জিল্লুর রহমান, মোহম্মদ
বাংলাদেশের ১৮তম রাষ্ট্রপতি, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মেহের আলী মিঞা (প্রখ্যাত আইনজীবী ও তৎকালীন ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য।

জিল্লুর রহমান ময়মনসিংহ জেলা শহরে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভৈরব কেবি হাইস্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ভর্তি হন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবর রহমান-এর সান্নিধ্যে আসেন। এবং ধীরে ধীরে
আওয়ামী লীগ-এর রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এই বৎসরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেন। ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়। এই বৎসরে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিশোরগঞ্জ
আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুন তিনি আইভি রহমান-কে বিবাহ করেন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। 
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দফা আন্দোলন তিনি বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণ-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং 'জয় বাংলা' পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করেন এবং তাঁর অবর্তমানে তাঁর ২০ বছর কারাদণ্ড দেয়। একই সময় তাঁর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু দেশে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরলে, বঙ্গবন্ধু 
আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি হন এবং জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক ছিলেন।  ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর, প্রায় চার বছর জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে  খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচিত হন। সাংসদ থাকাকালে তৎকালীন বিএনপি সরকার তাঁকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করে কারগারে পাঠায়।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচিত হন।

২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে
আওয়ামী লীগ-এর সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান-এর সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী আইভি রহমান মৃত্যুবরণ করেন।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী (এলজিআরডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারি হয় এবং তৎকালীন ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৬ জুলাই রাতে
আওয়ামী লীগ-এর সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে, জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগ-এর হাল ধরেন। দীর্ঘ ১১ মাস শেখ হাসিনার জেলজীবন এবং চিকিৎসার জন্য আরও প্রায় ছয় মাস দেশের বাইরে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জিল্লুর রহমান দলকে ঐক্যবদ্ধ এবং দলের কার্যক্রম সক্রিয় রাখেন রাখেন।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই নির্বাচনে ষষ্ঠবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। নবম জাতীয় সংসদে জিল্লুর রহমান প্রথমে সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন। পরে বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ১৮তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি শপথ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের শারীরীক অসুস্থায় ভুগছিলেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর শরীর ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে। এরই মধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মার্চ মাসের প্রথম দিকে তিনি চিকিৎসার জন্য (ফুসফুসের সংক্রমণ) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন। একই সাথে  বৃক্ক ও মুদ্র প্রদাহ জনীত অসুবিধার জন্য এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতেলে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ-এ। এই হাসপাতালেই ২০ মার্চ সন্ধ্যা ৬.৪৭ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পরিবার
স্ত্রী : আইভি রহমান। (২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে
আওয়ামী লীগ-এর সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান-এর সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী আইভি রহমান মৃত্যুবরণ করেন।)
সন্তান : নাজমুল হাসান প্রাপন (পুত্র)
          তানিয়া, ময়না (কন্যা)


সূত্র :
শিশু-বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। জুলাই ১৯৯৬।
বাংলাপেডিয়া:
http://www.banglapedia.org/httpdocs/HTB/101797.htm
http://en.wikipedia.org/wiki/Ziaur_Rahman