|
বসন্ত-অবসান
কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান!
কখন বকুল-মূল
ছেয়েছিল ঝরা ফুল,
কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান!
কখন বসন্ত গেল , এবার হল না গান!
এবার বসন্তে কি রে
যুথীগুলি জাগে নি রে !
অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান!
এবার কি সমীরণ
জাগয় নি ফুলবন,
সাড়া দিয়ে গেল না তো, চলে গেল ম্রিয়মাণ !
কখন বসন্ত গেল,
এবার হল না গান!
যতগুলি পাখি ছিল
গেয়ে বুঝি চলে গেল,
সমীরণে মিলে গেল বনের বিলাপতান।
ভেঙেছে ফুলের মেলা,
চলে গেছে হাসি-খেলা,
এতক্ষণে সন্ধ্যাবেলা জাগিয়া চাহিল প্রাণ।
কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান!
বসন্তের শেষ রাতে
এসেছি রে শূন্য হাতে,
এবার গাঁথি নি মালা, কী তোমারে করি দান !
কাঁদিছে নীরব বাঁশি,
অধরে মিলায় হাসি,
তোমার নয়নে ভাসে ছলছল অভিমান।
এবার বসন্ত গেল , হল না, হল না গান!
বাঁশি
ওগো, শোনো কে বাজায় !
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়।
অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি
চুরি করে হাসিখানি,
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায় ।
ওগো শোনো কে বাজায়!
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে।
যমুনারই কলতান
কানে আসে, কাঁদে প্রাণ,
আকাশে ঐ মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়!
ওগো শোনো কে বাজায়!
বিরহ
আমি
নিশি-নিশি কত রচিব শয়ন
আকুলনয়ন রে!
কত
নিতি-নিতি বনে করিব যতনে
কুসুমচয়ন রে!
কত
শারদ যামিনী হইবে বিফল,
বসন্ত যাবে চলিয়া!
কত
উদিবে তপন আশার স্বপন,
প্রভাতে যাইবে ছলিয়া!
এই
যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া,
মরিব কাঁদিয়া রে!
সেই
চরণ পাইলে মরণ মাগিব
সাধিয়া সাধিয়া রে।
আমি কার পথ
চাহি এ জনম বাহি,
কার দরশন যাচি রে!
যেন
আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া,
তাই আমি বসে আছি রে।
তাই
মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়
নীলবাসে তনু ঢাকিয়া,
তাই
বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে
একেলা রয়েছি জাগিয়া।
ওগো তাই কত নিশি
চাঁদ ওঠে হাসি,
তাই কেঁদে যায় প্রভাতে।
ওগো তাই ফুলবনে
মধুসমীরণে
ফুটে ফুল কত শোভাতে!
ওই
বাঁশিস্বর তার আসে বারবার,
সেই শুধু কেন আসে না!
এই
হৃদয়-আসন শূন্য যে থাকে,
কেঁদে মরে শুধু বাসনা।
মিছে
পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায়,
বহে যমুনার লহরী,
কেন
কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —
যামিনী যে ওঠে শিহরি।
ওগো
যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে,
মোর হাসি আর রবে কি!
এই
জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন
আমারে হেরিয়া কবে কী!
আমি
সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা
প্রভাতে চরণে ঝরিব,
ওগো
আছে সুশীতল যমুনার জল —
দেখে তারে আমি মরিব ।
বাকি
কুসুমের গিয়েছে সৌরভ,
জীবনের গিয়েছে গৌরব।
এখন যা-কিছু সব ফাঁকি,
ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।
বিলাপ
ওগো এত প্রেম-আশা প্রাণের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি !
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী,
সেথা কি বাজে না বাঁশরি!
সখী, হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,
সেথা কি পবন বহে না!
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ
মোর কথা তারে কহে না!
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী
আমারে ভুলাল কেন সে!
ওগো এ চির জীবন করিব রোদন
এই ছিল তার মানসে!
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে
কেটেছিল সুখরাতি রে,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার
হবে জীবনের সাথী রে!
যদি মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে,
তোরা একবার দেখে আয় —
এই নয়নের তৃষা পরানের আশা
চরণের তলে রেখে আয়।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার,
কত আর ঢেকে রাখি বল্।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে
এক-ফোঁটা তার আঁখিজল।
না না, এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে
তারে আর কেহ সেধো না।
আমি কথা নাহি কব, দুখ লয়ে রব,
মনে মনে স'ব বেদনা।
ওগো মিছে, মিছে সখী, মিছে এই প্রেম,
মিছে পরানের বাসনা।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায়
আর ফিরে আর আসে না।
সারাবেলা
হেলাফেলা সারাবেলা
এ কী খেলা আপন-সনে !
এই বাতাসে ফুলের বাসে
মুখখানি কার পড়ে মনে!
আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি
কে জানে গো কাহার হাসি!
দুটি-ফোঁটা নয়নসলিল
রেখে যায় এই নয়ন কোণে।
কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী
দূরে বাজায় অলস বাঁশি,
মনে হয় কার মনের বেদন
কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে।
সারাদিন গাঁথি গান
কারে চাহে, গাহে প্রাণ,
তরুতলের ছায়ার মতন
বসে আছি ফুলবনে।
আকাঙ্ক্ষা
আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে
কী জানি পরান কী যে চায়!
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে
বিহগবিহগী কী যে গায়!
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে,
রহে না আবাসে মন হায়!
কোন্ কুসুমের আশে, কোন্ ফুলবাসে
সুনীল আকাশে মন ধায়!
আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই
জীবন বিফল হয় গো!
তাই চারি দিকে চায়, মন কেঁদে গায়–
'এ নহে , এ নহে , নয় গো! '
কোন্ স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে
কোন্ ছায়াময়ী অমরায়!
আজি কোন্ উপবনে বিরহবেদনে
আমারি কারণে কেঁদে যায় !
আমি যদি গাঁথি গান অথির-পরান
সে গান শুনাব কারে আর!
আমি যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা
কাহারে পরাব ফুলহার!
আমি আমার এ প্রাণ যদি করি দান
দিব প্রাণ তবে কার পায়!
সদা ভয় হয় মনে পাছে অযতনে
মনে মনে কেহ ব্যথা পায়!
তুমি
তুমি কোন্ কাননের ফুল,
তুমি কোন্ গগনের তারা !
তোমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন্ স্বপনের পারা !
কবে তুমি গেয়েছিলে,
আঁখির পানে চেয়েছিলে
ভুলে গিয়েছি।
শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে,
ঐ নয়নের তারাৱ।
তুমি কথা কয়ো না,
তুমি চেয়ে চলে যাও।
এই চাঁদের আলোতে
তুমি হেসে গলে যাও।
আমি ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে
চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে,
তোমার আঁখির মতন দুটি তারা
ঢালুক
কিরণ-ধারা।
গান
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে!
আমার ঘরে কেহ নাই যে!
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে!
তার আকুল পরান বিরহের গান
বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে!
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে,
প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে!
কুসুমের মালা গাঁথা হল না,
ধূলিতে পড়ে শুকায় রে!
নিশি হয় ভোর, রজনীর চাঁদ
মলিন মুখ লুকায় রে !
সারা বিভাবরী কার পূজা করি
যৌবনডালা সাজায়ে!
ওই বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায়,
আমি কেন থাকি হায় রে!
|