অপরেশ মুখোপাধ্যায়
(১০ জুলাই, ১৮৭৫- ১৫ মে, ১৯৩৮)
বাঙালি নাট্যকার, অভিনেতা এবং নাট্য পরিচালক।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই (৪ শ্রাবণ ১২৮২ বঙ্গাব্দ)
মহেশপুরের তাঁর মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, মায়ের
নাম নিস্তারিণী দেবী। অপরেশচন্দ্রের জন্মের পর, গোবরডাঙার রাজার উৎসাহে তাঁর পিতা
সপরিবারে মহেশপুর চলে আসেন। সেখানে তাঁর সুবিধাজনক কর্মসংস্থান না হওয়ায় তিনি
শিক্ষকতার কাজ নিয়ে মেদেনীপুরে চলে আসেন। প্রায় দুই বছর এখানে শিক্ষকতা করার পর,
কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নৃত্যগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত 'কৃষিতত্ত্ব'
পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কলকাতায় পিতামাতার সাথে থাকার সময় অপরেশচন্দ্র টালার পাঠশালায় ভর্তি হন। পরে তিনি
বেঙ্গল একাডেমি, নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন মেট্রোপলিটন
একাডেমিতে। এই সময় এঁরা বাস করতেন চিৎপুর বিডন স্ট্রিটের কাছাকাছি এলাকায়।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিসতুতো ভাই মনোমোহন পাঁড়ে শ্যামপুকুরের একটি অভিনয়ের আড্ডাখানায়
নিয়ে যান। এখানে তাঁর প্রথম অভিনয়ের হাতে খড়ি হয়। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর
তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ফলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এই সময় তিনি বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নাট্যচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। এরপর থেকে তিনি পুরোপুরি নাট্যচর্চায়
মনোনিবেশ করেন। এই সময় নাট্যকর্মীরা মিলিত হয়ে রাজকৃষ্ণ রায়ের 'বীণা' রঙ্গমঞ্চ ভাড়া
করে 'প্যান্ডেরা থিয়েটার' নামক একটি নাট্যদল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সময় এঁদের নাট্যগুরু ছিলেন
মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত। 'প্যান্ডেরা থিয়েটার' থেকে কোনো নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগেই
মণীন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর বাড়ির প্রবল আপত্তিতে নাট্যদল ত্যাগ করেন। ফলে এই নাট্যদলের
অপমৃত্যু ঘটে।
এরপর অপরেশ অভিনয় শেখার জন্য
এমারেল্ড থিয়েটারের মহেন্দ্রবসুর
কাছে যান। এই সময় তাঁর বাবা অভিনয়ের ত্যাগ করার নির্দেশ দিলে তিনি গৃহত্যাগ করেন।
প্রায় আট মাস
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাযাবরের মতো কাটান।
এরপর তাঁর পিতার অনুনয়ে
কলকাতায় ফিরে আসেন। এই সময় প্যাণ্ডোরা থিয়েটার পুনরায় চালু
করার উদ্যোগ চলছিল। অপরেশচন্দ্র এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু অর্থের অভাবে এই চেষ্টা
ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর তাঁর নাট্য জীবনের দীর্ঘতম বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি কর্মসংস্থানের
জন্য নানা স্থানে কাজ করেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি হোর মিলার
কোম্পানিতে পাকাপাকিভাবে কাজ শুরু করেন। এই সময় তাঁর পিতার ইচ্ছায় বাগবাজারের
গাঙ্গুলীবাড়ির ১১ বছরের কন্যা শিখরবাসিনীর সাথে তাঁর বিবাহ দেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত তিনি চাকরি এবং সংসার করেন।
এই সময়ের ভিতরে তিনি লেখালেখির চর্চা শুরু করেন। এই সূত্রে মণীন্দ্রকৃষ্ণের মাধ্যমে
'প্রভাকর' ও 'প্রয়াস' পত্রিকার সাথে যোগাযোগ ঘটে। এছাড়া নলডাঙার জমিদার-বন্ধুর
বাড়িতে মাঝে মধ্যে শখের অভিনয় করেন।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে মনোমোহন পাঁড়ে
মিনার্ভা
থিয়েটারের বড়দিনের ৮
