নিষ্কৃতি
(১৯১৭)
শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
এক | দুই | তিন | চার | পাঁচ | ছয় | সাত | আট | নয়
সিদ্ধেশ্বরীর সেবার ভার নয়নতারা গ্রহণ করিয়াছিল। সে সেবা এমনি নিরেট,
এমনি ভরাট যে,
তাহার কোন এতটুকু ফাঁক দিয়া
আর কাহারও কাছে ঘেঁষিবার জো ছিল না। সিদ্ধেশ্বরী এমন সেবা তাঁর এতখানি বয়সে কখনও
কাহারও কাছে পান নাই। তবুও কেন যে তাঁহার অশান্ত মন অনুক্ষণ শুধু ছল ধরিয়া কলহ
করিবার জন্য উন্মুখ হইয়াছিল এ রহস্য জানিত শুধু অন্তর্যামী। সেদিন সকালে
সিদ্ধেশ্বরী ছয়মাসের রোগীর মত টলিয়া টলিয়া রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়া ধপ্ করিয়া
বসিয়া পড়িলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শ্রান্ত-দুর্বলকণ্ঠে,
বোধ করি বা সুমুখের
দেয়ালটাকেই উপলক্ষ করিয়া বলিতে লাগিলেন,
আপনার জন বটে মেজবৌ,
সে না
থাকলে আমাকে দেখচি বেঘোরে মরতে হয়। এমনি সেবাযত্ন আমার মায়ের পেটের বোন থাকলে করতে
পারত না।
শৈল ঘরের ভিতরে রাঁধিতেছিল,
সমস্তই শুনিতে পাইল। এই কয়টা
দিন সে বড়জায়ের ঘরেও যায় নাই,
তাঁহার সঙ্গে
কথাও কহে নাই। এখনও চুপ করিয়া রহিল।
সিদ্ধেশ্বরী পুনরায় শুরু করিলেন,
আর অপরকে খাওয়ানো-পরানো শুধু
অধর্মের ভোগ—ভস্মে ঘি ঢালা। অসময়ে কোন কাজেই আসে না। আর এই আমার মেজবৌ। মুখের কথাটি
খসাতে হয় না, হাঁ-হাঁ
করে এসে পড়ে। আমি হেঁটে গেলে তার বুকে বাজে। আমার পোড়া কপাল যে,
এমন মানুষকেও আমি পরের
ভাঙ্চি শুনে পর মনে করেছিলুম।
শৈলর চুড়ির শব্দ,
হাতা-বেড়ি নাড়ার শব্দ সবই
তাঁহার কানে আসিতেছে। এত কাছে থাকিয়াও সে যখন এতবড় মিথ্যা অভিযোগের কোন জবাব দিল না,
তখন আর তাঁহার অধৈর্য্যের
সীমা রহিল না। তাঁর চিঁচিঁ কণ্ঠস্বর একমুহূর্তেই প্রবল ও সতেজ হইয়া উঠিল;
মায়ের কাছ থেকে একখানা চিঠি
এসেচে তা যে কারুকে দিয়ে একটুখানি পড়িয়ে শুনব,
আমার সে জোটি পর্যন্ত নেই।
পরকে খাওয়ান-পরান আমার কিসের জন্যে?
নীলা ছোটখুড়ীর কাছে বসিয়া তাহাকে সাহায্য করিতেছিল;
সেইখান হইতে কহিল,
সে চিঠি যে মেজখুড়ীমা তোমাকে
দু-তিনবার পড়ে শোনালেন মা! আবার কবে নতুন চিঠি এল?
তুই সব কথায় গিন্নীপনা করতে যাসনে নীলা,
বলিয়া মেয়েকে একটা ধমক দিয়া
সিদ্ধেশ্বরী বলিলেন,
চিঠি শুনলেই হ'লো।
তার জবাব দিতে হবে না?
কেন তোর ছোটখুড়ী কি মরেছে যে
আমি ও-পাড়ার লোক ডেকে এনে চিঠির জবাব লেখাব?
নীলাও রাগ করিয়া বলিল,
চিঠি লেখবার কি আর কেউ নেই
মা, যে আজ
সংক্রান্তির দিনটায় তুমি খুড়ীমাকে মরিয়ে দিচ্চ?
