নিষ্কৃতি
(১৯১৭)
শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
এক | দুই | তিন | চার | পাঁচ | ছয় | সাত | আট | নয়
গোটা-দুই প্রকাণ্ড খাট জোড়া করিয়া সিদ্ধেশ্বরীর বিছানা ছিল। এত বড় শয্যাতেও কিন্তু তাঁহাকে স্থানাভাবে সঙ্কুচিত হইয়া সারারাত্রি কষ্টে কাটাইতে হইত। এ লইয়া তিনি রাগারাগি করিতেও ছাড়িতেন না, আবার বাড়ির কোন ছেলেকে একটা রাত্রিও তিনি কাছছাড়া করিতে পারিতেন না। সমস্ত রাত্রি তাঁহাকে সতর্ক হইয়া থাকিতে হইত, অনেকবার উঠিতে হইত; কোনদিনই সুস্থ নিশ্চিত মনে ঘুমাইতে পারিতেন না; অথচ শৈল কিংবা আর কেহ যে এইসকল উৎপাত হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবে এ অধিকারও কাহাকেও দিতেন না। তাঁহার এতবড় অসুখের সময়ও জ্যাঠাইমার বিছানা ছাড়া কোন ছেলেরই কোথাও ঘুমাইবার স্থান ছিল না। কানাইয়ের শোয়া খারাপ, তাহার জন্য এতটা স্থান চাই, ক্ষুদে প্রায়ই একটা অপরাধ করিয়া ফেলিত, তাহার জন্য অয়েলক্লথের ব্যবস্থা; বিপিন চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিত, তাহার আর-একপ্রকার বন্দোবস্ত; পটলের আড়াই প্রহরের সময় ক্ষুধাবোধ হইত, শিয়রের কাছে সে আয়োজন রাখিতে হইত; খেঁদির বুকের উপর কানাই পা তুলিয়া দিয়াছে কিনা, পটলের নাকটা বিপিনের হাঁটুর তলায় চাপা পড়িয়াছে কিনা, এই সব দেখিতে দেখিতে আর বকিতে বকিতেই সিদ্ধেশ্বরীর রাত্রি পোহাইত।
আজ শোবার সময় বিছানায় এতখানি জায়গা যে খালি পড়িয়া থাকিবে, শৈলর যাবার সময় সিদ্ধেশ্বরীর সে হুঁশ ছিল না। নয়নতারা শতকোটি মাথার দিব্য দিবার পর তিনি রাত্রে নীচে হইতে খাইয়া ঘরে আসিতেছিলেন, হঠাৎ শৈলর ঘরের দিকে চোখ পড়ায় কে যেন তাহার বুকে মুগুর দিয়া মারিল। ঘরে আলো নাই, দরজা দুইটা খোলা— সিদ্ধেশ্বরী মুখ ফিরাইয়া তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। শয্যার প্রতি চাহিয়া দেখিলেন, অল্প একটুখানি স্থানের মধ্যে বিপিন এবং ক্ষুদে ঘুমাইতেছে— বাকী বিছানাটা তপ্ত মরুর মত শূন্য খাঁখাঁ করিতেছে। নিজের অপরিসর স্থানটুকুতে তিনি নীরবে চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িলেন; কিন্তু সেই দুটি নিমীলিত চোখের কোণ বাহিয়া তখন অজস্র তপ্ত-অশ্রুতে তাঁহার মাথার বালিশ ভিজিয়া যাইতে লাগিল। বাটীর ছেলেদের খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তিনি চিরদিনই অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। এ বিষয়ে আপনাকে ছাড়া তিনি আর কাহাকেও একবিন্দু বিশ্বাস করিতেন না। তাঁহার বদ্ধ সংস্কার ছিল, নিজে উপস্থিত না থাকিলেই ছেলেরা নানাপ্রকারে ফাঁকি দিয়া কম খায় এবং এ ফাঁকি তিনি ছাড়া