ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল
 

ছোটো ফুল | যৌবন-স্বপ্ন | ক্ষণিক মিলন | গীতোচ্ছ্বাস | স্তন | চুম্বন | বিবসনা | বাহু | চরণ |

 


 

         ছোটো ফুল
আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে,
সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায় !
তাই যদি, তাই হোক , দুঃখ নাহি তায় —
তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে।
যারা থাকে অন্ধকারে, পাষাণকারায়,
আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে,
নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায়,
নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে !
ক্ষুদ্র ফুল , আপনার সৌরভের সনে
নিয়ে আসে স্বাধীনতা, গভীর আশ্বাস —
মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে,
মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস।
ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে
বৃহৎ জগৎ, আর বৃহৎ আকাশ!


        যৌবন-স্বপ্ন
আমার যৌবনস্বপ্নে যেন      ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে
    রূপসীর পরশের মতো।
পরানে পুলক বিকাশিয়া
     বহে কেন দক্ষিণা বাতাস
যেথা ছিল যত বিরহিণী
      সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস!
বসন্তের কুসুমকাননে
         গোলাপের আঁখি কেন নত ?
জগতের যত লাজময়ী
       যেন মোর আঁখির সকাশ ?
কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে, মরমের শরমে বিব্রত !
প্রতি নিশি ঘুমাই যখন
      পাশে এসে বসে যেন কেহ ,
সচকিত স্বপনের মতো
     জাগরণে পলায় সলাজে ।
যেন কার আঁচলের বায়
    উষার পরশি যায় দেহ ,
শত নূপুরের রুনুঝুনু
        বনে যেন গুঞ্জরিয়া বাজে ।
মদির প্রাণের ব্যাকুলতা
     ফুটে ফুটে বকুলমুকুলে ;
কে আমারে করেছে পাগল —
 শূন্যে কেন চাই আঁখি তুলে !
যেন কোন্‌ উর্বশীর আঁখি
    চেয়ে আছে আকাশের মাঝে !

            
ক্ষণিক মিলন
আকাশের দুই দিক হতে
   দুইখানি মেঘ এল ভেসে,
দুইখানি দিশাহারা মেঘ — কে জানে এসেছে কোথা হতে !
সহসা থামিল থমকিয়া
   আকাশের মাঝখানে এসে।
দোঁহাপানে চাহিল দুজনে
  চতুর্থীর চাঁদের আলোতে।
ক্ষীণালোকে বুঝি মনে পড়ে
  দুই অচেনার চেনাশোনা,
মনে পড়ে কোন্‌ ছায়া দ্বীপে,
 কোন্‌ কুহেলিকা-ঘের দেশে,
কোন্‌ সন্ধ্যাসাগরের কূলে
  দুজনের ছিল আনাগোনা !
মেলে দোঁহে তবুও মেলে না,
 তিলেক বিরহ রহে মাঝে —
চেনা বলে মিলিবারে চায়,
  অচেনা বলিয়া মরে লাজে।
মিলনের বাসনার মাঝে
  আধখানি চাঁদের বিকাশ —
দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুয়ি,
 মাঝে যেন শরমের হাস!
দুখানি অলস আঁখিপাতা,
 মাঝে সুখস্বপন-আভাস !
দোঁহার পরশ লয়ে দোঁহে
  ভেসে গেল, কহিল না কথা —
বলে গেল সন্ধ্যার কাহিনী,
 লয়ে গেল উষার বারতা।
 

              গীতোচ্ছ্বাস
নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকাননমাঝে বসন্তসমীরে!
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত!
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত!
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো!
জগতকমলবনে কমল-আসনা
কতদিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে !
সে এল না, এল তার মধুর মিলন !
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর !
দৃষ্টি তার ফিরে এল , কোথা সে নয়ন ?
চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর ?

             
স্তন
               
নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,
বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে,
সৌরভসুধায় করে পরান পাগল।
মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল
উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে।
কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে —
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।
প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয়,
উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে।
হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর —
হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির।

             
পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায়,
দেবতা বিহারভূমি কনক-অচল।
উন্নত সতীর স্তন স্বরগ প্রভায়
মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল।
শিশু রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে,
শ্রান্ত রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায়।
দেবতার আঁখিতারা জেগে থাকে রাতে,
বিমল পবিত্র দুটি বিজন শিখরে।
চিরস্নেহ-উৎসধারে অমৃত নির্ঝরে
সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর।
জাগে সদা সুখসুপ্ত ধরণীর'পরে,
অসহায় জগতের অসীম নির্ভর।
ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি,
দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি


                
চুম্বন
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে,
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন,
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন।

              বিবসনা
ফেলো গো বসন ফেলো — ঘুচাও অঞ্চল।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা।
বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাঁড়াও একেলা।
সর্বাঙ্গে পড়ুক তব চাঁদের কিরণ,
সর্বাঙ্গে মলয়-বায়ু করুক সে খেলা।
অসীম নীলিমা-মাঝে হও নিমগন
তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মতো।
অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত।
আসুক বিমল উষা মানবভবনে,
লাজহীনা পবিত্রতা — শুভ্র বিবসনে।

              বাহ
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা,
কাহারে কাঁদিয়া বলে ‘যেয়ো না যেয়ো না'।
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা!
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা,
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক-অক্ষরে।
পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা,
মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে।
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে।
দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডালা,
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন,
ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন।

              
চরণ
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায় —
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায়,
শত লক্ষ কুসুমের পরশস্বপন।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায়।
প্রভাতের প্রদোষের দুটি সূর্যলোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায়।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে,
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায়।
হোথা যে নিঠুর মাটি, শুষ্ক ধরাতল —
এসো গো হৃদয়ে এসো, ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল।