এর পদত্যাগের পর তিনি আবারও গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। এবার তিনি নিয়োগপত্র গ্রহণ করেন এবং ১৮০৫ সালের ৩০ জুলাই দায়িত্ব বুঝে নেন।

১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর দেশে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি গাজীপুরের গাউসপুরে মারা যান।  


সূত্র :