রাত্রির 'হাউস' কিনে নেন। এই সময় তিনি অপরেশকে টিকিট বিক্রয়ের দায়িত্ব দেন। এই ৮
রাত্রির অভিনয় থেকে মনোমোহন পাঁড়ে লাভের মুখ দেখলে, তিনি পাকাপাকিভাবে থিয়েটার
ব্যবসা করবেন বলে মনস্থির করেন। এই সময় নড়াইলের জমিদার বাড়িতে 'ইলিসিয়াম থিয়েটার'
নামক একটি নাট্যদল গড়ে উঠেছিল। এই দলের শিক্ষক ছিলেন অর্ধেন্দু মুস্তফী। এই দলে
অভিনয় করার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন অপরেশ। এখানেই তাঁর সাথে অর্ধেন্দু মুস্তফী'র
ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এখানে তিনি 'চন্দ্রশেখর', 'কপালকুণ্ডলা' প্রভৃতি নাটকে নায়কের
ভূমিকায় মহড়া অংশ নেন। এই মহড়ার মাধ্যমে তিনি অভিনয়ের খুঁটিনাটি অর্ধেন্দু মুস্তফী কাছে
শেখেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে মনোমোহন 'ইলিসিয়াম থিয়েটার' থেকে অপরেশকে
মিনার্ভাতে নিয়ে আসেন।
এখানে তিনি কপালকুণ্ডলার নবকুমার, সংসার নাটকে প্রিয়নাথ এবং জনা নাটকে প্রবীরে
ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে স্টারের অর্ধেন্দু মুস্তফি এবং ইউনিক
থিয়েটার থেকে তারাসুন্দরী মিনার্ভায় চলে আসেন। এই সূত্রে তারাসুন্দরীর সাথে তাঁর
প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে
মিনার্ভার ম্যানেজার হন অপরেশচন্দ্র। এই সময়
মিনার্ভা আর্থিক
অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফলে
মিনার্ভা তাদের নাট্যদলকে পুরী ও কটকে পাঠায়। অপরেশ
তখন
কলকাতায়এবং উড়িষ্যায় প্রয়োজনানুসারে অভিনয় করেছেন। এই সময় গিরিশচন্দ্রের 'সিরাজদ্দৌলা'
মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই নাটকে সিরাজের ভূমিকায় অপরেশ নির্বাচিত হন।
কিন্তু গিরিশচন্দ্রের ইচ্ছায় এই চরিত্র দেওয়া হয় দানীবাবুকে। পরে এই অভিমান থেকে
তিনি
মিনার্ভা ত্যাগ করেন।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি
স্টার
থিয়েটার যোগ দেন। এখানে তিনি 'পলাশীর প্রায়শিচত্ত' নাটকে
মোহনলালের চরিত্রে অভিনয় করে সুখ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু অমৃতলালের সাথে বনিবনা না
হওয়ায় তিনি স্টার ত্যাগ করেন এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস সদ্য-প্রতিষ্ঠিত
কোহিনুর থিয়েটারে সহকারী ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। এই নতুন প্রতিষ্ঠানে তিনি নানা
প্রতিষ্ঠান থেকে স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আনার চেষ্টা করেন। তিনি ন্যাশনাল
থিয়েটার থেকে তারাসুন্দরীকে নিয়ে আসেন। এই সময় তিনি তারাসুন্দরীর সাথে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস শুরু
করেন। এই সময় 'চাঁদবিবি' ও 'ছত্রপতি' নাটকে অভিনয় করেন। কিন্তু 'দুর্গেশনন্দিনী'র
ভূমিকা নিয়ে মতান্তর হওয়ায়, অক্টোবর মাসে তিনি এবং তারাসুন্দরী
স্টার
থিয়েটারে যোগদান করেন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষেত্রমোহন ও মণীন্দ্রমণ্ডল কোহিনূর ত্যাগ
করেন। ফলে তারাসুন্দরী-সহ অপরেশকে পুনারায় কোহিনূরে ফিরিয়ে আনা হয়। ১১ ডিসেম্বর
অপরেশ কোহিনূর থিয়েটারের অস্থায়ী ম্যানেজার হন। এই বছরে তাঁর স্ত্রী শিখরবাসিনীর গর্ভে কন্যা মমতা এবং তারসুন্দরীর গর্ভে নির্মল নামক
পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তারাসুন্দরীর আর্থিক সহায়তায় অপরেশচন্দ্র 'বাণী থিয়েটার' নামে
একটি ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি এম্পায়ার মঞ্চে আমেরিকান
টুরিষ্টদের সম্মানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একটি নাটক পরিবেশন করেছিল। প্রায় আট মাস
এই থিয়েটার প্রচুর লোকসান দেয়। এরপর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে এঁরা
মিনার্ভা
থিয়েটার -এ যোগ দেন।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে অপরেশ কোহিনুরে ফিরে আসেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭
আগষ্ট গিরিশচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষার্থে সম্মিলিতভাবে 'বলিদান' অভিনয় হয়। এরপর কোহিনুর
কিনে নিয়েছিল মিনার্ভার মনোমোহন পাঁড়ে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর অপরেশচন্দ্রের পিতা বিপ্রদাসচন্দ্রের মৃত্যু হয়।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬
জানুয়ারি অমরেন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর স্টারের ম্যানেজার হন অমৃতলাল বসু।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে অপরেশচন্দ্রের বড় মেয়েকে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার নৃত্যগোপাল
চট্টোপাধ্যায়ের সাথে বিবাহ দেন। এই বিবাহের জন্য অপরেশ মিনার্ভার লেসি
উপেন্দ্রকুমারের কাছ থেকে ২৩ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর গিরিমোহন মল্লিককে নতুন করে লীজ দেন স্টার থিয়েটার
কর্তৃপক্ষ। এই সময় গিরিমোহন মল্লিক
মিনার্ভা থিয়েটার
অপরেশকে থিয়েটারের ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। এই সূত্রে
অপরেশচন্দ্রের সঙ্গে
মিনার্ভা থিয়েটার থেকে চলে এসেছিলেন তারাসুন্দরী ও নীরদাসুন্দরী। নতুন নাটক প্রস্তুতির জন্য
কয়েকদিন অভিনয় বন্ধ থাকার পর, ১৪ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হয়েছিল ক্ষীরোদপ্রসাদ
বিদ্যাবিনোদের 'কিন্নরী'। উল্লেখ্য, এটি আগেই ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগষ্ট
অপরেশচন্দ্র মিনার্ভায় অভিনয় করেছিলেন। স্টারে অভিনয় করেছিলেন- তারকনাথ পালিত (সুধন),
তারাসুন্দরী (উৎপল), বসম্তকুমারী (মকরী), নীরদাসুন্দরী (চকুরিশ)। এই সময় স্টারের
পাশাপাশি মিনার্ভা থিয়েটারের
'কিন্নরী' অভিনয় চলছিল।
এবং একসঙ্গে দুই থিয়েটারে 'কিন্নরী' হাউসফুল হতে থাকল। এই সময় মিনার্ভার মালিক
উপেন্দ্রনাথ মিত্র স্টারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দর ২রা মার্চ আদলতের আপত্তিতে স্টার থিয়েটারেএ 'কিন্নরী'র
অভিনয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এই সময় অপরেশ মুখোপাধ্যায়,
তারাসুন্দরী প্রবোধচন্দ্র গুহের সহায়তায় স্টার থিয়েটারের মঞ্চ ভাড়া
নিয়ে মঞ্চাভিনয় চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন পর, অপরেশ মুখোপাধ্যায় এবং
প্রবোধচন্দ্র গুহ
আর্ট থিয়েটার
লিমিটেড নামে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এই কোম্পানি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে
বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের পরিচালক
ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এঁদের সাথে যুক্ত হন সতীশচন্দ্র সেন, কুমারকৃষ্ণ
মিত্র, হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চন্দ। এই যৌথ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হন
অপরেশ মুখোপাধ্যায় এবং সেক্রেটারি হন প্রবোধচন্দ্র গুহ। এই প্রতিষ্ঠানের আংশিক
মালিক হিসেবে থাকেন তারাসুন্দরী।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে স্টার
থিয়েটারের মঞ্চ<
লীজ নেওয়া হয়েছিল। বাংলা নববর্ষ
থেকে মাসিক ১২০০ টাকায় ভাড়া ধার্য হয়েছিল। এছাড়া দিতে হয়েছিল সেলামিবাবদ গিরিমোহনকে
৯২৫০ টাকা, স্টারের মালিকদের ৯০০ টাকা এবং এক রাত্রির সম্মান-অভিনয় বাবদ ৭০০ টাকা।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সেলামি দিতে হয়েছিল আরও ৫০০০ টাকা। এই টাকার যোগান দিতে গিয়ে
অপরেশচন্দ্র মঞ্চের জন্য নাটক লেখা শুরু করেন। এই বছরেই তারাসুন্দরীর টাকায়
