নিষ্কৃতি
(১৯১৭)
শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
এক | দুই | তিন | চার | পাঁচ | ছয় | সাত | আট | নয়
হরিশের স্ত্রী নয়নতারা বিদেশে থাকিয়া বেশ একটু সাহেবিয়ানা শিখিয়াছিল। ছেলেদের সে বিলাতী পোশাক ছাড়া বাহির হইতে দিত না। আজ সকালে সিদ্ধেশ্বরী আহ্নিকে বসিয়াছিল, কন্যা নীলাম্বরী ঔষধের তোড়জোড় সুমুখে লইয়া বসিয়াছিল, এমন সময় নয়নতারা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, দিদি, দরজি অতুলের কোট তৈরি করে এনেচে, কুড়িটা টাকা দিতে হবে যে।
সিদ্ধেশ্বরী আহ্নিক ভুলিয়া বলিয়া উঠিলেন,
জামার দাম কুড়ি টাকা?
নয়নতারা একটু হাসিয়া বলিল,
এ আর বেশী কি দিদি?
আমার
অতুলের এক-একটি সুট তৈরি করতে ষাট-সত্তর টাকা লেগে গেছে।
'সুট'
কথাটা সিদ্ধেশ্বরী বুঝিলেন
না, চাহিয়া রহিলেন।
নয়নতারা বুঝাইয়া বলিল,
কোট,
প্যান্ট, নেকটাই— এইসব আমরা সুট বলি।
সিদ্ধেশ্বরী ক্ষুব্ধভাবে মেয়েকে বলিলেন,
নীলা,
তোর খুড়ীমাকে ডেকে দে,
টাকা বা'র
করে দিয়ে যাক।
নয়নতারা বলিল,
চাবিটা দাও না—
আমিই বা'র
করে নিচ্ছি।
নীলা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল—
সে-ই বলিল,
মা কোথা পাবেন,
লোয়ার সিন্দুকের চাবি বরাবর
খুড়ীমার কাছে থাকে,
বলিয়া চলিয়া
গেল।
কথা শুনিয়া নয়নতারার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল।
কহিল,
ছোটবৌ এতদিন ছিল না,
তাই বুঝি দিনকতক সিন্দুকের
চাবি তোমার কাছে ছিল দিদি?
সিদ্ধেশ্বরী আহ্নিক করিতে শুরু করিয়াছিলেন,
জবাব দিলেন
না।
মিনিট-দশেক পরে টাকা বাহির করিয়া দিতে শৈলজা যখন ঘরে আসিয়া ঢুকিল,
তখন
অতুলের নূতন কোট লইয়া রীতিমত আলোচনা শুরু হইয়া গিয়াছে। অতুল কোটটা গায়ে দিয়া ইহার
কাটছাট প্রভৃতি বুঝাইয়া দিতেছে এবং তাহার মা ও হরিচরণ মুগ্ধচক্ষে চাহিয়া ফ্যাশন
সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করিতেছে।
অতুল বলিল,
ছোটখুড়ীমা,
তুমি দেখ ত
কেমন তৈরি করেচে।
শৈল সংক্ষেপে বেশ বলিয়া সিন্দুক খুলিয়া কুড়িটা টাকা গণিয়া তাহার হাতে দিল।
নয়নতারা উপস্থিত সকলকে শুনাইয়া নিজের ছেলেকে উদ্দেশ করিয়া বলিল,
তোর তোরঙ্গভরা পোশাক,
তবু
তোর আর কিছুতেই হয় না।
ছেলে
অধীরভাবে জবাব দিল,
কতবার বলব মা তোমাকে?
আজকালকার ফ্যাশন এইরকম।
কাটছাঁট অন্ততঃ একটাও এরকমের না থাকলে লোকে হাসবে যে! বলিয়া টাকা লইয়া বাহিরে
যাইতেছিল, হঠাৎ
থামিয়া বলিল, আমাদের
হরিদা যা গায়ে দিয়ে বাইরে যায়,
দেখে আমারই লজ্জা করে। এখানে
ঝুলে আছে, ওখানে
কুঁচকে আছে—
ছি ছি,
কি বিশ্রীই দেখায়! তারপর
হাসিয়া হাত-পা নাড়িয়া বলিল,
ঠিক যেন একটা
পাশবালিশ হেঁটে যাচ্চে!
