বিষয়: নজরুল সঙ্গীত
শিরোনাম: শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া শঙ্করী
শিবানী।
রাগ: শঙ্করী (নজরুল-সৃষ্ট), তাল: একতাল
শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া শঙ্করী শিবানী।
বালিকা-সম লীলাময়ী নীল-উৎপল-পাণি॥
সজল-কাজল-ঝর্না
মুক্ত বেণী অপর্ণা,
তিমির বিভাবরী স্নিগ্ধা শ্যামা কালিকা ভবানী॥
প্রলয় ছন্দময়ী চণ্ডী শব্দ-নূপুর-চরণা,
শাম্ভবী শিব-সীমন্তিনী শঙ্করাভরণা।
অম্বিকা দুঃখহারিণী
শরণাগত-তারিণী,
জগদ্ধাত্রী শান্তিদাত্রী প্রসীদ মা ঈশানী॥
- ভাবসন্ধান: গানটি নজরুল রচিত 'নব রাগমালিকা' গীতিনাট্যের
দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের
চতুর্থ গান। গানটি নজরুলসৃষ্ট শঙ্করী রাগে নিবদ্ধ। এই গানটি রচিত হয়েছিল। উল্লেখ্য এই রাগের নাম রাখা হয়েছিল হিন্দু পৌরাণিক দেবী শঙ্করীর (শিবের স্ত্রী)-এর নামানুসারে। এই গানটিতে শঙ্করী তথা দুর্গার নানা রূপের কথা বলা হয়েছে। এক অর্থে গানটি দুর্গা-বন্দনা। এসকল রূপের মতোই রাগ শঙ্করীও বহুরূপিণী।
পৌরাণিক কাহিনিতে শঙ্করী বা দুর্গা বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিটি নামের অর্থবহ রূপ রয়েছে। এ সকল নামের কিছু রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির সাথে সম্পর্কিত, কিছু রয়েছে শিবের স্ত্রী হিসেবে, আবার কিছু রয়েছে দুর্গার গুণবাচক নাম। সব মিলেয় বলা যায়-গানটি হলো- দুর্গার
নামাবলী।
গানটি স্থায়ীর প্রথম পঙ্ক্তিতে দুর্গার নাম-
- শঙ্কর অঙ্গলীনা: দেবী দুর্গা শঙ্করের
অঙ্গ তথা তাঁর সাথে লীন (একীভূত )হয়ে অবস্থান করেন, তাই তাঁকে কবি শঙ্করের
অঙ্গলীনা নামে অভিহিত করেছেন।
- যোগমায়া: মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে– আদ্য শক্তি মহামায়া। মধু কৈটভের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রজাপতি ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রার স্তবস্তুতি করলে দেবী যোগমায়া মহাকালী রূপে প্রকাশিত হয়ে বিষ্ণুকে নিদ্রামুক্ত করেছিলেন। এরপর বিষ্ণু জলমগ্ন সাগর থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন। এই কারণে দুর্গার অপর নাম যোগমায়া।
- শঙ্করী: শঙ্করের (শিব) স্ত্রী এই অর্থে দুর্গার অপর নাম শঙ্করী। এছাড়া কল্যাণী অর্থেও দুর্গাকে এই নামে অভিহিত করা হয়।
- শিবানী: শিবের স্ত্রী অর্থে শিবানী। এই একই অর্থে দুর্গাকে, ভবানী, ভবদারা ইত্যাদি বলা হয়।
স্থায়ীর দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে দুর্গার নাম
- 'বালিকা-সম:
চির-নবযৌবনা অর্থে দুর্গা বালিকা-সমা
- লীলাময়ী: এই জগৎ-প্রপঞ্চ আদ্যাশক্তি দুর্গার লীলামাত্র তাই তিনি
লীলাময়ী।
- নীল-উৎপল-পাণি: দুর্গার হাত হাত নীলপদ্মের মতো স্নিগ্ধ কোমল, তাই তিনি
নীল-উৎপল-পাণি।
অন্তরার প্রথম ও দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে দুর্গার
নাম
- সজল-কাজল-ঝর্না: সদাস্নিগ্ধা সঞ্চল অর্থে সজল-কাজল ঝর্নার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
- মুক্তবেণী অপর্ণা: পৌরাণিক কাহিনি মতে- হিমালয় কন্যারূপী পার্বতী (দুর্গা) শিবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। গ্রীষ্মের কঠোর উত্তাপ ও শীতকালের প্রচণ্ড শীতকে বরণ করে আত্মপীড়নের মধ্যে এই সাধনা অব্যাহত রাখেন। তপস্যাকালে তিনি খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেন। একসময় তিনি শুধুমাত্র গাছের পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে থাকেন। তবুও পার্বতী মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পেলেন না। এরপর তিনি গলিতপত্র পর্যন্ত গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। এই কারণে তিনি অপর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করেন। এই সে সময় তিনি এলোকেশী ছিলেন বলে- মুক্ত বেণী অপর্ণা বলা হয়েছে।
অন্তরার চতুর্থ পঙ্ক্তিতে দুর্গার
নাম:
- তিমির বিভাবরী স্নিগ্ধা শ্যামা।
