গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
(১৮৭৯-১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ)
বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ।

১২৮৬ বঙ্গাব্দের ২৫ পৌষ (১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ শাস্ত্রী সঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী এবং গীতিকার। মায়ের নাম কৃপাময়ী দেবী। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন পিতামাতার তিন সন্তানের মধ্যে মধ্যম। তাঁর বড় ভাই রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছোট ভাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গীতে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।

তাঁর সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়েছিল পিতার কাছে। এরপর তিনি তাঁর বড় ভাই রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রী সঙ্গীত শেখেন।

অল্প বয়স থেকে পিতার সাথে বিষ্ণুপুর রাজদরবারে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। এই সময় বিষ্ণুপুরের মহারাজা রামকৃষ্ণ সিংহকে অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় গান শেখাতেন। মহারাজ গোপেশ্বরকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং মাঝে মাঝে গোপেশ্বরের কাছে গান শুনতেন। একবার মহারাজ গোপেশ্বরের ছবি আঁকা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে কলকাতায় ছবি আঁকা শেখার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সময় গোপেশ্বরের বয়স কম ছিল এবং ইংরেজি ভাষাটা বুঝতো না। তাই মহারাজ তাঁকে বিষ্ণুপুর ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। মহারাজ নিজে অপুত্রক ছিলেন। তাই তিনি  গোপেশ্বরকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহারাজের কাছে দত্তকপুত্রের পরিবর্তে 'ভিক্ষা-পুত্র' হিসেবে প্রদান করতে সম্মত হন। পরে মহারানী ভিক্ষাপুত্র হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন।

মহারাজের মৃত্যুর পর ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় আসেন। এই সময় তাঁর গান শুনে একজন ইংরেজ মুগ্ধ হন এবং মিনার্ভা থিয়েটারে তাঁর একক গানের আয়োজন করেন। এই আসরে কিশোর শিল্পী হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন। এরপর তিনি বিষ্ণুপুরে ফিরে যান।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পিতার কাছে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই বছরে তাঁর পিতার মৃত্যু হলে, তিনি সঙ্গীত শিক্ষার জন্য কলকাতা আসেন এবং সেকালের প্রসিদ্ধ খেয়াল শিল্পী গুরুপ্রসাদ মিশ্রের কাছে খেয়াল গানের পাঠ নেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন আসরে সঙ্গীত পরিবেশন করে সুখ্যাতি লাভ করেন।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ বৎসর বয়সে বর্ধমান রাজা তাঁর রাজসভায় সভাগায়ক হিসেবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান এবং এই পদ গ্রহণ করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) বর্ধমানের রাজার আনুকূল্যে তাঁর রচিত 'সঙ্গীতচন্দ্রিকা' (প্রথম ভাগ) প্রকাশিত হয়।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রতিভা দেবী (হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা) 'সঙ্গীত-সঙ্ঘ' নামে একটি সঙ্গীতবিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যায়তনে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য তিনি গোপেশ্বরকে আমন্ত্রণ জানান। গোপেশ্বর এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং বিদ্যায়তনে উচ্চ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা শুরু করেন।

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২১ বঙ্গাব্দ) তাঁর রচিত 'সঙ্গীতচন্দ্রিকা' (দ্বিতীয় ভাগ) প্রকাশিত হয়।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ (বৈশাখ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ (চৈত্র ১৩৬৯ বঙ্গাবব্দ) পর্যন্ত তিনি সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রকাশিকা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য ছিলেন।

বেনারস অল্ ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আলাবন্দে খাঁ ধ্রুপদে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। সঙ্গীতশাস্ত্রে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি 'সঙ্গীত নায়ক' উপাধি লাভ করেছিলেন। এছাড়া বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'স্বর-সরস্বতী' উপাধি প্রদান করেছিলেন।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থতালিকা

১. সঙ্গীতচন্দ্রিকা (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ)
২. রূপ ও আলাপ
৩. গীতমালা (১৩৩০)
৪. তানমালা (১৩৩২)
৫. সঙ্গীত লহরা


সূত্র :