ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সন্ধ্যসংগীত

গ্রন্থ পরিচিতি
অনুগ্রহ | অসহ্য ভালবাসা |  আবার  |  আমি-হারা | আশার নৈরাশ্য | উপহার  |  গান আরম্ভ | গান-সমাপন |  তারকার আত্মহত্যা | দুঃখ-আবাহন |  দুদিন | পরাজয়-সঙ্গীত  | পরিত্যক্ত | পাষাণী |   শান্তিগীত | শিশির  | সংগ্রাম-সংগীত | সন্ধ্যা |  সুখের বিলাপ  হলাহল   হৃদয়ের গীতিধ্বনি   
সংযোজন : 
| কেন গান গাই | কেন গান শুনাই | বিষ ও সুধা |  সন্ধ্যা | 


সূচনা

এই গ্রন্থাবলীতে আমার কাব্যরচনার প্রথম পরিচয় নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্ধ্যাসংগীত। তার পূর্বেও অনেক লেখা লিখেছি, সেগুলিকে লুপ্ত করবার চেষ্টা করেছি অনাদরে। হাতের অক্ষর পাকাবার যে খাতা ছিল বাল্যকালে সেগুলিকে যেমন অনাদরে রাখি নি, এও তেমনি। সেগুলিও ছিল যাকে বলে কপিবুক, বাইরে থেকে মডেল-লেখা নকল করবার সাধনায়। কাঁচা বয়সে পরের লেখা মক্‌শ করে আমরা অক্ষর ফেঁদে থাকি বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার মধ্যেও নিজের স্বাভাবিক ছাঁদ একটা প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে পরিণতিক্রমে সেইটেই বাইরের নকল খোলসটাকে বিদীর্ণ করে স্বরূপকে প্রকাশ করে দেয়। প্রথম বয়সের কবিতাগুলি সেই রকম কপিবুকের কবিতা।

সেই কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথম দেখা দিল সন্ধ্যাসংগীত। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না, করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে তার আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরে নি, তাই তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। অতএব সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।


 

গ্রন্থ পরিচিতি
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তম খণ্ডের গ্রন্থ পরিচয় অংশে লিখিত- এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।


    সন্ধ্যাসংগীত '১২৮৮' সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণে গ্রন্থাকারে লিখিত আছে
 
   
    'আমার রচিত কবিতার মধ্যে যেগুলি সন্ধ্যাসংগীত নামে উক্ত হইতে পারে, সেইগুলিই এই পুস্তকে প্রকাশিত হইল। ইহার অধিকাংশ কবিতাই গত দুই বৎসরের মধ্যে রচিত হইয়াছে, কেবল 'বিষ ও সুধা' নামক দীর্ঘ কবিতাটি বাল্যকালের রচনা।'
    পরবর্তীকালে 'বিষ ও সুধা' কবিতাটি ও প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত 'কেন গান গাই' 'কেন গান শুনাই' কবিতা দুইটি বর্জিত এবং অন্য কবিতাগুলি অল্পবিস্তর খণ্ডিতভাবে গৃহীত হয়। রবীন্দ্র-রচনাবলী-পূর্ব শেষ সংস্করণ (ভাদ্র ১৩৩৪) 'ব্যথা বড়ো বাজিয়াছে প্রাণে' ('সন্ধ্যা') কবিতাটি "পুনরাবৃত্তি" বলিয়া বর্তমান রচনাবলীতে কবি বর্জন করিয়াছেন, অন্য অনেক কবিতারও কোনো কোনো অংশ বর্জিত হইয়াছে।
    সন্ধ্যাসংগীতের প্রথম সংস্করণে মূলগ্রন্থের ভূমিকারূপে ও গ্রন্থ "সমাপ্ত" হইবার পর 'উপহার' শীর্ষক দুইটি কবিতা মুদ্রিত আছে। প্রথম 'উপহার' কবিতাটি বর্তমান রচনাবলীতে 'সন্ধ্যা' নামে, এবং দ্বিতীয়টি 'উপহার' নামেই মুদ্রিত আছে। দ্বিতীয়টিকেই এই গ্রন্থের উপহার বা উৎসর্গ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।
    ১৯১৫ সালে ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউজ কর্তৃক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যাসংগীত সম্বন্ধে লিখিয়াছেন-
     'সন্ধ্যাসংগীতের পূর্ববর্তী আমার সমস্ত কবিতা আমার কাব্যগ্রন্থাবলী হইতে বাদ দিয়াছি। যদি সুযোগ পাইতাম তবে সন্ধ্যাসংগীতকেও বাদ দিতাম। কিন্তু সকল জিনিসেরই একটা আরম্ভ তো আছেই। সে আরম্ভ কাঁচা এবং দুর্বল, কিন্তু সম্পূর্ণতার খাতিরেও তাহাকেও স্থান দিতে হয়।
    "সন্ধ্যাসংগীত হইতেই আমার কাব্যস্রোত ক্ষীণভাবে শুরু হইয়াছে। এইখান হইতেই আমার লেখা নিজের পথ ধরিয়াছে। পথ যে তৈরি ছিল তাহা নহে- গতিবেগে আপনি পথ তৈরি হইয়া উঠিয়াছে। তখন শক্তি অল্প, বাধা বিস্তর, নিজের কাব্যরূপকে তখনো স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাই নাই, ভালোমন্দ বিচার করিবার কোনো আদর্শ মনের মধ্যে ছিল না। তাহা ছাড়া, প্রথম রচনার সকলের চেয়ে মস্ত দোষ এই যে তাহার মধ্যে ছিল না। কেননা মানুষ ক্রমে ক্রমে পায়- অথচ সত্যকে পাইবার পূর্বেই তাহার কর্ম আরম্ভ হইয়া থাকে; সেই কর্মের মধ্যে আবর্জনার ভাগই বেশি থাকে।
     'মানুষের জীবন তাহার প্রতিদিনের আবর্জনা প্রতিদিন মোচন করিয়া তাহা মার্জনা করিয় চলে। যুবা আপনার শৈশবের হামাগুড়িকে জমাইয়া রাখে না। দুর্ভাগ্যক্রমে সাহিত্যভাণ্ডারে আবর্জনাগুলাকে একেবারে দূর করিয়া দেওয়া যায় না। যাহা একবার প্রকাশ হইয়াছে তাহাকে বিদায় করা কঠিন।
     'অতএব সন্ধ্যাসংগীতকে দিয়া কাব্যগ্রন্থাবলী আরম্ভ করা গেল। ইহার কবিতাগুলির মধ্যে কবির লজ্জার যথেষ্ট আছে। কিন্তু যদি তাহার পরবর্তী রচনায় কোনো গৌরবের বিষয় থাকে তবে এই প্রথম প্রয়াসের নিকট সেজন্য ঋণ স্বীকার করিতেই হইবে।'