ছেলের ভঙ্গী দেখিয়া নয়নতারা
খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। নীলা মুখ ফিরাইয়া হাসি চাপিতে লাগিল।
হরিচরণ করুণচক্ষে ছোটখুড়ীর মুখপানে চাহিয়া লজ্জায় মাথাটা হেঁট করিল।
সিদ্ধেশ্বরী নামেমাত্র আহ্নিক করিতেছিলেন,
ছেলের মুখ দেখিয়া ব্যথা
পাইলেন। রাগ করিয়া বলিলেন,
সত্যিই ত! ওদের প্রাণে কি
সাধ-আহ্লাদ থাকতে নেই শৈল?
দে না,
বাছাদের সব
দুটো জামাটামা তৈরি করিয়ে।
অতুল মুরুব্বির মত হাত নাড়িয়া বলিল,
আমাকে টাকা দাও জ্যাঠাইমা,
আমার দরজিকে দিয়ে দস্তুরমতো
তৈরি করিয়ে দেব—
বাবা,
আমাকে ফাঁকি
দেবার জো নেই।
নয়নতারা পুত্রের হুঁশিয়ারী সম্বন্ধে কি-একটা বলিতে চাহিল,
কিন্তু তাহার পূর্বেই শৈল
গম্ভীর দৃঢ়স্বরে বলিয়া উঠিল,
তোমার জ্যাঠামো করতে হবে না
বাবা,
তুমি নিজের চরকায় তেল দাও গে। ওদের জামা তৈরি করবার লোক আছে। বলিয়া
আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা ঝনাৎ করিয়া পিঠে ফেলিয়া বাহির হইয়া গেল।
নয়নতারা সক্রোধে বলিল,
দিদি,
ছোটবোর কথা শুনলে?
কেন,
কি অন্যায় কথাটা অতুল বলেচে
শুনি?
সিদ্ধেশ্বরী জবাব দিলেন না। বোধ করি,
ইষ্টমন্ত্র জপ করিতেছিলেন,
তাই শুনিতে পাইলেন না।
কিন্তু শৈল শুনিতে পাইল। সে দু পা পিছাইয়া আসিয়া মেজজায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল,
ছোটবোর কথা দিদি অনেক
শুনেচে—তুমিই শোননি। অতুল ছোটভাই হয়ে হরিকে যেমন করে ভ্যাঙালে, আর তুমি
খিলখিল করে হাসলে—
ও আমার পেটের ছেলে
হলে আজ ওকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলতুম। বলিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেল।
ঘরসুদ্ধ সবাই স্তব্ধ হইয়া রহিল। খানিক পরে নয়নতারা একটা নিশ্বাস
ফেলিয়া বড়জাকে সম্বোধন করিয়া বলিল,
দিদি,
আজ আমার অতুলের জন্মবার,
আর
ছোটবৌ যা মুখে এল তাই বলে তাকে গাল দিয়ে গেল!
সিদ্ধেশ্বরী দুই জায়ের কলহের সূচনায় নিঃশব্দে সভয়ে ইষ্টনাম জপিতে লাগিলেন।
নয়নতারা জবাব না পাইয়া পুনরায় কহিল,
তুমি নিজে
কিছু না করে দিলে আমাদেরই যা হোক একটা উপায় করে নিতে হবে।
তথাপি সিদ্ধেশ্বরী কথা কহিলেন না। তখন নয়নতারা ছেলেকে লইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া
গেল।
কিন্তু মিনিট-দশেক পরে সিদ্ধেশ্বরী আহ্নিক সারিয়া গাত্রোত্থান করিতেই মেজবৌ ফিরিয়া
আসিয়া দাঁড়াইল,
কবাটের আড়ালে
অপেক্ষা করিতেছিল মাত্র।
সিদ্ধেশ্বরী সভয়ে শুষ্কমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন,
কি মেজবৌ?
