উদাসী ভৈরব
[কৈলাশ। উষার সাথে সাথে গেয়ে ওঠে বনের পাখী । ধ্যানস্থ শিবের সম্মুখে সতী, যোগিনী ও ভৈরবীগণ সহ, শিবের ধ্যানভঙ্গের আশায় গাইছেন।]ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক
গান- অরুণ ভৈরব । বসন্ত থেকে ভৈরোঁতে
জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে [তথ্য]
নিতাই × × × ×
গীতা × × × ×
ইলা × × × ×
(ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিক কনটিনিউস)
শিব। |
(ধ্যান ভঙ্গ হইয়া) এ-কি! সহসা চিত্ত আমার চঞ্চল হয়ে উঠল কেন? কোন শিবভক্ত আমায় স্মরণ করল? কে ? মহাদেবী সতী ? এই স্নিগ্ধ শান্ত প্রভাতে, ভৈরবী যোগিনী সাথে-আমার ধ্যান ভাঙ্গাতে কেন এল, দেবী? |
সতী। | প্রভু, বহুদিন পিতার আলয়ে যাইনি; তাই যেতে বড় সাধ হয়েছে। |
শিব। |
(হাসিয়া) এই কথা কেন দেবী? কিন্তু এত ত্বরা কেন? আর কিছু দিন যেতে দাও, তারপর একদিন আমরা দু'জনেই একত্রে যাবো। |
সতী। |
না প্রভু! সহসা আমার মন বড় উতলা হ'য়েছে, তাই আজই তোমার কাছে অনুমতি ভিক্ষা করতে এসেছি। |
শিব। |
কিন্তু সতী। ভেবে দেখো, তোমা-বিহনে এই কৈলাসপুরী অন্ধকার হ'য়ে যাবে, কৈলাসের এ আনন্দ আর থাকবে না। এ-আনন্দপুরী অন্ধকার করে কেমন ক'রে যাবে দেবী? |
সতী। | (একটু মৌন থাকিয়া) কিন্তু, মন যে মানে না প্রভু। |
শিব। | হুঁ, কিন্তু কেন এ চঞ্চলতা! আরও কোন সংবাদ আছে কি? |
সতী। | হ্যা, দেব। পেয়েছি এক সংবাদ নারদের মুখে। পিতা এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছেন। |
শিব। |
কে? প্রজাপতি দক্ষ? কিন্তু আমি তো কোন সংবাদ পাইনি তার। |
সতী। | পিতার যজ্ঞে তুমি নিমন্ত্রিত হওনি প্রভু। |
শিব। | (হাসিয়া) শিব-হীন যজ্ঞ ! ওহো বুঝেছি।... |
শিব। |
শোন সতী। সে এক ইতিহাস। ভৃগুঋষি ক'রেছিলেন যজ্ঞ অনুষ্ঠান। স্বর্গ, মর্ত, পাতালের সকলেই হয়েছিলেন আমন্ত্রিত। আমিও ছিলেম সেখানে। কিন্তু প্রজাপতি দক্ষকে শ্বশুর ব'লে সভাস্থলে প্রণাম করিনি। তুমিত জান দেবী, আমি যাকে প্রণাম করব, তখনি তার মস্তক দেহচ্যুত হয়ে ধূলি লুণ্ঠিত হবে। |
সতী। | জানি দেবাদিদেব। তোমার প্রণম্য কেউ নেই। |
শিব। |
হ্যাঁ, সেই অপরাধে তিনি করেছিলেন প্রতিজ্ঞা— এমনি এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে যজ্ঞভাগ থেকে বঞ্চিত করবেন আমাকে। প্রজাপতি দক্ষের এ যজ্ঞ অনুষ্ঠান আমার-ই অপমানের জন্য। আর আমার সহধর্মিণী ব'লে তুমি কন্যা হয়েও নিমন্ত্রিত হওনি। দেবী আমি নিষেধ করছি ক্ষান্ত হও। |
সতী। |
না— না, নিষেধ করো না প্রভু। আমি সেইজন্যই যাবো। আমি যজ্ঞসভায় সকলের সম্মুখে পিতাকে জিজ্ঞাসা করব— কেন তিনি তোমায় নিমন্ত্রণ করেননি? আমাকে একটি বার অনুমতি দাও। আমি যাই— |
শিব। | (নিরুত্তর)..... |
সতী। |