আর কাহারও সাধ্য নাই যে ধরে। দৈবাৎ কোনগতিকে কোন ছেলের খাওয়া চোখে দেখিতে না পাইলে তাহাকে জেরা করিয়া, তাহার পেটে হাত দিয়া অনুভব করিয়া, নানারকমে সিদ্ধেশ্বরী প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেন— সে কিছুতেই তাহার ন্যায্য আহার করে নাই; এবং এই অন্যায়টুকু সংশোধন করিতে হতভাগ্য ছেলেটাকে তখনই তাঁহার চোখের উপর দাঁড়াইয়া একবাটি দুধ খাইতে হইত। শৈল ছেলেদের হইয়া মাঝে মাঝে লড়াই করিত; জবরদস্তি খাওয়ানোর অপকারিতা লইয়া তর্ক করিত; কিন্তু সিদ্ধেশ্বরীকে আন্তরিক ক্রুদ্ধ করিয়া তোলা ভিন্ন তাহাতে আর কোন ফল হইত না। সিদ্ধেশ্বরী যখনই যে ছেলেটার পানে চাহিতেন, তখনই দেখিতেন— সে রোগা হইয়া যাইতেছে। এই লইয়া তাঁহার উৎকণ্ঠা, অশান্তির অবধি ছিল না।
আজ বিছানায় শুইয়া তাঁহার কেবলই মনে হইতে লাগিল,
দেশের বাটীর বহুবিধ
বিশৃঙ্খলার মধ্যে হয়ত কানাইয়ের খাইয়া পেট ভরে নাই এবং পটল নিশ্চয়ই না খাইয়া ঘুমাইয়া
পড়িয়াছে, হয়ত তাহাকে
তুলিয়া খাওয়ানো হইবে না,
হয়ত সে সারারাত্রি ক্ষুধায়
ছটফট করিবে,
—কল্পনায়
যতই এই সকল দুর্ঘটনা তিনি স্পষ্ট দেখিতে লাগিলেন,
ততই রাগে দুঃখে বেদনায়
তাঁহার বুক ফাটিতে লাগিল। পাশের ঘরে গিরীশ অকাতরে ঘুমাইতেছিলেন। আর সহ্য করিতে না
পারিয়া তিনি অনেক রাত্রে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে গিয়া উপস্থিত হইলেন। গায়ে হাত দিয়া
ঘুম ভাঙ্গাইয়া প্রশ্ন করিলেন,
আচ্ছা,
মানলুম যেন,
পটলকে শৈল নিয়ে যেতে পারে,
কিন্তু কানাই ত আর তার পেটের
ছেলে নয়,
—তার ওপর তার
জোর কি?
গিরীশ ঘুমের ঝোঁকে জবাব দিলেন,
কিছু
না।
সিদ্ধেশ্বরী আশান্বিত হইয়া শয্যাংশে বসিয়া বলিলেন,
তা হলে আমরা নালিশ করে দিলে
যে তার শাস্তি হয়ে যেতে পারে। পারে কিনা ঠিক বলো?
গিরীশ অসংশয়ে বলিলেন,
নিশ্চয়
শাস্তি হবে।
সিদ্ধেশ্বরী আশায় আনন্দে উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। পুনশ্চ প্রশ্ন
করিলেন,
সে যেন হ'লো;
কিন্তু ধরো পটল। তাকে ত আমিই
মানুষ করেচি। হাকিমকে যদি বুঝিয়ে বলা যায়,
সে আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না,
চাই কি ভেবে ভেবে তার শক্ত
অসুখ হতে পারে, তাহলে
হাকিম কি রায় দেবে না যে সে তার জ্যাঠাইমার কাছে থাকুক?
বেশ! অমনি
তোমার নাক ডাকচে—
আমার কথা বুঝি তবে শোননি! বলিয়া সিদ্ধেশ্বরী স্বামীর পায়ের উপর
সজোরে নাড়া দিলেন।
গিরীশ জাগিয়া উঠিয়া কহিলেন,
নিশ্চয় না।
সিদ্ধেশ্বরী রাগ করিয়া বলিলেন,
কেন নয়?
মা বলেই যে ছেলেকে মেরে
ফেলবে মহারানীর কিছু এমন হুকুম নেই। কালই যদি মেজঠাকুরপোকে দিয়ে উকীলের চিঠি দিই,
কি হয় তা হলে?