আজ সংক্রান্তি,
সে কথাটা সিদ্ধেশ্বরীর স্মরণ
ছিল না। তিনি একমুহূর্তেই একেবারে পাংশু হইয়া বলিলেন,
তুই যে অবাক করলি নীলা?
বালাই ষাট! মরবার কথা আমি
তাকে আবার কখন বললুম লা?
পেটের মেয়ে আমাকে মুখনাড়া
দেয়! কাল যার বিয়ে দিয়ে এনে কোলেপিঠে মানুষ করলুম,
সে আমার ছায়া মাড়ায় না;
এত যে রোগে ভুগচি,
তবুও
ত আমার মরণ হয় না! আজ থেকে আর যদি একফোঁটা ওষুধ খাই ত আমার অতি বড়—
কান্নায় সিদ্ধেশ্বরীর কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। তিনি আঁচলে চোখ মুছিতে
মুছিতে নিজের ঘরে গিয়া একেবারে মড়ার মত বিছানায় শুইয়া পড়িলেন।
নয়নতারা পাশের বারান্দায় জানালার আড়ালে দাঁড়াইয়া সমস্তই দেখিতেছিল;
এখন ধীরে ধীরে সিদ্ধেশ্বরীর
ঘরে ঢুকিয়া তাঁহার পায়ের কাছে গিয়া বসিল। আস্তে আস্তে বলিল,
একখানা চিঠির জবাব দেবার
জন্য আবার তার খোশামোদ করতে যাওয়া কেন দিদি?
আমাকে হুকুম
করলে ত দশখানা জবাব লিখে দিতে পারতুম।
সিদ্ধেশ্বরী কথা কহিলেন না;
পাশ ফিরিয়া
দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়া শুইলেন।
নয়নতারা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল,
তাহলে এখনি কি সেটা লিখে
দিতে হবে দিদি?
সিদ্ধেশ্বরী হঠাৎ রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিলেন,
তুমি বড় বকাও মেজবৌ। বলচি,
সে
এখন থাক—
সে তুমি পারবে না। তা না—
নয়নতারা রাগ করিল না। যেখানে কাজ আদায় করিতে হয়,
সেখানে তার ক্রোধ-অভিমান প্রকাশ পাইত না। সে নীরবে উঠিয়া গেল।
বেলা দুটা-আড়াইটার সময় সিদ্ধেশ্বরী মেয়েকে ডাকিয়া চুপি চুপি
জিজ্ঞাসা করিলেন,
তোর খুড়ীমা ভাত খেয়েছে রে?
নীলা আশ্চর্য় হইয়া বলিল,
খাবেন না কেন?
রোজ যেমন খান,
তেমনিই ত
খেয়েছেন।
সিদ্ধেশ্বরী হুঁ বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
পূর্বেই বলিয়াছি,
শৈল চিরকালই অত্যন্ত
অভিমানী। সামান্য কারণেই সে খাওয়া বন্ধ করিত এবং তাই লইয়া সিদ্ধেশ্বরীর যন্ত্রণার
অবধি ছিল না। হাতে ধরিয়া খোশামোদ করিয়া গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া নানা প্রকারে তাহাকে
প্রসন্ন করিতে হইত। অথচ;
সেই শৈল এবার খাওয়া-পরা
সম্বন্ধে এত গঞ্জনাতেও
কেন যে বিন্দুমাত্র ক্রোধ প্রকাশ করিতেছে না,
ইহার কোন কারণই তিনি ভাবিয়া
স্থির করিতে পারিলেন না। তাহার এই ব্যবহার তাঁহার কাছে যতই অপরিচিত এবং অস্বাভাবিক
ঠেকিতে লাগিল, ততই
তিনি অন্তরের মধ্যে ভয়ে ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিলেন। কোনমতে একটা প্রকাশ্য কলহ হইয়া
গেলেই তিনি বাঁচেন—
কিন্তু তাহার ধার দিয়াও শৈল যায় না। প্রভাত হইতে রাত্রি পর্যন্ত
সে তাহার নির্দিষ্ট কাজ করিয়া যায়। তাহার আচরণে বাড়ির কেহ কিছুই দেখিতে পায় না;
শুধু যিনি দশ বছরের মেয়েটিকে
বুক দিয়া মানুষ করিয়া আজ এত বড় করিয়া তুলিয়াছেন,
তিনিই কেবল
ভয়ার্তচিত্তে অনুক্ষণ অনুভব করেন শৈলর চারিপাশে একটা নির্মম ঔদাসীন্যের গাঢ় মেঘ
প্রতিদিনই পুঞ্জীভূত হইয়া তাহাকে শুধু ঝাপসা দুর্নিরীক্ষ্য করিয়াই আনিতেছে।
নীলা কহিল,
মা,
আমি যাই?
