ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল
 

আহ্বানগীত | শেষ কথা |


 

           আহ্বানগীত

পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ,
         শুনিতে পেয়েছি ওই —
সবাই এসেছে লইয়া নিশান,
        কই রে বাঙালি কই !
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়
        বঙ্গসাগরের তীরে,
'বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়'
        ডাকিতেছে ফিরে ফিরে।
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো,
        পথে কেন নাই লোক,
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন —
        বেঁচে আছে শুধু শোক।
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে,
        চেয়ে থাকে হিমগিরি,
রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে
        আসে যায় ফিরি ফিরি।
কত-না সংকট, কত-না সন্তাপ
       মানবশিশুর তরে,
কত-না বিবাদ কত-না বিলাপ
       মানবশিশুর ঘরে !
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস,
      কেহ কারে নাহি মানে,
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস
      হৃদয়ের মাঝখানে।
হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা,
      সংশয় - আঁধারে যুঝে,
কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা —
      কে দিবে আলয় খুঁজে !
মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস,
      করিতে হইবে রণ,
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস —
      শোনো শোনো সৈন্যগণ !
পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে,
      বাতাস ছুটেছে তাই —
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে
      চলিয়াছে কত ভাই।
বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা,
      শুনেছে কি তাহা সবে ?
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা
       জালদগম্ভীর রবে ?
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ?
       আঁখি খুলেছে কি কেহ ?
ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ?
       ছেড়েছে খেলার গেহ ?
কেন কানাকানি, কেন রে সংশয় ?
       কেন মরো ভয়ে লাজে ?
খুলে ফেলো দ্বার, ভেঙে ফেলো ভয়,
       চলো পৃথিবীর মাঝে।
ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে,
       জড়িমাজড়িততনু,
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে
        ঘুমায় কীটের অণু।
চারি দিকে তার আপন-উল্লাসে
        জগৎ ধাইছে কাজে,
চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে
        স্বরগসংগীত বাজে !
চারি দিকে তার মানবমহিমা
         উঠিছে গগনপানে,
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা
        অসীমের মাঝখানে!
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস,
        আপনারে জানে বড়ো —
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস,
        ধুলা করিতেছে জড়ো।
সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম,
        জগতের রঙ্গভূমি —
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম,
       কেন গো ঘুমাও তুমি।
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে,
       শুনিতেছ হাহাকার —
তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে,
       এ সমুদ্র করো পার।
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে,
       তুমি এসো, দাও যোগ —
বাধার মতন জড়াও চরণ
       এ কী রে করম-ভোগ।
তা যদি না পারো সরো তবে সরো,
       ছড়ে দাও তবে স্থান,
ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো —
       কেন এ বিলাপগান!

ওরে চেয়ে দেখ্‌ মুখ আপনার,
      ভেবে দেখ্‌ তোরা কারা,
মানবের মতো ধরিয়া আকার,
      কেন রে কীটের পারা ?
আছে ইতিহাস, আছে কুলমান,
      আছে মহত্ত্বের খনি —
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান
      শোন্‌ তার প্রতিধ্বনি।
খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে
      গ্রহতারকার পথ,
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে
      উড়াতেন মনোরথ।
চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া
      তৃষিত-আকুল-প্রাণে
দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া
       চাহিয়া বিশ্বের পানে।
তবে কেন সবে বধির হেথায়,
       কেন অচেতন প্রাণ —
বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায়
       বিশ্বের আহ্বানগান !
মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে,
       কেন রে বুঝি নে ভাষা ?
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে
       কেন রে জাগে না আশা ?
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে,
      কেন রে নাচে না প্রাণ ?
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে,
      কেন রে জাগে না গান ?
কেন আছি শুয়ে, কেন আছি চেয়ে,
      পড়ে আছি মুখোমুখি —
মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে,
       জগতের সুখে সুখী !
চলো দিবালোকে, চলো লোকালয়ে,
       চলো জনকোলাহলে —
মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে
       অসীম আকাশতলে।
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের 'পরে,
       নৃত্যগীত নব নব —
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে
       এককণ্ঠ হয়ে কব।
মানবের সুখ মানবের আশা
       বাজিবে আমার প্রাণে,
শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা
        ফুটিবে আমার গানে।
মানবের কাজে মানবের মাঝে
        আমরা পাইব ঠাঁই,
বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে —
        শুনিতে পেয়েছি ভাই !
মুছে ফেলো ধুলা, মুছ অশ্রুজল,
        ফেলো ভিখারির চীর —
পরো নব সাজ, ধরো নব বল,
       তোলো তোলো নত শির।
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে
       জগতের নিমন্ত্রণ —
দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে,
       দাসত্বের আভরণ।
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন,
       হাসিয়া চাহিবে ধীরে,
পুরবরবির হিরণ কিরণ
       পড়িবে তোমার শিরে।
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া
        হৃদয়ের শতদল,
জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া
        প্রভাতের পরিমল।
উঠ বঙ্গকবি, মায়ের ভাষায়
       মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ —
জগতের লোক সুধার আশায়
      সে ভাষা করিবে পান।
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে,
       ভাসিবে নয়নজলে —
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে
        মায়ের চরণতলে।
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে
        কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি,
গান গেয়ে কবি জগতের তলে
        স্থান কিনে দাও তুমি।
এক বার কবি মায়ের ভাষায়
        গাও জগতের গান —
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায়,
        ঘুচে যায় অপমান।

          
শেষ কথা
মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে,
সে কথা হইলে বলা সব বলা হয়।
কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে,
তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয়।
শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে,
পাখির মতন ধায় চরাচরময়।
শত গান ম'রে গিয়ে, নূতন জীবনে
একটি কথায় চাহে হইতে বিলয়।
সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি,
আর বাজাব না বীণা চিরদিন-তরে।
সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি,
মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে।
সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে,
আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে।