রুম্ ঝুম্ রুম ঝুম্ কে বাজায় জল-ঝুম্ঝুমি।
চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি॥
দুরন্ত অরণ্যা গিরি-নির্ঝরিণী
রঙ্গে সঙ্গে ল'য়ে বনের হরিণী,
শাখায় শাখায় ঘুম ভাঙায় ভীরু মুকুলের কপোল চুমি'॥
কুহু-কুহু কুহরে পাহাড়ি কুহু পিয়াল-ডালে,
পল্লব-বীণা বাজায় ঝিরিঝিরি সমীরণ তা'রি তালে তালে।
সেই জল-ছলছল সুরে জাগিয়া
সাড়া দেয় বন-পারে বাঁশি রাখালিয়া'১,
পল্লীর প্রান্তর ওঠে শিহরি' বলে - 'চঞ্চলা কে গো তুমি'॥
'নিবিড় অরণ্য মাঝে বয়ে যায় ঝর্ণাধারা।এই বর্ণনাটুকু এই গানের ভূমিকা হিসেবেও গ্রহণ করা যায়। এই ভূমিকার পরেই 'বন-কিশোর'-এর গানে উদ্ভাসিত হয় ঝর্নার ধ্বনি ও রূপসৌন্দর্যে বর্ণাঢ্য উপস্থাপন। এ গানের সুরকে বাদ দিলেও, শুধু বাণী হয়ে উঠে এক অনির্বচনীয় নান্দনিক অভিব্যক্তি। বনকিশোরের এই গানে আমরা পাই অরণ্য-নির্ঝরের ধ্বনিচিত্র। যা মনের গভীর তলে দর্শন ও শ্রবণের এক নান্দনিক চিত্র মেলে ধরে। যা শুধু দেখার নয়, শুধু শোনার নয়। শধুই অনুভবের।
অবিচ্ছিন্ন ঝর ঝর সুরের প্রবাহে,
পাখির পালক বাঁধা তীর-ধনুক হাতে
গেয়ে উঠে ঝর্ণা তীরে বনের কিশোরঃ'
'ইহার গতি "শোখ" অর্থাৎ চঞ্চল। ঝর্ণাধারার মত অবরোহণ-কালে ইহার চঞ্চলগতি ফুটিয়া উঠে।'
গানটি ত্রিতালে নিবদ্ধ। কিন্তু চতুর্মাত্রিক এই তালের চলনের ভিতরে ত্রিমাত্রিক
চলনের ১ মাত্রার ধাক্কায় চটুল ছন্দ ফুটে উঠে। রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্
ঝুম্ এই ছন্দে চলতে চলতে পঞ্চম থেকে তারার ষড়্জে মীড় দিয়ে ছন্দকে চতুর্মাত্রিকে
পৌঁছে দেয়। এই মীড়কে আশ্রয় করে ধ্বনিটি হয়ে উঠে উৎসুক্যবাচক। যার ফলে বাণী ও
সুরে মহামিলন ঘটে। ছন্দের এই খেলা, স্বরের উল্লম্ফন এবং বাণীর আবেদনে স্বরের এরূপ
পরিবর্তন গানটির পুরো অংশ জুড়ে রয়েছে। সেই সাথে রাগরূপের সাথে সমন্বিত হয়ে কোমল
ধৈবতে স্থিতি লাভ করে 'বাজায়'। তারপরে 'জল্ ঝুমঝুমি'-তে সেই চটুল চলেন ফিরে আসে।
এক্ষেত্রে মগ ম ঋ স স্বর-ছন্দবিন্যাস মধুর বিরাম এনে দেয়। এই গানের বাণী, সুর ও
ছন্দের অপূর্ব লীলা খুঁজে পাওয়া যায়- শেষ অব্দি। শুধু রাগের বিচারে নয়, গানের
সামগ্রিক রূপের বিচারে এই গানটি নজরুলের সঙ্গীতসৃষ্টি এবং ভাবনার একটি নতুন দিক
আমাদের সামনে উন্মোচিত করে।