মা জিজ্ঞাসা করিল,
কোথায় শুনি?
নীলা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
সিদ্ধেশ্বরী তখন ক্রোধে উঠিয়া বসিয়া,
চেঁচাইয়া কহিলেন,
কোথায় যেতে হবে শুনি?
ছোটখুড়ীর সঙ্গে তোর এত কি লা
যে একদণ্ড আমার কাছে বসতে পারিস না?
বসে থাক
পোড়ারমুখী চুপ
করে এইখানে। কোথাও তোকে যেতে হবে না। বলিয়া নিজেই ধপ্ করিয়া শুইয়া
পড়িয়া অন্যদিকে মুখ করিয়া রহিলেন।
নয়নতারা মৃদু-পদক্ষেপে প্রবেশ করিয়া সস্নেহে অনুযোগের স্বরে কহিল,
ছি মা,
বড় হয়েচ,
দু'দিন
পরে শ্বশুরঘর করতে চলে যাবে,
এখন যে ক'দিন
পাও বাপ-মায়ের সেবা করে নাও। মায়ের কাছে বসবে,
দাঁড়াবে,
সঙ্গে সঙ্গে থেকে দুটো ভালো
কথা শিখে নেবে; এ
সময়ে কি যার-তার সঙ্গে সারাদিন কাটানো উচিত?
যাও,
কাছে বসে দু'দণ্ড
পায়ে হাত বুলিয়ে দাও,
দিদি ঘুমিয়ে
পড়ুন। রোগা শরীরে অনেক্ষণ জেগে আছেন।
নীলা মেজখুড়ীর প্রতি প্রসন্ন ছিল না। মুখ তুলিয়া উত্তপ্তকণ্ঠে কহিল,
বাড়ির মধ্যে যার-তার সঙ্গে
আর কার সঙ্গে সারাদিন কাটাই মেজখুড়ীমা?
তুমি কি খুড়ীমার কথা বলচ?
তাহার রুষ্ট আরক্ত মুখ লক্ষ্য করিয়া নয়নতারা বিস্মিত ও বিরক্ত হইয়া
কহিল,
আমি কারো কথা বলিনি নীলা,
আমি শুধু বলচি,
তোমার
রোগা মায়ের সেবাযত্ন করা উচিত।
সিদ্ধেশ্বরী মুখ না ফিরাইয়া বলিলেন,
সেবাযত্ন করবে! আমি ম'লেই
বরঞ্চ ওরা বাঁচে।
নয়নতারা কহিল,
ভাল,
ওই না হয় ছেলেমানুষ,
জ্ঞানবুদ্ধি নেই,
কিন্তু ছোটবৌ ত ছেলেমানুষ
নয়! তার ত বলা উচিত,
যা নীলা, দু মিনিট
গিয়ে তোর মায়ের কাছে বোস। না সে নিজে একবার আসবে,
না মেয়েটাকে
আসতে দেবে।
নীলা কি একটা জবাব দিতে গিয়া চাপিয়া গিয়া মুখ ভার করিয়া দাঁড়াইয়া
রহিল।
সিদ্ধেশ্বরী মুখ ফিরাইয়া বলিলেন,
তোমাকে সত্যি বলচি মেজবৌ,
আমার
এমন ইচ্ছে করে না যে শৈলর আর মুখ দেখি। আমার যেন সে দুটি চক্ষের বিষ হয়ে গেছে।
নয়নতারা কহিল,
অমন কথা বলো না দিদি। হাজার
হোক সে সকলের ছোট। তুমি রাগ করলে তাদের আর দাঁড়াবার জায়গা নেই,
এ কথাটা ত মনে রাখতে হবে।
ভাল কথা। এ মাসে উনি পাঁচ শ টাকা পেয়েছিলেন,
তার খুচরো ক'টাকা
নিজের হাতে রেখে বাকী টাকা তোমাকে দিতে দিলেন;
এই নাও
দিদি—
বলিয়া নয়নতারা আঁচলের গ্রন্থি খুলিয়া পাঁচখানা নোট বাহির করিয়া দিল।
উদাস-মুখে সিদ্ধেশ্বরী হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিয়া বলিলেন,
নীলা,
যা তোর ছোটখুড়ীমাকে ডেকে আন,
লোহার
সিন্দুকে তুলে রাখুক।
নয়নতারার মুখ কালিবর্ণ হইয়া গেল। এই টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা উপলক্ষ
করিয়া সে কল্পনায় যে-সকল উজ্জ্বল ছবি আঁকিয়া রাখিয়াছিল,
তাহার আগাগোড়া মুছিয়া একাকার
হইয়া গেল। শুধু যে সিদ্ধেশ্বরীর মুখে আনন্দের রেখাটি মাত্র ফুটিল না,
তাহা নয়;
এই টাকাটা তুলিবার জন্য
অবশেষে এই ছোটবৌকেই কিনা ডাক পড়িল—
সিন্দুকের চাবি এখনও তাহারই হাতে! বস্তুতঃ,
এই টাকাটা দেওয়া সম্বন্ধে
একটুখানি গোপন ইতিহাস ছিল। হরিশের দিবার ইচ্ছাই ছিল না,
শুধু নয়নতারা মস্ত একটা জটিল
সাংসারিক চাল চালিবার জন্যই স্বামীকে নিরন্তর খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া ইহা বাহির করিয়া
আনিয়াছিল। এখন সিদ্ধেশ্বরীর এই নিস্পৃহ আচরণে এতগুলো টাকা ত জলে গেলই,
উপরন্তু রোষে ক্ষোভে তাহার নিজের মাথাটা নিজের হাতে ভাঙ্গিয়া ফেলিবার ইচ্ছা করিতে
লাগিল।
শৈল আসিয়া উপস্থিত হইল। ছয়দিন পরে সে বড়জায়ের মুখের পানে চাহিয়া
সহজভাবে জিজ্ঞাসা করিল,
দিদি কি আমাকে ডাকছিলে?
শৈলর মুখের মাত্র এই দুটি কথার প্রশ্নই সিদ্ধেশ্বরীর কানের মধ্যে
অজস্র মধু ঢালিয়া দিল। তিনি চক্ষের পলকে বিগলিতচিত্তে শশব্যস্তে উঠিয়া বলিলেন,
হাঁ দিদি,
ডাকছিলুম বৈ কি! অনেকগুলো
টাকা বাইরে রয়েছে,
তাই নীলাকে বললুম, যা
মা, তোর খুড়ীমাকে
একবার ডেকে আন,
টাকাগুলো
তুলে ফেলুক। এই নাও—
বলিয়া তিনি শৈলর প্রসারিত ডান হাতের উপর নোট কয়খানি ধরিয়া
দিলেন।
শৈল আঁচলে-বাঁধা চাবি দিয়া সিন্দুক খুলিয়া ধীরে-সুস্থে টাকা তুলিতে
লাগিল,
চাহিয়া চাহিয়া নয়নতারার
অসহ্য হইয়া উঠিল। তথাপি ভিতরের চাঞ্চল্য কোনমতে দমন করিয়া,
একটুখানি শুষ্ক হাসি হাসিয়া
কহিল, তাই তোমার দেওর
কাল আমাকে বললেন,
দিদি, 'জাঠতুত-খুড়তুত
ভাই নয়, মায়ের পেটের
বড় ভাই। তাঁর খাব না,
পরব না ত আর যাব কোথায়?
তবু,
মাসে মাসে এমনি পাঁচশ-ছ'শ
টাকা করেও যদি দাদাকে সাহায্য করতে পারি ত অনেক উপকার! কি বল দিদি?
সিদ্ধেশ্বরীর হাসিমুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। তিনি কোন উত্তর না দিয়া
শৈলর পানে চাহিয়া রহিলেন। নয়নতারা বোধ করি তাঁহার গাম্ভীর্যের হেতু অনুমান করিতে
পারিল না। কহিল,
শ্রীরামচন্দ্র কাঠবিড়াল নিয়ে
সাগর বেঁধেছিলেন। তাই তিনি যখন-তখন বলেন,
বড়বোঠান মুখ ফুটে যেন কারো
কাছে কিছু চান না;
কিন্তু তাই বলে কি নিজেদের বিবেচনা থাকবে না?
যার যেমন শক্তি,
কাজ ক'রে
তাকে সাহায্য করা ত চাই। নইলে বসে বসে শুধু গুষ্টিবর্গ মিলে খাবো,
বেড়াবো,
আর ঘুমোবো,
তা করলে কি চলে?
তোমারও ত হরি-মণির জন্যে
কিছু সংস্থান করে যাওয়া চাই! আমাদের জন্যে সর্বস্ব উড়িয়ে দিলে ত তোমার চলবে না। ঠিক
কিনা, সত্যি বল দিদি?
সিদ্ধেশ্বরী মুখ ভার করিয়া বলিলেন,
তা
সত্যি বৈ কি!
শৈল সিন্দুক বন্ধ করিয়া সুমুখে আসিয়া সেই চাবিটা তাহার রিং হইতে
খুলিয়া সিদ্ধেশ্বরীর বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া নীরবে চলিয়া যাইতেছিল,
সিদ্ধেশ্বরী ক্রোধে আগুন
হইয়া উঠিলেন, কিন্তু
আত্মসংবরণ করিয়া তীক্ষ্ণ-ধীরভাবে
কহিলেন, এটা কি হ'লো
ছোটবৌ?
শৈল ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,
ক'দিন
ধরেই ভেবে দেখেছিলুম দিদি,
ও চাবি আমার কাছে রাখা আর
ঠিক নয়। অভাবেই মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়,
আমার অভাব চারিদিকে—
মতিভ্রম
হতে কতক্ষণ, কি বল
মেজদি?
নয়নতারা কহিল,
আমি ত তোমার কোন কথাতেই নেই
ছোটবৌ, আমাকে মিছে
কেন জড়াও?
সিদ্ধেশ্বরী প্রশ্ন করিলেন,
মতিভ্রমটা এতদিন হয়নি কেন,
শুনতে পাই কি?
শৈল কহিল,
একটা জিনিস হয়নি বলে যে কখনো
হবে না, তার মানে
নেই। এমনি ত তোমাদের শুধু আমরা খাচ্চি,
পরচি। না পারি পয়সা দিয়ে
সাহায্য করতে, না
পারি গতর দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু তাই বলে কি চিরকাল করা ভালো?
সিদ্ধেশ্বরী রুদ্ধ রোষে মুখ রাঙ্গা করিয়া কহিলেন,
এত ভাল কবে থেকে হলি লা?
এত ভালমন্দর বিচার এতদিন
তোদের ছিল কোথায়?
শৈল অবিচলিত-স্বরে বলিল,
কেন রাগ করে শরীর খারাপ করচ
দিদি? তোমারও আর
আমাদের নিয়ে ভাল লাগচে না,
আমার নিজেরও
আর ভাল লাগচে না।
ক্রোধে সিদ্ধেশ্বরীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না।
নয়নতারা তাঁহার হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,
দিদির না হয় ভাল না লাগতে
পারে, সে কথা মানি,
কিন্তু তোমার ভাল লাগচে না
কেন ছোটবৌ?
শৈল ইহার জবাব না দিয়াই বাহির হইয়া যাইতেছিল,
সিদ্ধেশ্বরী চেঁচাইয়া ডাকিয়া
বলিলেন, বলে যা
পোড়ারমুখী, কবে তুই
বিদায় হবি—
আমি হরির নোট দেব! আমার সোনার সংসার ঝগড়া-বিবাদে একেবারে পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে
দিলি। মেজবৌ কি মিছে বলে যে,
কোমরের জোর না থাকলে মানুষের
এত তেজ হয় না? কত টাকা
আমার তুই চুরি করেচিস,
তার হিসেব
দিয়ে যা।
শৈল ফিরিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ-চোখ অগ্নিকাণ্ডের মত মুহূর্তকালের
জন্য প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল;
কিন্তু,
পরক্ষণেই সে
মুখ ফিরাইয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।
সিদ্ধেশ্বরী ছিন্ন-শাখার ন্যায় শয্যাতলে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া
উঠিলেন,
হতভাগীকে আমি এতটুকু এনে
মানুষ করেছিলুম মেজবৌ;
সে আমাকে এমনি করে অপমান করে
গেল! কর্তারা বাড়ি আসুন,
ওকে আমি
উঠানের মাঝখানে যদি না আজ জ্যান্ত পুঁতি ত আমার নাম সিদ্ধেশ্বরী নয়।