মনোমোহন বসু
১৮৩১-১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ
ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট
যাত্রাপালাকার নাট্যকার এবং এবং মঞ্চাধ্যক্ষ।
১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত ছোট জাগুলিয়ার বিখ্যাত বসু পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম দেবনারায়ণ বসু৷
প্রভাকর এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে
বাংলা সাহিত্য তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্যস্থ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন । পরে এই পত্রিকা পাক্ষিক এবং মাসিক রূপেও প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি পাঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিংহের উপর একটি তথ্যভিত্তিক জীবনী দুলীন রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
অভিনয় জগতে প্রবেশের শুরুর দিকে আখড়াই, পাঁচালী, কীর্তনাঙ্গের
এবং বাউলাঙ্গের গান রচনা করতেন। তৎকালীন যুগে যাত্রার মান খুবই নীচুস্তরে নেমে গিয়েছিল।
যাত্রার উন্নতিকল্পে আধুনিক থিয়েটার এবং প্রচলিত যাত্রাপালার
সংমিশ্রণে নতুন ধরনের নাটকের প্রবর্তন করেন। তিনি
চন্দন নগরে তাঁর একটি পেশাদারি যাত্রাদল গঠন করেছিলেন।
১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার বহুবাজার অঞ্চলে
'বহুবাজার নাট্যালয়'-এর প্রাথমিক পর্যায়ের নাট্য স্থাপিত হয়েছিল। এর প্রধান
উদ্যোগী ছিলেন বলদেব ধর ও চুনিলাল বসু। এঁদের উৎসাহ ও প্রেরণায় এবং
স্থানীয় যুবকবৃন্দের চেষ্টায়
বহুবাজারের ২৫নং বাঞ্চারাম অক্রুরের গলির
গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে প্রথমে অস্থায়ীভাবে একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। এই রঙ্গমঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা
ছিলেন মধ্যস্থ পত্রিকার সম্পাদক ও নাট্যকার
মনোমোহন বসু
। এই নাট্যালয়ে তাঁর রচিত প্রথম নাটক 'রামাভিষেক'
মঞ্চস্থ হয়েছিল।
১৮৭৪
খ্রিষ্টাব্দে বহুবাজারের ধনাবান ব্যক্তিদের
চেষ্টায় ও অর্থে ২৫ নং মতিলাল লেনে বহুবাজার
নাট্যাসমাজের স্থায়ী নাট্যশালা তৈরি হয় গোবিন্দ চন্দ্র
সরকারের বাড়িতে। এই নতুন নির্মিত স্থায়ীমঞ্চের নাম
রাখা হয়
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়।
এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন নীলকমল মিত্র এবং অপর কয়েকজন
ধনবান ব্যক্তি। পরিচালকমণ্ডলীর সম্পাদক ছিলেন
প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধায়। এই নতুন রঙ্গমঞ্চে প্রথম
অভিনীত হয়
মনোমোহন বসুর
'সতী' নাটক।
এই মঞ্চে তাঁর অপর নটক 'হরিশ্চন্দ্র'
মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৮৭৫ খ্রিচষ্টাব্দে।
এছাড়া ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে আরও ৪টি উল্লেখযোগ্য নাটকের নাম পাওয়া যায়। এগুলো
হলো- প্রণয় পরীক্ষা (১৮৬৯) পার্থপরাজয় (১৮৮১) রাসলীলা (১৮৮৯) আনন্দময়
(১৮৯০)
ইত্যাদি।
মনোমোহন বসু কাহিনির প্রাধান্য দিতে গিয়ে গানের সংখ্য কমিয়ে দিয়েছিলেন। এসব নাটকে তিনি
অশ্লীল সংলাপ এবং অপ্রয়োজনীয় ভাঁড়ামো বাদ দিয়েছিলেন। ফলে সুরুচির দর্শকদের দ্বারা
নাটকগুলো আদৃত হয়েছিল।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্যস্থ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে এই পত্রিকা পাক্ষিক এবং মাসিক রূপেও প্রকাশিত হয়েছিল।
এই বছরের ৭ই ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এই থিয়েটার
প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তাদের ভিতরে
বাগবাজার এমেচার থিয়েটার (শ্যামবাজার নাট্যসমাজ)-এর
গিরিশচন্দ্র
ব্যতীত সকলেই ছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা
হলেন- নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর
মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
এই থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিলেন মনোমোহন বসু,
অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, হিন্দুমেলার উদ্যোক্তা ও ন্যাশনাল
পেপার পত্রিকার সম্পাদক 'ন্যাশনাল” নবগোপাল মিত্র। নতুন
যুগের এই থিয়েটারকে স্বাগত করে তিনি বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে দীর্ঘ বক্তৃতা
দিয়েছিলেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র:
- বঙ্গীয় নাট্যশঠালার
ইতিহাস। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দির, ১৩৪৬
-
বাংলা থিয়েটারের গান। শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র। ইন্দিরা সংগীত-শিক্ষায়তন।
১৯৮২।
-
বাংলা থিয়েটারের পূর্বাপর। নৃপেন্দ্র সাহা। তূণ প্রকাশ। ১৯৯৯।
-
বাংলা নাটকের বিবর্তন। সুরেশচন্দ্র মৈত্র। মুক্তধারা। ১৯৭১