মূলত কালো রাত্রির মতো যে রূপ, তাকে বলা হয় শ্যাম।
কিন্তু শ্যামল বা সবুজ তৃণের মতো রূপময়ী, তাই তিনি শ্যামা।
- কালিকা: স্নিগ্ধ কালো রূপে প্রকাশিত রূপের জন্য তিনি কালী। আর দুর্গার একটি বিশেষ শক্তিরূপ হলো- কালিকা।
- ভবানী: এই শব্দের দুটি অর্থই দুর্গা। প্রথমত ভবের (শিব) স্ত্রী বলে ভবানী।
দ্বিতীয় ভব সংসারে লীলাময়ী রূপে বিরাজ করেন, তাই তিনি ভবানী।
সঞ্চারীর প্রথম পঙ্ক্তিতে দুর্গাকে বলা হয়েছে
- চণ্ডী: মার্কেণ্ডেয় পুরাণ মতে–
মহিষাসুর বধের সময়
তাঁর শরীর থেকে
চণ্ডিকা নামক
ভয়ঙ্কর ক্রোধী দেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তিনি চণ্ডী নামে অভিহিত
হয়েছেন।
- শব্দ-নূপুর-চরণা: চণ্ডীর চলার ছন্দে নূপুরের ধ্বনি বেজে ওঠে বলেই তিনি
'শব্দ-নূপুর-চরণা'।
সঞ্চারীর দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে দুর্গাকে বলা হয়েছে-
-
শাম্ভবী: শম্ভু (শিব)-এর সাথে সম্পর্কিত এই অর্থে
শাম্ভবী। তবে শম্ভুর স্ত্রী হিসেবে অনেক সময় দুর্গাকে শাম্ভরী বলা হয়।
- শিব-সীমন্তিনী : শম্ভুর স্ত্রী হিসেবে দুর্গাকে শিব-সীমন্তিনী
বলা হয়
- শঙ্করভরণা: শিবের অপর নাম শঙ্কর। শঙ্করের স্ত্রী
হিসেবে দুর্গাকে শিব-সীমন্তিনী বলা হয়
আভোগে দুর্গা যে সকল নাম পাওয়া যায়-যে নামগুলো পাওয়া যায়, তা হলো-
- অম্বিকা: অম্বা শব্দের অর্থ মাতা। জগৎ মাতা হিসেবে দুর্গাকে অম্বিকা বলা হয়।
- দুঃখহারণী: দুর্গা দুঃখকে হরণ করেন বলে- তিনি দুঃখহারিণী
- শরণাগত-তারিণী: যিনি শরণাগতকে ত্রাণ (রক্ষা) করেন, এই
অর্থে দুর্গা।
- জগদ্ধাত্রী: জগতের ধাত্রী (মাতা, পালকারিণী)অর্থে দুর্গার অপর নাম জগদ্ধাত্রী।
- শান্তিদাত্রী: যিনি শান্তি প্রদান করেন, এই অর্থে দুর্গা।
ঈশানী: ঈশ্ অর্থ প্রভূ। স্ত্রী লিঙ্গে ঈশানী হলো ঈশ্বরী।
বর প্রার্থনা বা অনুগ্রহ লাভের জন্য, কবি বলেছেন প্রসীদ মা। প্রসীদ অর্থ হল- প্রসন্ন হও, দয়া কর, সদয় হও। এখানে শরণাগতের প্রতি প্রসন্ন হওয়ার জন্য মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা বা অনুগ্রহ লাভের জন্য বলা হয়েছে- প্রসীদ মা।
এই রাগটিতে রয়েছে শুভঙ্করী ও কল্যাণী রূপ। চতুর্মাত্রিক একতালে নিবদ্ধ এই গানটি খেয়ালাঙ্গের। এ গানের স্বরবিন্যাসের ঘন গাঁথুনীতে দেবী-বন্দনার সারল্য কিছুটা বিঘ্নিত হয়। গানটিতে সুর তানের বিন্যাসে চলে ফলে, রাগের খেয়াল রূপটি স্পষ্ট হয় বটে, কিন্তু ভাব অনুধাবনে তা বাধার সৃষ্টি করে।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু
জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭), সন্ধ্যা
৭.০৫-টায় কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে নজরুল-সৃষ্ট রাগ নিয়ে তৈরি 'নব রাগমালিকা'
গীতিনাট্যের দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। এই গানটি ছিল এই পর্বের
পঞ্চম গান। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল
৪০ বৎসর ১১ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি
২০১২)। ১৭৪৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৫১৯।
- নবরাগ
- নজরুল ইনস্টিটিউট।
সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)। ৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২১-২২।[নমুনা]
- হরফ প্রকাশনী। কবির ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। ৯
সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।
- বেতার:
-
নবরাগ মালিকা। দ্বিতীয় পর্ব। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১১ মে ১৯৪০
খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.০৫-৭.৪৪ মিনিট।
পঞ্চম গান। শিল্পী: শৈল দেবী]
- সূত্র: বেতার জগৎ পত্রিকার ১১শ বর্ষ ৯ম সংখ্যার অনুষ্ঠান সূচী
[পৃষ্ঠা: ৪৮৫]
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
- স্বরলিপিকার: জগৎ ঘটক। [নবরাগ
(নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)]
[নমুনা]
- পর্যায়