কৈ অনুমতি দাও, দেব ! অনুমতি দাও। যে শিব ছাড়া সৃষ্টি ব্যর্থ ধর্ম নিষ্ফল সেই শিবকে অপমানিত করবার দুঃসাহস কেন হল তাঁর। আমি শুনবো তাঁর মুখে। ....কই, উত্তর দিলে না? কিন্তু আমায় যেতেই হবে। তোমার এ মৌনতাকেই সম্মতি মেনে নিয়ে চললাম। হে আমার চির জনমের প্রভু, আমায় ক্ষমা কর। ভৈরবী, যোগিনী, তোরাও সঙ্গে আয়। [ফুট স্টেপস- ফেল্ড আউট মিউজিক্যাল নোটস ইমপ্রেসিং মেলাঙ্কলি টিউন] [প্রস্থান] |
।। দ্বিতীয় ।।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ''যোগিয়া''
শিব। |
সতী! সতী! সতী কোথায়? অনাহূতা হয়ে গেছেন পিতার আলয়ে, শিব-হীন যজ্ঞে না জানি কি হবে এর পরিণাম! সতী বিরহে কৈলাস হয়েছে অন্ধকার, নিত্য আনন্দধাম যেন চির নিরানন্দে গেছে ডুবে। মন্দাকিনীর কলস্রোত আর শোনা যায় না, বনে বনে পাখীর কূজন গেছে থেমে। সতী! সতী! —কোথায় সতী? ফিরে এসো, ফিরে এসো দেবী! তোমার আনন্দ কৈলাস তোমা বিহনে এক মুহূর্তে শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কে তুমি হেসে আমায় প্রণাম করলে? ও! আশা ভৈরবী? (আশা ভৈরবীর প্রবেশ ও গান) |
গীতা
x x x x |
|
আশা। | প্রভু দেবাদিদেব শংকর। ধৈয্য ধরুন প্রভু। |
শিব। |
তুমি চির মধুরভাষিণী, আশা। নিরাশার অন্ধকারে যখন সবে হাবুডুবু খায়, অকুল পাথারে যখন কূল কিনারার ক্ষীণ আভাসটুকু পযন্ত দৃষ্টি পথে আসে না, জীব যখন একান্ত মনে মৃত্যুর হাতে আপনাকে সঁপে বাঁচতে চায়, তোমার হাসির ক্ষীণ রেখাই তাকে তখন ফিরিয়ে আনে জীবনের উপকূলে। তার আবার বাঁচতে সাধ যায়। তুমি আশা, এই নিরাশার অন্ধকারে, আনো— আনো— নতুন দিনের আলো। তপস্যাক্লিষ্টা নিশীথিনীর ললাটে পরাও নবারুণের চন্দন টিপ। |
আশা। |
দেব! এ-কী কথা বলছেন। আপনি দেবাদিদেব, আপনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় আশা-নিরাশার অতীত। প্রভু, আপনি ক্ষণিক মোহোম্মদনায় আপনাকে বিস্মৃত হচ্ছেন। |
শিব। |
তুমি মিথ্যা বলনি, আশা। কিন্তু তোমাদের এই দেবাদিদেব শিবের সব বল-বুদ্ধি-ভরসা যিনি সেই শক্তি ছাড়া শিব যে কিছু নয়। শিবানী ছাড়া শিব যে শব সম। দেখছ না এই কৈলাস! কী এর দশা আজ? শিব তো তোমাদের সশরীরে অবস্থান করছেন এখানে, তবে এ আনন্দপুরীর এ অবস্থা কার জন্য আশা বলতে পার? |
আশা। |
জানি সবই। তবু ধৈর্য্য ধরুন। শিব-শক্তি সতী শিব ছাড়া কতক্ষণ থাকতে পারেন, দেব? তিনি হয়তো অচিরেই ফিরে আসবেন। |
শিব। |
আশা,তুমি তো জান না, কেন মন
আমার অধীর হয়েছে। মন আমার চায়নি সতীকে ছেড়ে দিতে, তবু তিনি চলে গেছেন আমার নিষেধ না
শুনে। কেন আমার এ নিষেধ, তা আমি ছাড়া কেউ জানে না। এক ভাবী অমঙ্গলের আশংকায় মন আমার
চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
—ও কি; দেখ, দেখ, আশা, দূর দূরান্তরে এক কুহেলিকাময় অস্পষ্ট কি যেন
ভেসে আসছে, গতি তার চঞ্চল; চোখে তার বাষ্প ভরা বেদনার আভাস, কণ্ঠে তার করুণ সুর, না
জানি কী অমঙ্গলের বাণী নিয়ে ও আসছে এদিকে। ঐ ঐ শোন,
—আশা!
