(১৮২৬-১৮৯৯)
বাঙালি শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক।
১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর চবিবশ পরগণা জেলার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম ছিল নন্দকিশোর রামমোহন রায়। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে তিনি কলকাতায় আসেন এবং কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন।
১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি হিন্দু কলেজ-এর [কলকাতা] উচ্চতর বৃত্তি লাভ করেন। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা এবং সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। তবে ছাত্র জীবনে একবার তিনি পানাসক্ত হয়ে পড়েন। ফলে অসুস্থ হয়ে আগেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন।
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। এ সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদের দায়িত্ব দেন।
১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থতার কারণে তিনি এই কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ব্রাহ্মসমাজের উপাসনার সময়ে প্রকাশ্যে পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের একত্রে বসা উচিত কিনা, এ প্রশ্নে ব্রাহ্মসমাজ যখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সূত্রে কেশব সেন-পরিচালিত অংশ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। আর দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন মূল রক্ষণশীল অংশের নাম হয় আদি ব্রাহ্মসমাজ। আদি ব্রাহ্মসমাজে রাজনারায়ণ কিছুকাল প্রধান আচার্য হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দেশাত্মবোধ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তায় আগাগোড়া নিমজ্জিত রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুরে 'জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা' এবং বেশ কয়েক বছর পরে কলকাতায় সঞ্জীবনী সভা নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বাজাত্যবোধ এবং জাতীয়তাবোধ উদ্রেক করার জন্যে নবগোপাল মিত্র কর্তৃক স্থাপিত হিন্দু মেলাতেও তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। তরুণ রবীন্দ্রনাথসহ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্য পুত্ররাও এ সভার সঙ্গে যুক্ত হন।
বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শ্রোতাদের অনেককেই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা নামক বক্তৃতায়, তিনি হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেন। উল্লেখ্য দেবেন্দ্রনাথ সাধারণত কোনো জনসভায় না গেলেও তিনি এই বক্তৃতায় সভাপতিত্ব করেন।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অনুষ্ঠিত হিন্দু মেলার উদ্বোধক ছিলেন।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লিটনের দেশীয় ভাষা সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগদান করেন।
১৮৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাজনারায়ণ 'বৃদ্ধ হিন্দুর আশা' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তাতে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দুদের একত্রিত করে একটি সংগঠনের অধীনে আনার আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় এ প্রতিষ্ঠান গঠিত না হলেও, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাঁর মৃত্যুর পরে মোটামুটি একই উদ্দেশ্য নিয়ে, ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু মহাসভা স্থাপিত হয়েছিল।
১৮৫০-এর দশকে তিনি বিধবাবিবাহের উৎসাহী একজন সমর্থক ছিলেন। তাছাড়া, ১৮৬০-এর দশকে তিনি 'মদ্যপান নিবারণী সভা' গঠন করেন। মেদিনীপুরে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয়, একটি গ্রন্থাগার, একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র এবং একটি বির্তক সভা স্থাপন করেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্জীবনী সভার তিনি সভাপতি ছিলেন। এই সভার প্রতিষ্ঠার
সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী প্রথম
খণ্ডে (ভূর্জপত্র, ১৩৮৯, ১ বৈশাখ। পৃষ্ঠা ৩০৫) 'সঞ্জীবনী সভা' আয়ুষ্কাল
সম্পর্কে লিখেছেন '...অনুমান করা যায় সঞ্জীবনী সভার আয়ুষ্কাল মোটামুটি
ছ'মাস -পৌষ ১২৮৩ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪ পর্যন্ত বিস্তৃত।'
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
- হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)
- সে কাল আর এ কাল (১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দ)
- হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী কলেজের ইতিবৃত্ত (১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)
- বাঙ্গলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮ খ্রিষ্টাবব্দ)
- বিবিধ প্রবন্ধ (১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ)।
বৃদ্ধ হিন্দুর আশা (১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) প্রধান।
তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে তাঁর আত্মজীবনী 'রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত' প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর জীবন এবং সময়ের নির্ভরশীল বর্ণনা দেন। এসব গ্রন্থ ছাড়াও, তিনি ব্রাহ্মধর্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে কয়েকটি ইংরেজি ভাষায় রচিত ছিল।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যবরণ করেন।