বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: কার অনুরাগে শ্রী-মুখ উজ্জ্বল
কার অনুরাগে শ্রী-মুখ উজ্জ্বল!
কার সঙ্গে মধুনিশি যাপিলে চঞ্চল॥
তব আঁখি মনোহর
যুগল নিষাদ শর,
প্রখর সে-আঁখি কেন সকরুণ ছলছল॥
যে পায়ের নূপুর শুনি' কুহু পঞ্চমে বোলে,
হে নিপট, চঞ্চল সে-পা কেন নাহি চলে।
কোন্ ধনি দিল বঁধু
সুর-গরল মধু,
কোন্ সুধা মাগি' রস-নিধি হইলে বিফল॥
- ভাবসন্ধান: গানটি খাম্বাজ ঠাটের রাগেশ্রী রাগের লক্ষণগীত। এই
গানটির রাগ-লক্ষণকে কবি নিটল প্রেমের আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের কাব্যধর্মী
ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেছেন। যেন কোনো এক অভিসারিকার প্রেমতৃপ্ত মুখশ্রী দর্শন
করে কবি জানতে চাইছেন- কার সাথে মধুনিশি যাপনে শ্রীমুখ অনুরাগে উজ্জ্বল,
যার শিকারীর দুই আঁখির বাণ (যুগল নিষাদ শর) প্রেমিকে বিদ্ধ করেছে। যেন
অভিসারিকার মনোহর আঁখিতে রয়েছে তারই রেশ। তবু ক্ষণিক বিরহে তার আখি ছলছল।
তার নূপুরের ধ্বনিতে বাজে কোকিলের পঞ্চমসুর। মিলন-অমৃতের প্রত্যাশায়
বিপ্রলব্ধা প্রেমিকা, প্রেমিকের কামবিষে জর্জরিত অঙ্গ বিবশিত, আবেশে তার
চরণ শিথিল।
নজরুলের রচিত এই গানের ভাবার্থক লক্ষণের নির্দেশিকা পাওয়া যায়, বেতার জগতে
মুদ্রিত বাণী অংশে। মুদ্রিত বাণীর রাগরূপ প্রকাশক শব্দগুলোকে নির্দেশিত করা
হয়েছে বোল্ড-বর্ণশৈলীতে।
কাব্যের এই ছদ্মআবরণ ভেদ করলে পাওয়া যায়, রাগেশ্রী রাগের লক্ষণসমূহ। এই
গানের স্থায়ীতে রয়েছে 'অনুরাগে শ্রীমুখ'। এখানে অনুরাগের অনু এবং শ্রীমুখের
মুখ বাদ দিলে রাগেশ্রী নামটি পাওয়া যায়। রাগটি
রাত্রি দ্বিপ্রহরের। প্রেম-সৌন্দর্য প্রকাশক এই রাগ পরিবেশনের মধুক্ষণ
হিসেবে- রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়েছে 'অনুরাগের রাত্রি'। আবার এই রাগের মধুর ধ্বনিতে শৃঙ্গার রসের আধিক্য ঘটে।
কোন এক দয়িতার সান্নিধ্যে সাধারণ মধ্য রাত্রি হয়ে উঠেছে মধুনিশি। স্থায়ীর
দ্বিতীয় পংক্তিতে জিজ্ঞাস্য হয়ে উঠেছে- কার (?) 'সঙ্গে মধুনিশি' রূপকতায়।
এই রাগে
আরোহণে শুদ্ধ নিষাদ এবং অবরোহণে কোমল নিষাদ ব্যবহৃত হয়। তাই গানে
বলা হয়েছে 'যুগল নিষাদ শর' (স্বর-এর সমধ্বনি)।
অন্য অর্থে রাগের রূপ প্রকাশে উভয় নিষাদের ব্যবহরের অব্যর্থ লক্ষ্যের
সন্ধান দেয়। তাই উভয় নিষাদ এখানে লক্ষ্যভেদী শর। এই যুগল উভয় নিষাদের ব্যবহারের ফলে এই রাগে ফুটে ওঠে বেদনাবিধূর করুণ রস।
এখানে শুদ্ধ নিষাদ তীব্র বেদনার প্রতীক এবং কোমল নিষাদ করুণ রসের প্রতীক।
উভয় নিষাদের ব্যবহারে রাগের যে রূপ প্রকাশ পায়- তা উপস্থাপন করা হয়েছে- 'প্রখর
সে আঁখি কেন সকরুণ ছল ছল' পংক্তিতে।
পঞ্চম কোকিলের কুহু ধ্বনির অনুকরণীয় স্বর। মিলনের আকুল আহ্বানে মুখর
পঞ্চমের মাধ্যমে, শৃঙ্গারের চাঞ্চল্য রূপ প্রকাশ পায়। কবি নায়িকার নূপুরের
অনুভব করেন পঞ্চমের সুমধুর ধ্বনিতে। কিন্তু এই
রাগের পা (পঞ্চম) চলে না, কারণ এই রাগের পঞ্চম বর্জিত। পঞ্চমবিহীন এই রাগ,
মিলনের চাঞ্চল্য-বর্জিত শৃঙ্গার রস, করুণ রসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ধনি (ধা নি) প্রয়োগে
এই রাগটি মধুর রসে সরস হয়ে ওঠে। এই রাগের বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ সম্পর্কে বলা
হয়েছে- এর সুর-গরল মধু। এর অর্থ হলো- স ও র (সুর),
গ ও র (গরল), ম ও ধ (মধু)। অর্থাৎ এই স্বরগুলোর দ্বারাই এই রাগের প্রকাশ ঘটে-
বিরহের যাতনা এবং মিলনের মাধুর্য যুগপদ ব্যঞ্জনায়। এই রাগের অবরোহণে র্স ধ ম গ র স ণ্ ধ্ প্রয়োগে
রাগেশ্রীর রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সরগুলোর অপপ্রয়োগে রাগরূপ বিনষ্ট হয়ে যায়।
কবি তাই লিখেছেন- সুধা (স ও ধ), মাগি (ম ও গ), রস (র ও স) এবং নিধি (ন ও ধ)
হইলে বিফল।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু
জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের
[২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬) কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের রচিত ঠাট-ভিত্তিক 'মেল-মেলন' নামক গীতি-আল্লেখ্য প্রচারিত হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ, ১৪১৭/ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। গান সংখ্য ১৩৩৪। রাগ: রাগেশ্রী (খাম্বাজ ঠাট), তাল: ত্রিতাল। পৃষ্ঠা: ৪০৪।
- বেতার:
-
মেল-মেলন
কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪
মিনিট] তৃতীয় গান। খাম্বাজ ঠাট। রাগেশ্রী-তেতালা
[বেতার
জগৎ-এর নমুনা পত্র]
- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৪শ সংখ্যা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০
-
The Indian Listener Vol. IV. No 24, 7
December 1939. Page 1731
- পর্যায়