-বলিয়া
সিদ্ধেশ্বরী উত্তরের আশায় ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া প্রত্যুত্তরে স্বামীর নাসিকাধ্বনি
শুনিয়া রাগ করিয়া উঠিয়া গেলেন।
সারারাত্রি তাঁহার লেশমাত্র ঘুম আসিল না। কখন সকাল হইবে,
কখন হরিশকে দিয়া উকীলের চিঠি
পাঠাইয়া ছেলের দাবী করিবেন,
চিঠি পাইয়া তাহারা কিরূপ ভীত
ও অনুতপ্ত হইয়া কানাই ও পটলকে রাখিয়া যাইবে,
এই সমস্ত আশা
ও আকাশকুসুমের কল্পনা তাঁহাকে সমস্ত রাত্রি সজাগ করিয়া রাখিল।
প্রভাত হইতে না হইতে তিনি হরিশের দ্বারে আসিয়া আঘাত করিয়া বলিলেন,
মেজঠাকুরপো,
উঠেচ?
হরিশ ব্যস্ত হইয়া দ্বার খুলিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন।
সিদ্ধেশ্বরী কহিলেন,
দেরি করলে চলবে না,
এখ্খুনি
ছোটঠাকুরপোদের নামে উকীলের চিঠি লিখে,
দরোয়ান পাঠাতে হবে। তুমি বেশ করে একখানা চিঠি লিখে বলে দাও যে,
চব্বিশ
ঘণ্টার মধ্যে জবাব না পেলে নালিশ করা হবে।
হরিশকে এ বিষয় উত্তেজিত করা বাহুল্য। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজী হইয়া,
গলা খাটো করিয়া প্রশ্ন
করিলেন, ব্যাপারটা কি
বল দেখি বড়বৌ? বসো,
বসো—
কি কি নিয়ে গেছে?
দাবীটা একটু বেশী করে দেওয়া
চাই। বুঝলে না?
সিদ্ধেশ্বরী খাটের উপর আসন গ্রহণ করিয়া,
দুই
চক্ষু প্রসারিত করিয়া তাঁহার দাবীটা বিবৃত করিলেন।
বিবরণ শুনিয়া হরিশের হর্ষোজ্জ্বল মুখ কালি হইয়া গেল। কহিলেন,
তুমি কি ক্ষেপেচ বড়বৌঠান?
আমি বলি,
বুঝি আর
—কিছু। তাদের ছেলে
তারা নিয়ে গেছে, তুমি
করবে কি?
সিদ্ধেশ্বরী বিশ্বাস করিলেন না। বলিলেন,
তোমার দাদা যে বললেন,
নালিশ
করলে তাদের সাজা হয়ে যাবে!
হরিশ কহিলেন,
দাদা এমন কথা
বলতেই পারেন না। তোমাকে তামাশা করেচেন।
সিদ্ধেশ্বরী রাগ করিয়া কহিলেন,
এতটা বয়স হ'লো
তামাশা কাকে বলে বুঝিনে ঠাকুরপো?
তোমার মনোগত ইচ্ছে নয় যে,
ছেলে-দুটাকে কাছে আনি। তাই
কেন স্পষ্ট করে বল না?
হরিশ লজ্জিত হইয়া তখন বহুপ্রকারে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন যে,
এ
দাবী আদালত গ্রাহ্য করিবে না। তার চেয়ে বরং আর কোন দাবী-দাওয়া উত্থাপন করিয়া জব্দ
করা যাইতে পারে। আমাদের উচিত এখন তাই করা।
সিদ্ধেশ্বরী ক্রোধভরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন,
কহিলেন,
তোমার উচিত তোমার থাক
ঠাকুরপো; আমার তিনকাল
গিয়ে এককাল ঠেকেছে,
এখন মিথ্যে দাবী-দাওয়া করতে পারবো না। পরকালে আমার হয়ে ত আর তুমি জবাব দিতে যাবে
না! তুমি না লেখো,
আমি মণিকে
পাঠিয়ে নগেনবাবুর কাছ থেকে লিখিয়ে আনি গে। বলিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।
পরদিন সকালবেলায় কি একটা কাজে বাজার-খরচের হিসাব লইয়া সিদ্ধেশ্বরী
বাড়ির সরকার গণেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে বচসা করিতেছিলেন। সে বেচারা নানাপ্রকারে
বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছিল যে,
বারো গণ্ডা টাকার উপর আরও দু'টাকা
খরচ হওয়াতেই পঞ্চাশ টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছে। গৃহিণী এ কর্মে নূতন ব্রতী। তাঁহার নূতন
ধারণা— তাঁহাকে নির্বোধ পাইয়া সবাই টাকা চুরি করে। অতএব চক্রবর্তীও যে চুরি করিয়াছে,
তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি
তর্ক করিতেছিলেন,
পঞ্চাশ টাকা যে এক আঁজলা টাকা গণেশ!