নয়নতারা কহিল,
সেই কথাই জানতে এসেছি। আমি
কারুর খাইনে পরিনে দিদি যে,
দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে মুখ বুজে ঝাঁটা খাবো।
সিদ্ধেশ্বরী তাহাকে শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে বিনীতভাবে বলিলেন,
ঝাঁটা মারবে কেন মেজবৌ,
ওর ঐরকম কথা। তা ছাড়া তোমাকে
ত বলেনি,
শুধু—
শুধু অতুলকে জ্যান্ত পুঁততে চেয়েছিল। আর আমি খিলখিল করে হাসি! শাগ দিয়ে মাছ ঢেকো না
দিদি—
আবার ঝ্যাঁটা লোকে কি করে
মারে?
ধরে মারেনি বলে বুঝি তোমার
মন ওঠেনি?
সিদ্ধেশ্বরী অবাক হইয়া গেলেন। আস্তে আস্তে বলিলেন,
ও কি কথা মেজবৌ?
আমি কি তাকে শিখিয়ে দিয়েচি?
মেজবৌ চাবির ব্যাপার হইতেই অন্তরে জ্বলিয়া মরিতেছিল,
উদ্ধতভাবে জবাব দিল,
সে তুমিই জানো। কেউ কারো মন
জানতে যায় না দিদি,
চোখে দেখে, কানে
শুনেই বলতে হয়। আমরা নূতন লোক,
তোমার সংসারে এসে পড়ে যদি
আপদ-বালাই হয়ে থাকি,
বেশ ত, তুমি নিজে
বললেই ত ভাল হয়, আর
একজনকে লেলিয়ে দেওয়া কেন?
এ
অভিযোগের উত্তর সিদ্ধেশ্বরীর মুখে যোগাইল না,
তিনি
বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিলেন।
মেজবৌ অধিকতর কঠোরস্বরে কহিল,
আমরাও ঘাস খাইনে দিদি,
সব বুঝি। কিন্তু এমন করে না
তাড়িয়ে দুটো মিষ্টি কথায় বিদেয় করলেই ত দেখতে শুনতে ভাল হয়,
আমরাও স-মানে চলে যাই। উঃ
—উনি শুনলে একেবারে
আকাশ থেকে পড়বেন। যাকে তাকে বলে বেড়ান,
আমাদের
বৌঠাকরুন মানুষ নয়—সাক্ষাৎ ঠাকুরদেবতা!
সিদ্ধেশ্বরী কাঁদিয়া ফেলিলেন। রুদ্ধস্বরে বলিলেন,
এমন অপবাদ আমার শত্তুরেও
দিতে পারে না মেজবৌ! এ-সব কথা ঠাকুরপোকে শোনানোর চেয়ে আমার মরণ ভাল। তোমরা এসেচ বলে
আমার কত আহ্লাদ—
আমার কানাই পটলকে আনো,
আমি
তাদের মাথায় হাত দিয়ে—
কথাটা শেষ হইল না। শৈল একবাটি দুধ লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল,
আহ্নিক হয়েচে?
একটু দুধ খাও
দিদি।
সিদ্বেশ্বরী কান্না ভুলিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, বেরো আমার
সুমুখ থেকে—
দূর হয়ে যা।
হঠাৎ শৈল থতমত খাইয়া চাহিয়া রহিল।
সিদ্ধেশ্বরী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন,
তোর যা মুখে আসবে তাই লোককে
বলবি কেন?
কাকে
কি বলেচি?
সিদ্ধেশ্বরী এ প্রশ্ন কানেও তুলিলেন না,
তেমনি চেঁচাইয়া বলিতে
লাগিলেন, আমাকে বলে
বলে তোর বুক বেড়ে গেছে—
কে তোর কথার ধার ধারে
লা? সবাইকে তুই দিদি
পেয়েচিস?