—এ যে শিবানী ভৈরবী।
(অদূরে করুণ রাগে গান করিতে করিতে 'শিবানী ভৈরবীর' আগমন। |
(শিবানী ভৈরবীর গান) ভগবান শিব জাগো জাগো [তথ্য] গীতা x x x x x x x x |
|
শিব। | কি— কি বললেন শিবানী, (সকাতরে) একি কথা শোনাচ্ছ আমায়! সতী নেই? |
শিবানী। | বড় দুঃসংবাদ প্রভু! মহাদেবী সতী নেই! (ডিপ মিউজিক) |
শিব। | সতী দেহত্যাগ করেছেন? বল বল শিবানী! তারপর— |
শিবানী। | প্রজাপতি দক্ষ সতীর সম্মুখে আপনার নামে অনেক অপমানকর কথা বলেছিলেন— |
শিব। | (নিরুত্তর) |
শিবানী। | অন্য দেবতারা তাকে অনেক নিষেধ করলেন কিন্তু দক্ষ সে কথা কানে নিলেন না— |
শিব। | (উত্তেজিত ভাবে) —তারপর, শিবানী— থেমো না, ব'লে যাও। |
শিবানী। |
দেবীও পিতাকে অনেক নিষেধ করলেন, কিন্তু কন্যার কথায় প্রজাপতি দক্ষ আরো উত্তেজিত হয়েই আপনার নিন্দা করতে লাগলেন। —তাই দুঃখে, শোকে অভিমানে সতী সেই যজ্ঞস্থলেই— |
শিব। |
ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও শিবানী। সতী নেই। আর শুনতে চাইনে। পতি নিন্দায় সতী জীবন ত্যাগ করেছেন। —শিবহীন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে দক্ষের যে অপরাধের সূচনা হয়েছিল তার পরিণতি হয়েছে সতীর জীবন-বিসর্জনে। |
শিব। |
সতী! সতী! তোমার দেহত্যাগের প্রায়শ্চিত্ত হবে দক্ষের যজ্ঞ বিনষ্টে—দক্ষের
ছিন্ন মুণ্ডে হ'ক ঐ যজ্ঞের আহুতি দান। দম্ভী দক্ষ নিজ
কৃত-কর্মের ফল ভোগ করুক। জাগো, জাগো, রুদ্র ভৈরব জাগো। আজ কোটি সূর্যের তেজে ব্রহ্মাণ্ড জাগিয়ে দাও। ছারখার হ'ক স্বর্গ-মর্ত্ত-পাতাল-বিশ্ব যাক রসাতলে। |
(রুদ্র ভৈরবের নৃত্য ও গান ) এসো শঙ্কর ক্রোধাগ্নি [তথ্য] নিতাই x x x x x x x x |
|
শিব। |
আজ আমার এই ছিন্ন জটা থেকে উদ্ভূত হোক জলাগ্নি রুদ্রসম এক শক্তি, তারই হাতে দক্ষের ছিন্নমুণ্ডের যজ্ঞাহুতি। (জটা ছিন্নকরণ, মিউজিক) |
বীরভদ্র। | প্রভু। কী হেতু আমায় স্মরণ করলেন? |
শিব। |
বীরভদ্র। তুমি ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা, শক্তিতে, তেজে তুমি হলে প্রলয়কর সম। যাও বীরভদ্র অবিলম্বে দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড করে তার মুণ্ডে যজ্ঞাহুতি প্রদান কর। শিবশক্তি সতীর হত্যার প্রায়শ্চিত্ত হ'ক সেই পাপিষ্ট দক্ষের ছিন্ন মুণ্ডে। যাও যাও, আর বিলম্ব করো না। |
বীরভদ্র। |
যে আদেশ, দেব। (মিউজিক) বিষমছন্দ ফেড আউট (প্রস্থান) ঢিমা, ফেইড ইন (সাডেন্ চেঞ্জ অফ মিউজিক- শান্ত করুণ রসের ক্রমাবির্ভাব) |
