বিষয়: নজরুল সঙ্গীত
শিরোনাম: নিত্য শুদ্ধ কল্যাণ রূপে আছে
তুমি মোর সাথে।
নিত্য শুদ্ধ কল্যাণ রূপে আছ তুমি মোর সাথে।
সান্দ্র নিবিড় সন্ধ্যায় যেই পথ ভুলি’, ধর হাতে॥
প্রদোষে স্বরগ-পাশে
তোমার করুণা ভাসে,
স্নিগ্ধ শান্ত চাঁদ হ’য়ে, প্রভু, আঁধারে পথ দেখাতে॥
মান তাজিয়া যে যায় প্রভু তোমার চরণ-তলে,
পূর্ণ-রূপে নেমে আস তার হৃদয়-পদ্ম-দলে।
অবতার হও ভু-পালিতে প্রভু
প্রেম-যমুনার পারে রহ কভু,
দগ্ধ-পরানে বিরাজ হে স্বামী, দুঃখ-জ্বালা জুড়াতে॥
- ভাবসন্ধান: এই
গানটির বাণী দ্ব্যর্থক। এর একটি অর্থ পাওয়া যায়, পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা। অপর
অর্থ হলো- গানটি কল্যাণ ঠাটের শুদ্ধ কল্যাণ রাগের লক্ষণগীত।
প্রার্থনা-সঙ্গীত হিসেবে পাওয়া যায়, এই গানে কবি মনে করেন- পরমেশ্বর তাঁর
সাথে পরমকল্যাণময় রূপে তাঁর সাথে বিরাজ করেন। তাই যখনই কবি ভুল পথে যান,
তিনিই হাত ধরে সঠিক পথে টেনে আনেন। জীবন সায়াহ্নে স্বর্গ-প্রাপ্তির করুণা
তিনি দেখান, আঁধার রাতে চাঁদ হয়ে পথ দেখান। তাই কবি সকল মান-অভিমান ভুলে
সেই পরমেশ্বরের পায়ে যখন নত হন, তখন তাঁর হৃদয় পদ্মে সেই পরমেশ্বর নেমে
আসেন।
শুদ্ধ কল্যাণের লক্ষণগীতে হিসেবে- এই গানের প্রথম পঙ্ক্তিতে কবি রাগের নাম
'শুদ্ধ কল্যাণ', তা জানিয়ে দিয়েছেন। রূপকতায় এই গানে কবি
শুদ্ধকল্যাণকে প্রভু হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই গানে কবি যেন এই রাগের
নিবেদিত দাস। এর প্রথম পংক্তিতেই উঠে এসেছে কবির এই একান্ত নিবেদিত
অভিব্যক্তির কথা। এই রাগে তিনি এতটাই অনুরক্ত যে, যেন এই রাগরূপী প্রভু
তাঁর সাথেই বিরাজ করেন। এই প্রভুর সাথে থাকে বাদী র এবং সমবাদী র। এই
ইঙ্গিত পাওয়া যায়, 'শুদ্ধ কল্যাণ রূপে' -এর ইঙ্গিতে।
এই প্রভু শুদ্ধ কল্যাণকে কবি যখন ভুলে যান, সান্দ্র নিবিড়-সন্ধ্যায় কবিকে
হাত ধরে যেন তাঁর আঙিনায় নিয়ে আসেন। এই বাক্যের মূল কথা হলো- এই রাগের পরিবেশন
সময় নিবিঢ়-ঘন
সন্ধ্যা। তা উল্লেখ করেছেন- দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে। সায়ংকালের (প্রদোষ) এই
রাগে স্বরগ পাশে অর্থাৎ স র গ প স থাকে। মূলত এর আরোহণে স র গ প ধ, এই রাগের রস করুণ
উদ্ভাসিত হয়ে হঠে।
আকাশের চাঁদ যেমন স্নিগ্ধ আলোতে আঁধার সরিয়ে প্রশান্তি এনে দেয়, তেমনি এই
রাগ সন্ধ্যার বিষণ্ণ রূপকে অপসারিত করে, মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
এই রাগের আরোহণে মা নি
বর্জিত। এই দুটি স্বর ত্যাগ করে এই রাগকে উপস্থাপন করতে হয়। তাই কবি
লিখেছেন-
মান তাজিয়া যে যায় প্রভু তোমার চরণ-তলে। আবার রাগটি অবরহণে সম্পূর্ণ,
কবি লুখেছেন- পূর্ণ-রূপে নেমে আস তার হৃদয়-পদ্ম-দলে।
এর সমপ্রকৃতির রাগ- ভূপালী। তাই কখনো কখনো একে ভূপালির মতো মনে হয়। এই গানে
এই ভাবকে উপস্থাপন করা হয়েছে 'অবতার হও ভু-পালিতে প্রভু' পঙ্ক্তিতে। পঞ্চম
ও রেখাবের স্বরসঙ্গতিতে এই রাগটি শৃঙ্গারধর্মী মাধুর্যে মনকে মুগ্ধ করে।
তাই কবি লিখেছেন-
প্রেম-যমুনার পারে রহ কভু। এখানে যেন কবি একই সাথে ইঙ্গিত দিয়েছেন-
রাধাকৃষ্ণের মিলনের প্রেমনদী যমুনাকে, পঞ্চম ও রেখাবের সঙ্গতিতে এই রাগ
যমুনার মিলনক্ষেত্রের মাধুর্যকেই প্রকাশ করে। শুদ্ধকল্যাণের আরোহণে মধ্যম ও
নিষাদ বর্জিত। ফলে রাগ রূপায়ণে স্বরসঙ্গতি গ প -এর স্বরসঙ্গতি অনিবার্যভাবে
মধুর হয়ে উঠে। এই স্বরসঙ্গতিতে বাদী গ এবং ধ বাদী সম্বাদী হওয়া সত্বেও
বর্জিত হয়। সবমিলিয়ে রূপকতায় এই গানে 'দগ্ধ পরানে বিরাজো' এর মাধ্যমে যে
ভাবকে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হলো- গ ধ কে দগ্ধ বা বিসর্জন দিয়ে প ও র কে
ধারণ করে বিরাজ করো। রাগের এই নিবেদনেই মনের সকল দুঃখ ব্যথার উপশম করে
প্রশান্তি এনে দেয়।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু
জানা যায় না। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের
[২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬) কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের রচিত ঠাট-ভিত্তিক 'মেল-মেলন' নামক গীতি-আল্লেখ্য প্রচারিত হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ, ১৪১৭/ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। গান সংখ্যা
১৫০০। পঞ্চম গান। রাগ:
শুদ্ধ কল্যাণ (কল্যাণ ঠাট), তাল: একতাল। পৃষ্ঠা: ৪৫০।
-
বেতার:
-
মেল-মেলন
কলকাতা বেতারকেন্দ্র। [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.০৪
মিনিট। পঞ্চম গান। কল্যাণ ঠাট, রাগ শুদ্ধ কল্যাণ একতালা]
[বেতার
জগৎ-এর নমুনা পত্র]
- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২৪শ সংখ্যা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০
- The Indian
Listener Vol. IV. No 24, 7 December 1939. Page 1731
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: রাগসঙ্গীত, লক্ষণগীত
- সুরাঙ্গ: খেয়ালাঙ্গ