দূর হ আমার সুমুখ থেকে।
শৈল সহজভাবে বলিল,
আচ্ছা আচ্ছা,
দুধ খেয়ে নাও,
আমি যাচ্ছি।
এ বাটিটায় আমার দরকার।
তাহার নিরুদ্বিগ্ন কথা শুনিয়া সিদ্ধেশ্বরী অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিলেন,
খাবো না,
কিচ্ছু খাবো না,
তুই যা। হয় তুই বাড়ি থেকে
বেরো,
না হয় আমি বেরোই—
দুটোর একটা না করে
আমি জলস্পর্শ করব না।
শৈল তেমনি সহজ গলায় বলিল, আমি এই সেদিন এসেচি দিদি এখন যেতে পারব না। তার চেয়ে বরং তুমিই গিয়ে আর দিনকতক কাটোয়ায় থাক গে— কাছেই গঙ্গা— অমনি বা'র করে নিয়ে গেলেই হবে। আচ্ছা মেজদি, কি তুচ্ছ কথা নিয়ে সকালবেলা তোলপাড় ক'চ্চ বল ত? জ্বরে জ্বরে দিদি আধমরা হয়ে রয়েছে, ওঁকে কেন বিঁধচ? আমি যদি দোষ করে থাকি, আমাকে বললেই ত হয়— কি হয়েচে বল?
সিদ্ধেশ্বরী চোখ মুছিয়া হাসিয়া বলিলেন,
আজ অতুলের জন্মদিন,
কেন তুই বাছাকে অমন কথা বললি?
শৈল
হাসিয়া উঠিল,
ওঃ এই! কিছু ভয় করো না
মেজদি—
তোমার মত আমিও ত মা। আমার
হরিচরণ, কানু,
পটল যেমন,
অতুলও তেমনি। মায়ের কথায় গাল
লাগে না মেজদি; আচ্ছা,
আমি তাকে ডেকে আশীর্বাদ
করছি—
নাও দিদি,
তুমি খেয়ে নাও,
আমি
কড়া চড়িয়ে এসেচি।
সিদ্ধেশ্বরীর মুখে কান্নার সঙ্গে হাসি ফুটিয়া উঠিল,
বলিলেন,
আচ্ছা,
তোর মেজদির কাছেও ঘাট মান,
তুই
তাকেও মন্দ বলেচিস।
আচ্ছা মানচি,
বলিয়া শৈল তৎক্ষণাৎ হেঁট
হইয়া হাত দিয়া নয়নতারার পা ছুঁইয়া কহিল,
যদি অন্যায় করে থাকি মেজদি,
মাপ
কর—
আমি ঘাট মানচি।
নয়নতারা হাত বাড়াইয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়া মুখখানা
হাঁড়ির মত করিয়া চুপ করিয়া রহিল।
সিদ্ধেশ্বরীর বুকের ভারী বোঝা নামিয়া গেল। তিনি স্নেহে আনন্দে গলিয়া
গিয়া নয়নতারার মত ছোটজায়ের চিবুক স্পর্শ করিয়া মেজজাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,
এ পাগলীর কথায় কোনদিন রাগ
করো না মেজবৌ? এই
আমাকেই দেখ না—
ওকে বকি-ঝকি কত
গালমন্দ করি; কিন্তু
একদণ্ড দেখতে না পেলে বুকের ভেতরে কি যেন আঁচড়াতে থাকে—
এত দুধ ত খেতে পারব
না দিদি?
পারবে,
খাও।
সিদ্ধেশ্বরী আর তর্ক না করিয়া জোর করিয়া সমস্তটা খাইয়া ফেলিয়া বলিলেন,
এক্ষণি বাছাকে ডেকে আশীর্বাদ করিস শৈল।
এক্ষণি করচি,
বলিয়া শৈল
হাসিয়া খালি বাটিটা হাতে করিয়া বাহির হইয়া গেল।