স্বরবিতান-২৯


 

এই গ্রন্থের পৌষ ১৪১২ মুদ্রণের ৭৯-৮১ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত প্রজ্ঞাপনটি নিচে উল্লেখ করা হলো।

কালমৃগয়া গীতিনাট্য ১২৮৯ অগ্রহায়ণে প্রথম প্রকাশিত হয়। বাল্মীকিপ্রতিভা ও কালমৃগয়া এই দুইটি গীতিনাট্য-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন-
   হাবার্ট স্পেন্‌সরের একটা লেখার মধ্যে পড়িয়াছিলাম যে, সচরাচর কথার মধ্যে যেখানে একটু হৃদয়াবেগের সঞ্চার হয় সেখানে আপনিই কিছু না কিছু সুর লাগিয়া যায়। বস্তুত রাগ দুঃখ আনন্দ বিস্ময় আমরা কেবলমাত্র কথা দিয়া প্রকাশ করি না, কথার সঙ্গে সুর থাকে। এই কথাবার্তার-আনুষঙ্গিক সুরটারই উৎকর্ষসাধন করিয়া মানুষ সংগীত পাইয়াছে। স্পেন্‌সরের এই কথাটা মনে লাগিয়াছিল-ভাবিয়াছিলাম, এই মত অনুসারে আগাগোড়া সুর করিয়া নানা ভাবকে গানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিয়া অভিনয় করিয়া গেলে চলিবে না কেন। আমাদের দেশে কথকতায় কতকটা এই চেষ্টা আছে; তাহাতে বাক্য মাঝে মাঝে সুরকে আশ্রয় করে, অথচ তাহা তালমান-সংগত রীতিমতো সংগীত নহে। ছন্দ হিসাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ যেমন, গান হিসাবে এও সেইরূপ। ইহাতে তালের কড়াক্কড় বাঁধন নাই, একটা লয়ের মাত্রা আছে। ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য, কথার ভিতরকার ভাবাবেগকে পরিষ্ফুট করিয়া তোলা, কোনো বিশেষ রাগিণী বা তালকে বিশুদ্ধ করিয়া প্রকাশ করা নহে। বাল্মীকিপ্রতিভায় গানের বাঁধন সম্পূর্ণ ছিন্ন করা হয় নাই, তবু ভাবের অনুগমন করিতে গিয়া তালটাকে খাটো করিতে হইয়াছে। অভিনয়টাই মূখ্য হওয়াতে এই তালের ব্যতিক্রম শ্রোতাদিগকে দুঃখ দেয় না।

   বাল্মীকিপ্রতিভার গান সম্বন্ধে এই নূতন পন্থায় উৎসাহ বোধ করিয়া এই শ্রেণীর আরও একটা গীতিনাট্য লিখিয়াছিলাম। তাহার নাম কালমৃগয়া। দশরথ-কর্তৃক অন্ধমুনির পুত্রবধ তাহার নাট্যবিষয়। তেতালার ছাদে স্টেজ খাটাইয়া ইহার অভিনয় হইয়াছিল। ইহার করুণরসে শ্রোতারা অত্যন্ত বিচলিত হইয়াছিলেন। পরে এই গীতনাট্যের অনেকটা অংশ বাল্মীকিপ্রতিভার সঙ্গে মিশাইয়া দিয়াছিলাম বলিয়া ইহা গ্রন্থাবলীর মধ্যে প্রকাশিত হয় নাই।
   ইহার অনেককাল পরে মায়ার খেলা বলিয়া আর একটা গীতনাট্য লিখিয়াছিলাম কিন্তু সেটা ভিন্ন জাতের জিনিস। তাহাতে নাট্য মূখ্য নহে, গীতই মূখ্য। বাল্মীকিপ্রতিভা ও কালমৃগয়া যেমন গানের সূত্রে নাট্যের মালা, মায়ার খেলা তেমনি নাট্যের সূত্রে গানের মালা।.....
    বাল্মীকিপ্রতিভা ও কালমৃগয়া যে উৎসাহে লিখিয়াছিলাম সে উৎসাহে আর কিছু রচনা করি নাই। ঐ দুটি গ্রন্থে আমাদের সেই সময়কার একটা সংগীতের উত্তেজনা প্রকাশ পাইয়াছে।
 

১ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গৃহে ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ উপলক্ষে ১৮৮২ সালের ২৩ ডিসেম্বর শনিবার ইহা অভিনীত হয়। অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ (বয়স ২১) অন্ধমুনির, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ (বয়স ৩৩) দশরথের, হেমেন্দ্রনাথের পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ ও কন্যা অভিজ্ঞা দেবী যথাক্রমে অন্ধমুনির পুত্র ও তাহার ক্রীড়াসঙ্গিনী লীলার এবং পরিবারস্থ বালিকাগন বনদেবীর ভুমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

২ রবীন্দ্র-রচনাবলীর অচলিত সংগ্রহ প্রথমখণ্ডে কালমৃগয়ার প্রতম পুনর্‌মুদ্রণ। গীতবিতান তৃতীয় খণ্ডেও (১৩৫৭ আশ্বিন) সংকলিত।


জ্যোতিদাদা তখনই প্রত্যহই প্রায় সমস্ত দিন ওস্তাদী গানগুলাকে পিয়ানো যন্ত্রের মধ্যে ফেলিয়া তাহাদিগকে যথেচ্ছা মন্থন করিতে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাহাতে ক্ষণে ক্ষণে রাগীণীগুলির এক-একটি অপূর্ব মুর্তি ও ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশ পাইত। যে-সকল সুর বাঁধা নিয়মের মধ্যে মন্দগতিতে দস্তুর রাখিয়া চলে তাহাদিগকে প্রথাবিরূদ্ধ বিপর্যস্ত ভাবে দৌড় করাইবা মাত্র সেই বিপ্লবে তাহাদের প্রকৃতিতে নূতন নূতন অভাবনীয় শক্তি দেখা দিত এবং তাহাতে আমাদের চিত্তকে সর্বদা বিচলিত করিয়া তুলিত। সুরগুলা যেন নানাপ্রকার কথা কহিতেছে এইরূপ আমরা স্পষ্ট শুনিতে পাইতাম।। আমি ও অক্ষয়বাবু অনেক সময়ে জ্যোতিদাদার সেই বাজনার সঙ্গে সঙ্গে সুরে কথা যোজনার চেষ্টা করিতাম। কথাগুলি যে সুখপাঠ্য হইত তাহা নহে, তাহারা সেই সুরগুলির বাহনের কাজ করিত।

এইরূপ একটা দস্তুর-ভাঙ্গা গীতবিপ্লবের প্রলয়ানন্দে এই দুটি নাট্য লেখা। এইজন্য উহাদের মধ্যে তালবেতালের নৃত্য আছে, এবং ইংরেজি-বাংলার বাছবিচার নাই। আমার অনেক মত ও রচনারীতিতে আমি বাংলাদেশের পাঠক-সমাজকে বারম্বার উত্যক্ত করিয়া তুলিয়াছি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে সংগীত সম্বন্ধে উক্ত দুই গীতিনাট্যে যে দুঃসাহসিকতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহাতে কেহই কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই এবং সকলেই খুশি হইয়া ঘরে ফিরিয়াছেন।
                                                                                                                                                 -‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অধ্যায়। জীবনস্মৃতি

স্বরবিতান উনত্রিংশ খণ্ড (কালমৃগয়া) প্রকাশিত হয় আষাঢ় ১৩৬০ সালে। এই খণ্ডের স্বরলিপি ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী –কৃত।
     কালমৃগয়ার কতকগুলি গানের স্বরলিপি পূর্বে সাময়িক পত্রে বা গ্রন্থান্তরে মুদ্রিত হইয়াছিল – বালক, শ্রাবণ-আশ্বিন, পৌষ-মাঘ ১২৯২, স্বরলিপি; প্রতিভাদেবী; ভারতী, কার্তিক ১২৯৬ ও স্বরবিতান অষ্টম খণ্ড, স্বরলিপি: ইন্দিরাদেবী; স্বরলিপি-গীতিমালা, স্বরলিপি: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; বাল্মীকিপ্রতিভা ও কেতকী, স্বরলিপি: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বর্তমান গ্রন্থের রাগ-তাল-নির্দেশ ব্যাপারে রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের পরামর্শ লওয়া হইয়াছে।

আশ্বিন ১৩৮০
 

এই গ্রন্থে গৃহীত গানগুলির তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।

অজ্ঞানে করো হে ক্ষমা তাত, ধরি চরণে [তথ্য]
ও ভাই দেখে যা কত ফুল তুলেছি [কালমৃগয়া] [তথ্য] [নমুনা]
কাল সকালে [কালমৃগয়া] [তথ্য]  [নমুনা]
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে [কালমৃগয়া] [তথ্য] [নমুনা]
বেলা যে চলে যায় কাল মৃগয়া] [তথ্য] [নমুনা]
সমুখেতে বহিছে তটিনী [তথ্য] [নমুনা]