ইন্দিরা গান্ধী
(১৯১৭-১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতের মধ্যে  প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জহরলাল নেহেরু ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মায়ের নাম কমলা কাউল। ইন্দিরা ছিলেন পিতামাত্র একমাত্র সন্তান।

ইন্দিরা শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বিদেশে। তিনি স্যুইজারল্যান্ডের বেকস্-এ ইকোলে নোভেল, জেনেভার ইকোলে ইন্টারন্যাশনা, অক্সফোর্ডের সামারভিল কলেজে, ব্রিস্টলের ব্যাডমিন্টন স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। এছাড়া ভারতের পুণে ও বোম্বাই-এর পিউপিল্স ওন স্কুল, এবং শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কংগ্রেসকে সাহায্য করার জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘বানর সেনা’। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধী পিতার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ তিনি বিয়ে করেন সাংবাদিক ফিরোজ গান্ধীকে। বিয়ের কিছুদিন পরই তারা কারাবন্দী হন এবং এলাহবাদের নৈনি কারাগারে তারা ৮ মাস বন্দী থাকেন।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগস্ট তাঁর প্রথম পুত্র রাজীব গান্ধী'র জন্ম হয়েছিল এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর জন্ম হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ব্রিটিশ শাসন থেকে। এই বছরে মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে তিনি দিল্লির দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে কাজ করেছিলেন। সে বছরই ইন্দিরার পিতা জহরলাল নেহেরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। তখন থেকেই ইন্দিরা প্রায় ছায়ার মত বাবার পাশে পাশে থাকতেন।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অপেশাগতভাবে জওহরলাল নেহরুর অফিস সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদার্স অ্যাওয়ার্ড-এ সম্মানিত হন। কূটনীতিতে বিচক্ষণতার জন্য ইতালির আইবেলা ডি এস্ট পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হন পরবর্তীকালে। এছাড়াও লাভ করেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির হোল্যান্ড মেমোরিয়াল প্রাইজ।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির জাতীয় সংহতি পরিষদের সভানেত্রীর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিযুক্ত হন সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সংসদীয় পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হন|

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্দিরার স্বামী ফিরোজ গান্ধী মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৬০-৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউনেস্কো-র ভারতীয় প্রতিনিধিদলেও তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্য ছিলেন।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জহরলাল নেহেরু মৃত্যুর পর ভারতের রাষ্ট্রপতি তাকে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। এই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ইন্দিরা এই মন্ত্রীসভায় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে লালবাহাদুর শাস্ত্রী'র আকস্মিক মৃত্যু হলে, ইন্দিরা অন্তর্বর্তী কালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়াও তিনি পরমাণু শক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পরমাণু শক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এই বছরে ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরএ নির্বাচনী প্রচারে গেলে তাঁর দিকে একটা পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এর ফলে তাঁর নাক ফেটে গিয়েছিল।

ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ওপিনিয়ন-এর এক জনমত সমীক্ষার নিরিখে ১৯৬৭ এবং ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পরপর দু’বার ‘বিশ্বের সেরা মহিলা’ খেতাবে সম্মানিত হন।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের জুন থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা বিপুল ভোটে দ্বিতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দান করেন। এই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে, ভারত জয় লাভ করে। ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছিল।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ পোল সার্ভের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। এই বছরেই প্রাণী ও জীবজন্তুর প্রতি তাঁর বিশেষ যত্নের স্বীকৃতিতে আর্জেন্টাইন সোসাইটি তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুন থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি মহাকাশ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শাসনামলে পশ্চিম বঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সশস্ত্র নকশালবাড়ি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এই বছরে তিনি ভারতরত্ন উপাধি পান। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিতে তিনি লাভ করেন মেক্সিকান অ্যাকাডেমি পুরস্কার।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখা মুজিবর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মধ্যে সম্পাদিত একটি দ্বি-পক্ষীয় আন্তর্জাতিক চুক্তি। এই চুক্তিতে মোট ১২টি অনুচ্ছেদ ছিল। এই চুক্তির ১১ সংখ্যক অনুচ্ছেদে সময়কাল উল্লেখ ছিল ২৫ বৎসর। কিন্তু ১০ম অনুচ্ছেদে ছিল, যে কোনো পক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে। বাংলাদেশের অনেকে এই মৈত্রী চুক্তিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেকে দাসত্বের চুক্তি হিসেবে প্রচার করেছিল। 
            দেখুন: মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি (১৯৭২)

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেওয়া হয় এফ .এ.ও.-র দ্বিতীয় বার্ষিক পদক। আর এই বছরেই শিখ রাজনৈতিক দল শিরোমনি আকালি ও অন্যান্য শিখ গ্রুপ আনন্দপুর সাহিব রেজুলেশন ঘোষণা করলে। যাতে অন্যান্য দাবিদাওয়ার মধ্যে পাঞ্জাব ও শিখদের জন্য ‘বিশেষ মর্যাদা’ দাবি ছিল। এই সূত্রে জার্নাল সিং বিন্দ্রাওয়ালের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। কিছু বিদ্রোহী শিখ গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাঞ্জাবে খালিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিজ্ঞা করে

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশের শান্তি শৃঙ্গখলা ফিরিয়ে আনার জন্য, জরুরী আইন জারী করেছিলেন। এর ফলে দেশে শৃঙ্খলা ফিরে এলেও তিনি জনপ্রিয়তা হারান।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নাগরী প্রচারিনী সভার সাহিত্য বাচস্পতি (হিন্দি) পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তাঁর দল হেরে যায়।

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলি এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মেডাক থেকে তিনি লোকসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে, তিনি রায়বেরিলি আসনটি ছেড়ে দেন। ১৪ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই বছর কিছু শিখ বিদ্রোহী একটি বাস থামিয়ে বাসের ছয়জন হিন্দু যাত্রীকে হত্যা করে। একই দিনে অন্য একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী একটি ট্রেনে দুইজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইন্দিরা পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার বাতিল করে প্রেসিডেন্টের শাসন চালু করেন।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পাঞ্জাবে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই সূত্রে শিখদের দমন করার জন্য তিনি সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে তলব করেন। এই বছরের জুন মাসে তাঁর আদেশে শিখদের পবিত্র ধর্মাশালা স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনী 'অপারেশন ব্লু স্টার' নামে একটি অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে সেনাবাহিনী সাফল্য দেখায় এবং ধীরে ধীরে শিখ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে শিখদের প্রধান আক্রেশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ইন্দিরা গান্ধী। বিদ্রোহীরা ইন্দিরাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর নতুন দিল্লির ১নং সফদরজঙ্গ রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের উদ্যানপথ ধরে হেঁটে যাবার সময়ে, তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষী সংবন্ত সিংহ এবং বিয়ন্ত সিংহ তাঁকে গুলি করে। ঘটনাস্থলে অন্যান্য দেহরক্ষীদের গুলিতে বিয়ন্ত সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। পরে সংবন্ত সিংহকে গ্রেফতার করা হয়।

এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই ইন্দিরাকে দিল্লির জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্রোপচার করে তার শরীর থেকে উনিশটি বুলেটের সাতটি বের করে নেওয়া হয়। চিকিৎসালয়ে নেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। ৩ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটের নিকটস্থ শক্তিস্থল নামক স্থানে তার সৎকারক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

স্বামী: ফিরোজ গান্ধী
সন্তান:

উল্লেখযোগ্য রচনা: