ভাওয়াল পরগণা
বাংলাদেশের
ঢাকা বিভাগের
গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলার
কিছু অংশ নিয়ে গঠিত মুসলমান শাসনামলে গঠিত প্রশাসনিক এলাকা।
ভাওয়াল নামটি কিভাবে এসেছে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দালিলিক
প্রমাণ নেই। তবে এই নামটিরর বিষয়ে নানা ধরনের মতামত প্রচলিত আছে। যেমন-
- ভগালয় হতে ভাওয়াল। হিন্দু
পৌরাণিক দর্শন মতে- ভগ অর্থ ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী,
জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ছয়টি ভগ বা গুণের যিনি অধিকারী, তিনি ভগবান। আলয় অর্থ নীড়,
ঘর, বাড়ি, আশ্রয়স’ল, নিকেতন, ভবন ইত্যাদি। ভগালয় শব্দের অর্থ দাঁড়ায়
খ্যাতিমান, যশ্বসী, বিক্রমশালী বা সম্পদশালীর ভবন বা নিকেতন। এই অঞ্চলে সম্পদ বা
ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য থাকায় ভগালয় হতে ভাওয়াল শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে ধারণা করে
থাকেন।
- রাজা ভগদত্তের নাম হতে ভাওয়াল:
মহাভারতের মধে
ভগদত্ত
ছিলেন প্রাগ্জ্যোতিষপুরের
রাজা নরকাসুরের পুত্র।
এই এলাকার তিনি শাসক ছিলে।
তাঁর নামানুসারে ভাওয়াল শব্দটি এসেছে।
- আঁতিভোয়াল থেকে ভাওয়াল। অনেকে মনে করেন
যে এই এই এলাকাকে এক সময়
আঁতিভোয়াল বা আঁতিভোল নামে ডাকা হতো। এর
প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করা হয় যে- ভাওয়ালের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র
নদের তীরে আঁতিভোল নামে একটি প্রাচীন নগরী ছিল। আটিয়া ও ভাওয়াল সন্নিহিত দুটি
পরগণার নাম আঁতিভোল হতে এসেছে। এই মতে আঁতিভোয়াল শব্দ থেকে ভাওয়াল নামের
উৎপত্তি হয়েছে।
- ভাওয়াল গাজীর নাম হতে ভাওয়াল।
দিল্লির
সম্রাট আকবরেরে শাসনামলে যে বারো জন ভূঁইয়া তৎকালীন বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা
করেছিলেন, তাঁদের ভিতরে
একজন ছিলেন পাঠান বংশোদ্ভুত ভাওয়াল গাজী। অনেকে মনে করেন
ভাওয়াল গাজী যে এলাকায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, সে
স্থানটি কালক্রমে ভাওয়াল
এবং বর্তমান
গাজীপুর
নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এই মতে বলা হয়- ভাওয়াল গাজীর অধীনস্থ এক জমিদার তাঁর
পরগণার ৯ আনা হিস্যা হিসেবে জনৈক ব্রাহ্মণ কর্মচারীকে এবং বাকি ৭ আনা হিস্যা
হিসেবে দুই জন কায়স্থ
কর্মচারীকে দান করেন। পরে এঁরা দিল্লির মুঘল সম্রাট কর্তৃক জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ
করেছিলেন। ৭ আনা হিস্যার একজন পূবাইলে জমিদারি স্থাপন করেন।
ইনি পূবাইলের জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অপর জন কাশিমপুরে জমিদারি স্থাপন করায়,
তিনি কাশিমপুরের জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অপরদিকে ৯ আনা হিস্যার ব্রাহ্মণ কর্মচারী তাঁর জমিদারি ভাওয়ালে
স্থাপন করায় ভাওয়ালের জমিদার নামে খ্যাত হন।
- উপভাষিক শব্দ হতে ভাওয়ালের উৎপত্তি
ভাওয়াল ও মধুপুর
অরণ্যে এক সময় রাজবংশী ও হাজং
নামক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর লোকেরা বাস করতো। অনেকের মতে
তারা ঘন গজারি জাতীয় গাছে আচ্ছাদিত গহীন লাল মাটির টিলা অঞ্চলকে ভাওয়াল বলে
অভিহিত করতো।
- ওজিয়াল থেকে ভাওয়াল। অনেকের মতে পাঠান ও মুঘলরা তাদের শাসিত ছোট ছোট অঞ্চলকে ওজিয়াল
বলতো। এই ওজিয়াল থেকে ভাজিয়াল বা ভাওয়াল শব্দটি এসেছে।
প্রাচীনকালে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীর হতে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা পার হয়ে
সুসং পাহাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের মধ্যে জয়ানশাহি নামে একটি গহীন অরণ্য অঞ্চল
ছিল। এর উত্তরাংশে ছিল মধুপুর-অরণ্যাঞ্চল
এবং দক্ষিণাংশ ছিল ভাওয়াল-অরণ্যাঞ্চল। কোনো কোনো মতে এর উত্তর দক্ষিণের
দৈর্ঘ্য ছিল পঁয়তাল্লিশ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে ছিল ছয় থেকে ষোল মাইল।
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দি তে পাঠান
ও মুঘল শাসনামলে এখানে এক প্রশাসনিক অঞ্চল
তৈরি করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় ভাওয়াল পরগণা। এই
পরগণার উত্তরে আটিয়া ও আলেপসিং পরগণা, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পূর্বে
লক্ষ্যানদী ও মহেশ্বরদি পরগণা এবং পশ্চিমে কাশিমপুর ও দুর্গাপুর পরগণা।
খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে যশোপাল, শিশুপাল, প্রতাপ ও মহেন্দ্র
নামক শাসকদের দ্বারা ভাওয়ালের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য
গড়ে উঠেছিল। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো পরিচিত ছিল চেদী
রাজ্য নামে। বর্তমানের শ্রীপুর, কালিয়াকৈর (আংশিক) কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, টঙ্গীসহ ময়মনসিংহ
জেলার গফরঁগাও ও ত্রিশাল উপজেলার অংশ বিশেষ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার অংশ বিশেষ,
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার উওরাংশ, টঙ্গীর পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে এই সমস্ত
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেদী রাজ্যগুলো বিদ্যমান ছিল।
সূত্র :