আমি লেখাপড়া জানিনে বলেই কি তুমি বুঝিয়ে দেবে
যে, বারো গণ্ডার ওপর
মোটে দুটি টাকা বেশী খরচ হয়েচে বলে এই পঞ্চশ-পঞ্চাশটে টাকা সব খরচ হয়ে গেছে—
আর কিছু
নেই?
আমি কি এতই বোকা!
গণেশ ব্যাকুল হইয়া বলিল,
মা,
দিদিকে ডেকে
না হয়—
নীলাকে ডেকে হিসেব বুঝতে হবে?
সে আমার চেয়ে বেশী বুঝবে?
না গণেশ,
ওসব ভাল কথা নয়। শৈল নেই
বলেই যে তোমার যা ইচ্ছে তাই করে হিসেব দেবে সে হবে না বলচি। না সে যাবে,
না আমাকে এত ঝঞ্ঝাট পোয়াতে
হবে। পোড়ারমুখীকে দশ-বছরের মেয়ে বৌ করে আনলুম,
বুকে করে মানুষ করে এত বড়
করলুম, এখন সে তেজ
করে বাড়ির দু-দুটো ছেলে নিয়ে পালিয়ে গেল। তা যাক। আমিও খবর রাখচি। কানাই-পটলের
কোনদিন এতটুকু অসুখ শুনতে পেলে দেখব,
কেমন করে সে ছেলে রাখে! তা
এখন যাও—
দুপুরবেলা মনে করে বলে যেয়ো,
এতগুলো টাকা
কোথায় কি করলে।
—বলিয়া গণেশকে বিদায় দিলেন।
সে বেচারা হতবুদ্ধি হইয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
মেজবৌ আসিয়া কহিল,
দিদি,
বলতে পারিনে,
কিন্তু আমিও সংসার চালিয়েচি,
টাকাকড়ি হিসাবপত্র সব
রেখেচি। ছোটবৌ নেই বলে যে এত ঝঞ্ঝাট তুমি সহ্য করবে,
আর আমি বসে বসে দেখব,
সে
ভাল নয়। আমার কাছে কারো চালাকি করে হিসেব গোল করবার জো নেই।
সিদ্ধেশ্বরী কহিলেন,
সে ত ভাল কথা মেজবৌ। আমার এই
রোগা শরীরে এত হাঙ্গামা কি ভাল লাগে! শৈল ছিল—
যেখানকার যত টাকা তার হিসেব করা,
খরচ করা,
ব্যাঙ্কে পাঠানো—
সমস্তই তার
কাজ। এসব কি আর আমাকে দিয়ে হয়?
বেশ ত,
এখন থেকে
তুমিই করো মেজবৌ।
—বলিয়া সিন্দুকের চাবিটা কিন্তু নিজের আঁচলেই বাঁধিয়া ফেলিলেন।
দিন কাটিতে লাগিল। নয়নতারা সহস্র কৌশল উদ্ভাবন করিয়াও লোহার
সিন্দুকের চাবিটা আর নিজের আঁচলে বাঁধিতে সমর্থ হইল না। নয়নতারা অত্যন্ত কৌশলী এবং
চতুর,
অনেকখানি ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কাজ
করিতে পারিত। কিন্তু এই একটা তাহার বড় রকমের গোড়ায় গলদ হইয়া গিয়াছিল যে,
স্বার্থের জন্য নিরীহ লোকের
মনে সংশয়ের বীজ বপন করিলে যথাকালে তাহার ফলভোগ হইতে নিজেকেও দূরে রাখা যায় না। সে
শত্রুপক্ষকে যেমন সন্দেহ করিতে শিখে,
মিত্র পক্ষের উপরও তেমনি
বিশ্বাস হারায়,
সুতরাং সিদ্ধেশ্বরী যে-মুহূর্তে ছোটবৌয়ের প্রতি বিশ্বাস হারাইয়াছেন,
মেজবৌকেও ঠিক
সেই মুহূর্তেই অবিশ্বাস করিতে শিখিয়াছেন।