ভবনেশ্বর মন্দির সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরি করেন। এখানে তাঁর উদ্যোগে
তৈরি করা হয়েছিল 'রাখালকুঞ্জ'।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ভুবনেশ্বরের এই জমি পুত্র হরিহরণের নামে লিখে দেন। এই বছরের
জানুয়ারি মাসের শেষে উপেন্দ্রকুমার পূর্বে-কৃত ঋণের জন্য উকিল নোটিশ পাঠান। পরে
উভয়ের মধ্যে আপোষ-মীমাংশা হলে ফেব্রুয়ারি থেকে মাসিক ১৫০ টাকা কিস্তি নির্ধরাণ করা
হয়। এর কয়েক মাস পর, তিনি উপেন্দ্রকুমার সমুদয় (১৯০০ টাকা) পাওনা পরিশোধ করে
দেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে অপরেশচন্দ্র
আর্ট থিয়েটার কে তাঁর অধিকারে থাকা স্টার থিয়েটারের
আসবাবপত্রসহ তাঁর সকল স্বত্ব বিক্রয় করে দেন। এই বিক্রয় থেকে তিনি পান ২৫০০০ টাকা
এবং ১০০ টাকার ২৫০টি শেয়ার। এরপর
আর্ট থিয়েটারের মালিক হন সতীশ সেন, কুমারকৃষ্ণ
মিত্র, হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র।
প্রবোধচন্দ্র গুহ এই দলের নতুন সেক্রেটারি হন। এই সময় ৫০০ টাকা বেতনে অপরেশচন্দ্র
আর্ট থিয়েটারের ম্যানেজার হন।
এই বছরে অপরেশচন্দ্রের দ্বিতীয়া কন্যা তমসার (শিখরবাসিনীর
কন্যা) বিবাহ দেন কালীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে।
এই বিবাহ নিয়ে তারাসুন্দরীর সাথে তাঁর মতান্তর হয়। এছাড়া স্টারের স্বত্বাধিকার
ত্যাগের বিষয়টিও জড়িত ছিল। ফলে আর্ট থিয়েটারের সাথে তারাসুন্দরীর সম্পর্ক শিথিল হয়ে
পড়ে। এরই মধ্যে অপরেশচন্দ্র তাঁর 'কর্ণার্জুন' নাটক শেষ করে মঞ্চস্থ করার
প্রস্তুতি নেন। এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন।
মূলত এই নাটকের মধ্য দিয়েই 'আর্ট
থিয়েটার' তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরে করে। এই নাটকের বিভিন্ন অভিনয় করেছিলেন-
কর্ণ-তিনকড়ি চক্রবর্তী, অর্জন-অহীন্দ্র চৌধুরী, শকুনি-নরেশ মিত্র,
পরশুরাম-অপরেশচন্দ্র, বিকর্ণ- দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্ম-কৃষ্ণভামিনী,
নিয়তি- নীহারবালা, দ্রৌপদী-নিভাননী। এছাড়া ইন্দু মুখোপাধ্যায়, তুলসী
বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরমা প্রভৃতিও অংশ গ্রহণ করেন। পরে গিরিশচন্দ্রের পুত্র দানীবাবু
এই নাটকে যোগ দিয়ে নানা ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এই সময় শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় এবং নির্মলচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'রূপ ও রঙ্গ' নামক সাহিত্যপত্র
প্রকাশিত হতো। এই এই পত্রিকার কার্যত সম্পাদক ও লেখক ছিলেন অপরেশচন্দ্র। ১৯২৪
খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে পুত্র নির্মলচন্দ্রের মৃত্যু হয়।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে কর্ণার্জুনের শততম রজনী অভিনয় হয়। এই সময় নাটোরের মহারাজা
জগদিন্দ্রনাথ তাঁকে 'নাট্যবিনোদ' উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অপরেশচন্দ্র ভালুকপাড়ার বাসা ছেড়ে মানিকতলার একটি বাড়িতে। এই
বাড়িতে ছাপা হতো 'রূপ ও রঙ্গ'। এই বছরের তিনি জামতাড়ায় একটি জমি স্ত্রীর নামে
কিনে, সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের ভবন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২৭
খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে অপরেশচন্দ্র
আর্ট থিয়েটারের পাশাপাশি মনোমোহন লীজ নেন। এর
ফলে তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত মনোমোহন লীজ নিয়ে
চালিয়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যান। ফলে তিনি এবং
আর্ট থিয়েটার করনানি ইন্ডস্ট্রিয়াল
ব্যাংক থেকে শতকরা ১২টাকা সুদে ১৫০০০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এই বছরে তিনি বরাহনগর
কুটীর ঘাটে।
১৯৩০
খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
চিরকুমার সভা
আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি রসিকের
ভূমিকায় অভিনয় করে অনেকে প্রশংসা লাভ করেন। এই অভিনয়ের সূত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'রসিকবাবু'
উপাধি দিয়েছিলেন। এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাসা বদল করে জয়মিত্র স্টিটে চলে
আসেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে গৌরহরির বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে কনিষ্ঠা কন্যা আলোকময়ীর
বিয়ে দেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে করনানি ইন্ডস্ট্রিয়াল ব্যাংক আর্ট থিয়েটারের উপর
অধিকার লাভ করে। এই থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সদস্য প্রবোধকুমার
গুহ আগষ্ট মাসে
আর্ট থিয়েটার ছেড়ে চলে
গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে দানীবাবু
তথা সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের সহযোগিতায়
আর্ট থিয়েটার সচল ছিল। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮
নভেম্বর দানীবাবুর মৃত্যুর পর
আর্ট থিয়েটার দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় দেনার দায়ে
আর্ট থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৪
খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে অপরেশ মুখোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে
আর্ট থিয়েটারও চিরদিনের
জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এই আর্ট থিয়েটার প্রায় টানা দশ বছরে অপরেশচন্দ্রের ২১টি, রবীন্দ্রনাথের ৯টি এবং
অন্যান্য নাট্যকারদের ২২টি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। সব মিলিয়ে নাটকের সংখ্যা ছিল ৫২টি।
এর ভিতরে অপরেশচন্দ্রের যে সকল নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, সেগুলো হলো-
১৯২৩ থেকে আর্ট থিয়েটার থেকে তাঁর যে সকল নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, সেগুলো হলো-
- ১৯২৩:
কণাজুন। ৩০ জুন
- ১৯২৪: ইরাণের রানী।
মূলকাহিনী: অস্কার ওয়াইল্ডের “দি ভাচেস অফ পাড়ুয়া'। বাংলা নাট্যরূপ
অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১ জানুয়ারি।
- ১৯২৫: বন্দিনী।
২৫ ডিসেম্বর।
- ১৯২৬ শ্রীকৃষ্ণ।
১৫ মে । চণ্ডীদাস ২৫ ডিসেম্বর।
- ১৯২৭: মগের মুলুক।
৩ ডিসেম্বর
- ১৯২৮: ফুল্লরা।
২১ অক্টোবর।
- ১৯২৯: মন্ত্রশক্তি।
কাহিনি: অনুরূপা দেবী।
নাট্যকার: অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ২৩ নভেম্বর।
- ১৯৩১: মুক্তি। ১ জানুয়ারি
- ১৯৩২:
পোষ্যপুত্র।
কাহিনি: অনুরূপা দেবী।
নাট্যকার: অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ১২ মার্চ। এই নাটকে
শ্যামাকান্তের ভূমিকায় দানীবাবু অভিনয় করে প্রচুর প্রশংসা লাভ করেন।
বিদ্রোহিনী।
নাট্যাকর: অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ৫নভেম্বর।
রচিত গ্রন্থাবলী
- পোষ্যপুত্র (রূপান্তর, মূল: অনুরূপা দেবী;১৯১১)
- রঙ্গিলা (১৯১৪)
- মন্ত্রশক্তি (রূপান্তর, মূল: অনুরূপা দেবী;১৯১৫)
- রামানুজ (১৯১৬)
- মা (রূপান্তর, মূল: অনুরূপা দেবী;১৯২০)
- কর্ণার্জুন (১৯২৩)
- চণ্ডীদাস (১৯২৬)
- অসমাপ্ত আত্মজীবনী- রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর
গ্রন্থসূত্র:
- 'চণ্ডীদাস।
অপরেশ মুখোপাধ্যায়। প্রকাশক শ্রীহরিদাস। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
- রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর। অপরেশ মুখোপাধ্যায়। প্রকাশক: অরিজিৎ
কুমার। ১৩৪৬