বাগবাজার এমেচার থিয়েটার/শ্যামবাজার
নাট্যসমাজ
খ্রিষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত একটি
নাট্যদল। এই নাট্যদলটির প্রতিষ্ঠাকালে
নাম রাখা হয়েছিল- বাগবাজার এমেচার থিয়েটার, পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল 'শ্যামবাজার
নাট্যসমাজ'।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দিকে
কলকাতার
বাগবাজার অঞ্চলের যুবক সম্প্রদায়ের একটি নাট্যদল। এই দলে ছিলেন-
গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামাধব কর, অরুণচন্দ্র হালদার। পরে এই দলে যুক্ত হয়েছিলেন
অর্ধেন্দুশেখর মু্স্তাফি। এঁরা প্রথম দিকে নাট্যদল তৈরি করতে সক্ষম হলেও অর্থাভাবে
কোনো মঞ্চ নির্মাণ করতে পারেন নি। এই সময় বাগবাজারের 'সখের যাত্রাদল'
মাইকেল মধুসূদন
দত্তের শর্মিষ্ঠা মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই দলের সাথে বাগবাজারের
এমেচার থিয়েটারের অভিনেতারা যুক্ত হয়ে হন। এই সময়
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
এই নাটকের জন্য কয়েকটি গান রচনা করে দেন।
১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি
নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেন। এই দলের প্রথম নাটকটি ছিল
দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার
একাদশী'। এই বছরের অক্টোবর মাসে শারদীয়া দুর্গাপূজার
সপ্তমী পূজার রাত্রে বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়ের পাড়ায়, প্রাণকৃষ্ণ
হালদারের বাড়িতে নাটকটি অভিনীত হয়। প্রথম প্রচেষ্টায় এই অভিনয় ততটা সফল হয় নি। এরপর
অক্টোবর মাসের কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার রাতে
শ্যামপুকুরের নবীনচন্দ্র সরকারের বাড়িতে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। দ্বিতীয় রাত্রির এই
অভিনয়ের পর এই দলটি কিছুটা সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়।
নাটকটির চতুর্থ অভিনয় ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। এই অভিনয়টি সম্পন্ন হয়েছিল
রায়বাহাদুর রামপ্রসাদ মিত্রের বাড়িতে। এই বাড়িতে স্থায়ী মঞ্চ না থাকায় অস্থায়ী
মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। দর্শকের সারিতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন
দীনবন্ধু মিত্র। এই রাত্রের যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা হলে-
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
(নিমচাঁদ), অর্ধেন্দূশেখর (কেনারাম), নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (অটল), ঈশান
নিয়োগী (জীবনচন্দ্র), মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (নকড়), নীলকণ্ঠ গাঙ্গুলি (রামমাণিক্য),
অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (কুমুদিনী), মহেন্দ্রনাথ দাস (সৌদামিনী), রাধামাধব কর (কাঞ্চন),
নগেন্দ্রনাথ পাল (নটী)। নাটকটির অভিনয়ের প্রশিক্ষক ছিলেন-
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
এবং সহ-প্রশিক্ষক ছিলেন অর্ধেন্দূশেখর এই নাটকটি মোট সাতবার অভিনীত
হয়েছিল।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের দুর্গাপূজার সময় চোরাবাগানের লক্ষ্মীনারয়াণ দত্তের বাড়িতে 'সধবার
একাদশী' নাটকের সর্বশেষ অভিনয় হয়েছিল। এই নাটকের পরে অভিনীত হয়েছিল- দীনবন্ধু
মিত্রের 'বিয়ে পাগলা বুড়ো'। এই বছরে
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ও
অক্ষয়চন্দ্র সরকারের উদ্যোগে চুঁচুড়ার মল্লিক বাড়িতে
'লীলাবতী' অভিনীত হয় এবং তা প্রশংসিত হয়। এরই সূত্রে বাগবাজার এমেচার থিয়েটার 'লীলাবতী'
মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে, শ্যামবাজারের
রাজেন্দ্রলাল বাড়িতে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই সময় এই নাট্যদলের নতুন নাম দেওয়া হয়-
শ্যামবাজার নাট্যসমাজ। প্রথম রাত্রির সফল অভিনয়ের পর নাটকটির এতটাই প্রশংসিত হয়েছিল
যে, পরপর কয়েকটি শনিবার তা একই মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল। পরে দর্শকদের জায়গা দেওয়া
অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য এঁরা ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট' দেখে
প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এই নাটক দেখার জন্য টিকেট বিক্রয়ের কথা ভাবা
হয়েছিল।
এই সূত্রে এই নাট্যদলের উদ্যোক্তরা পেশাদার নাট্যদল ও মঞ্চের কথা ভাবা শুরু
করেন। এই ভাবনা থেকে এঁদের উদ্যোগে ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্ভব হয়েছিল।
এই নতুন দল তৈরির সময় টিকিট বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
গিরিশচন্দ্র
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে উপযুক্ত সাজসরঞ্জাম
ব্যতীত ন্যাশনাল থিয়েটারের নামে টিকিট বিক্রয় করাট যথার্থ হবে না। কিন্তু দলের
অন্যান্য সদস্যরা
গিরিশচন্দ্র
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ মত দিলে তিনি দলত্যাগ করেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর
ন্যাশনাল থিয়েটার উদ্বোধন হয় এবং এর মধ্য দিয়ে
'বাগবাজার এমেচার থিয়েটার বা'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ'-এর বিলুপ্তি ঘটেছিল।
সূত্র:
- আমার কথা। বিনোদিনী দাসী। কথাশুল্প প্রকাশ। কলকাতা। পৌষ ১৩৬১
- গিরিশ রচনাবলী। সাহিত্য সংসদ। কলিকাতা। ১৯৬৯।
- বঙ্গীয় নাট্যশঠালার ইতিহাস। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দির, ১৩৪৬
-
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস।
দর্শন চৌধুরী। পুস্তক বিপনী
কলকাতা ১৯৯৫।
- বাংলা থিয়েটারের গান। শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র। ইন্দিরা সংগীত-শিক্ষায়তন।
১৯৮২।
- বাংলা থিয়েটারের পূর্বাপর। নৃপেন্দ্র সাহা। তূণ প্রকাশ। ১৯৯৯।
- বাংলা নাটকের ইতিবৃ্ত্ত। হেমেন্দ্র নাথ
দাশগুপ্ত
-
বাংলা নাটকের ইতিহাস। অজিতকুমার ঘোষ
- বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস। আশুতোষ ভট্টাচার্য
- বাংলা নাট্যসাহিত্যের পূর্ব্ব-কথা। শ্রীশরচ্চন্দ্র ঘোষাল। নারায়ণ [পৌষ ১৩২১ বঙ্গাব্দ]
- বাংলা নাটকের বিবর্তন। সুরেশচন্দ্র মৈত্র। মুক্তধারা। ১৯৭১
-
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত সপ্তম খণ্ড। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়