নিবারণচন্দ্র ঘটক (১৮৮৭-১৯৬০)-এর মূর্তি, সিয়ারসোল, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে মার্চ ভারতের বর্ধমান জেলার সিয়ারজোলে
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইন্দ্রনারায়ণ ঘটক
ছিলেন সিয়ারসোল রাজ এস্টেটের কর্মচারী।
মায়ের নাম মৃগনয়না দেবী।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করেছিলেন সিয়ারজোলে।
পরে তিনি ভর্তি হন হুগলী মহসীন কলেজে। এরপর কিছুদিন লেখাপড়া
করেছিলেন বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ঝাউপাড়া গ্রামের
মাইনিং স্কুলে।
হুগলী মহসীন কলেজে ড়ার সময় তিনি প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা
জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে বিপ্লবী দলের
সক্রিয় সদস্য হন। ঝাউপাড়া গ্রামে বাস করতেন তাঁর মাসিমা দুকড়িবালা দেবী। তিনি
নিবারণকে খুব স্নেহ করতেন। এই
সূত্রে নিবারণ প্রায়ই তাঁর মাইনিং স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মাসিমার বাড়িতে আসতেন। এক সময়
দুকড়িবালা বোনপোর সঙ্গীসাথী ও তাঁর আচরণে সন্দিহান হয়ে পড়েন। একদিন তাঁর হাতে
গণেশ দেউস্করের 'দেশের
কথা' বই দেখে সন্দেহ করেন যে, নিবারণ বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছেন। প্রথম দিকে দুকড়িবালা দেবী
বোনপোকে বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ করতে বাধা দিলেও, এক সময় তিনি নিজেই বিপ্লবী হয়ে
যান এবং তিনি নানাভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে থাকেন।
এই সময় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, কলকাতায় ক্ষুদিরামের গ্রেফতারকারী নন্দলাল
ব্যানার্জিকে কলকাতায় হত্যা করে সিয়ারজোল রাজবাড়িতে কর্মচারী হিসেব যোগদান করেন।
তিনি রাজবাড়িতে যোগাদান করেছিলেন রণেন গাঙ্গুলী ছদ্মনামে। সিয়ারজোলে এই বিপ্লবীর
সাথে গোপনে নিবারণ বিপ্লবী দলের কাজ শুরু করেন। পড়ে তিনি সিয়ারজোল
রাজ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে
যোগদান করেন। এই সময়,
কাজী নজরুল ইসলাম
সিয়ারজোল রাজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি
বিদ্যায়তনের পাঠ দানের পাশাপশি বিপ্লবী ভাবধারায় নজরুলকে
অনুপ্রাণিত করেন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগষ্ট রডা কোম্পানী থেকে
৫০টি জার্মান মসার পিস্তল ও কার্তুজ কলকাতায় পাঠানো হয়।
বিপ্লবীরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে এই অস্ত্র লুট করে। এই অস্ত্রের কিছু অংশ দুকড়িবালা দেবী
কাছে রাখেন। এই সময় দুকড়িবালা দেবী নিবারণ ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের কাছ থেকে
অস্ত্রচালনা শিক্ষা শেখেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পুলিশ দুকড়িবালা দেবীর
বাড়ি থেকে এসকল অস্ত্র উদ্ধার করে। এই সময় সিআইডি অফিসার সুবোধ চক্রবর্তী এর সাথে
জড়িতদের নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করলে, দুকড়িবালা দেবী সমস্ত দায় নিজের উপর নেন।
পুলিশী দুকড়িবালা দেবীকে গ্রেফতার করেন এবং এরপর তদন্তের সূত্রে নিবারণ ও অন্যান্য
সহযোগীরা ধরা পড়েন। নিবারণ ঘটক সিয়ারজোল থেকে গ্রেফতার হন- ৮ জানুয়ারি ১৯১৭
(মঙ্গলবার, ২৪ পৌষ ১৩২৪)। এই অবস্থায় বিদ্যালয়ের পরিচালন
কমিটি নিবারণ ঘটককে স্কুল থেকে বরখাস্ত করে।
এই শিক্ষকের সাথে
নজরুলে যুক্ত থাকার জন্য, তাঁর মাসিক বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সাথে বিপ্লবী
দলের সাথে সম্পৃক্ততা আছে কিনা তার তদন্ত শুরু হয়।
নিবারণের সাথে নজরুলের সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্ত শেষ
হয় ২রা মে (বুধবার ১৯ বৈশাখ ১৩২৪)। এই মামলায় নজরুলের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না
হওয়া, তাঁকে পুনরায় বৃত্তি প্রদান করা শুরু হয়।
বিচারে নিবারণ ঘটকের পাঁচ বছর এবং দুকড়িবালা দেবীর তিন বছর কারাবাস হয়। জেলে ভালো
আচরণের জন্য নিবারণ ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে মুক্তি
লাভ করেন।
জেল থেকে মুক্তি লাভের পর, চুঁচুড়ায় জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, ভূপতি মজুমদার, মহাকাল
মুখোপাধ্যায়ের সাথে যোগাযোগ করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসকল বিপ্লবীরা হুগলী 'জাতীয়
বিদ্যামন্দির' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নিবারণ চুচূড়া থেকে প্রায়ই
হুগলীতে সাংগঠনিক কাজে আসতেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে নিবারণ চুঁচূড়ার দেশবন্ধু হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগাদন করেন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এই সময় প্রায়ই
অসুস্থ থাকতেন। পরবর্তী ১৬ বৎসর তিনি প্রায় অসু্স্থার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ঝাউগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।