(যোগিনীর গান) শান্ত হও,শিব,-বিরহ বিহ্বল [তথ্য] গীতা x x x x x x x x |
|
যোগিনী। |
প্রভু, শান্ত হও। |
শিব। | যোগিনী। শান্ত হব কিসে? কি নিয়ে শান্ত হবো, বলে দাও, যোগিনী। |
যোগিনী। |
তুমিই ব্রহ্মা, তুমিই বিষ্ণু, তুমি মহেশ্বর। তোমার মাঝেই বিশ্বভুবন বিরোজে, দেব! তুমি অধীর হ'লে যে বিশ্ব হবে ছারখার। |
শিব। |
কিন্তু, কিন্তু যোগিনী, আজ সতী নেই। সতী হারা শিব আজ সান্ত্বনার ভাষা কোথায় পাবে বলে দাও। সতীর শক্তিতে শক্তিমান এই শিব। আজ শিবের সকল শক্তি অন্তর্হিত হয়েছে। সতী আমার ধ্যান, সতী আমার জ্ঞান, আমার সকল শক্তির আকর। |
শিব। |
সেই শক্তির অভাবে শিব অচল অচেতন। বিশ্বকে চালাব কোন শক্তির বলে, যোগিনী! বলতে পার সে কথা? |
যোগিনী। |
দেব! ক্ষণিক শোকে অধীর হয়ে আজ বিস্মৃত হচ্ছো, শক্তির কখনো বিনাশ নাই। তুমি অন্তর্যামী, তুমি তো সবই জানো প্রভু। যে শক্তি আজ চক্ষুর অন্তরালে চ'লে গেছে সে যা তোমারই শক্তি, অলক্ষ্যে তোমারই মাঝে এসে বিরাজ করছে, এ-কী তুমিই জান না প্রভু? না, না, দেবাদিদেব, তুমি সৃষ্টি, তুমি স্থিতি, তুমিই প্রলয়। এই বিশ্বের সকল প্রাণী তোমারি-সৃষ্ট, একদিন তোমার মাঝেই তারা লয় পাবে। মহাদেব! যিনি স্বয়ং সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কর্তা, তাঁর এ মোহ এ নশ্বর শোক শোভা পায় না। সতী দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু দেহান্তর ধারণ করে তিনি তোমারই জন্য অপেক্ষা করছেন অন্যত্র। শক্তি তাঁর রেখে গেছেন তোমারই মাঝে নিহিত করে। প্রভু, আর মিথ্যে শোকে কাতর হয়ো না। |
শিব। |
(চিন্তা করিয়া) যোগিনী! ঠিকই বলেছো তুমি, সতী দেহ রেখেছেন কিন্তু দেহান্তর ধারণ করে তিনি আমারই জন্যে অপেক্ষা করছেন। যাবো, যাবো আমি সেই দেশে, যেখানে সতী আমার পথ চেয়ে বসে আছেন কিন্তু তবু যে মন বোঝে না যোগিনী। সতী, ফিরে এসো দেখ একবার। দেখে যাও সতীহারা শিব আজ শব সম। |
শিব। |
কোথায়! কোথায় তুমি দেবি। দেখা দাও, দেখা দাও। তোমার বিরহে তোমার সাধের কৈলাস হয়েছে অন্ধকার। আবার এসে এ'কে আলোকিত কর। তোমার চঞ্চল চরণ ক্ষেপে কৈলাসে আবার আন নন্দনের আনন্দ। তোমার কলকণ্ঠের কূজনে হোক কৈলাসের মৌন তপোবন আবার মুখরিত। অভিমানিনি! তোমারে ফিরিয়ে আনতে এই চল্লেম আমি তোমার সন্ধানে। দেশে-দেশে, পর্বতে-পর্বতে, গিরি-নদী-কান্তার-পথে যুগ যুগ ধরে বেড়াব তোমারই গান গেয়ে-তোমারই অনুসন্ধানে। সতী, সতী!... |
এ বাগচী
x x x x -জগৎ ঘটক |