বাংলাদেশের
ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত একটি
জেলা।
এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৩°৫৩´ থেকে ২৪°২১´ উত্তর
অক্ষাংশ এবং ৯০°০৯´ থেকে ৯২°৩৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। এর মোট
আয়তন ১৭৭০.৫৪ বর্গ কিমি।
উত্তরে ময়মনসিংহ ও
কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে
কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা, দক্ষিণে
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এবং
পশ্চিমে ঢাকা ও টাংগাইল জেলা।
প্রশাসনিক বিন্যাস
- উপজেলা ৫টি। গাজীপুর সদর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর,
কালীগঞ্জ।
- থানা ৭টি। জয়দেবপুর, টংগী,
কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, কালীগঞ্জ, হাইওয়ে থানা- সালনা। এছাড়া চৌরাস্তা, কোনাবাড়ী, মীরেরবাজার, বোর্ডবাজার, মৌচাক, কাশিমপুর, টঙ্গী পূর্ব ও টঙ্গী পশ্চিম এ পুলিশ ফাঁড়ি আছে।
- ইউনিয়ন: ৪৪টি
- মৌজা: ৮১৪
- গ্রাম: ১.১৪৬
নদ-নদী: লবলং, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষা, বানার, তুরাগ, বালু, বানার
ইতিহাস: প্রাচীন 'ভাওয়াল' পরগনা বর্তমানে গাজীপুর নামে পরিচিত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে,
সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
ভাওয়াল তথা গাজীপুর,
মৌর্য
সম্রাজ্যের অধিকারে ছিল।
এরূপ ধারণা করা হয় জয়দেবপুরের সাকাশ্বর গ্রামের
সাকাশ্বর স্তম্ভ কারণে।
প্রাচীন কালে এ অঞ্চলের ডবাক ডাকুরাই সাকেশ্বর প্রভূতি অঞ্চলে পাল, দাস, চেদী ও চন্ডালদের
আবাসস্থল ছিল। শুরুর দিকে এখানে চণ্ডালদের একটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে রাজা যশোপাল, শিশুপাল প্রতাপ ও মহেন্দ্ৰ ভাওয়ালের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ স্থাপন করেন। এই ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্যগুলো চেদী রাজ্য নামে পরিচিত ছিল।
এই ক্ষুদ্র চেদী রাজ্যগুলোতে ছিল বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কালিয়াকৈর (আংশিক), কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, টঙ্গীসহ ময়মনসিংহ জেলার গফরগাও ও ত্রিশাল উপজেলার অংশবিশেষ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার অংশবিশেষ, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার উত্তরাংশ এবং টঙ্গীর পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন।
খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে যশোপাল, শিশুপাল, প্রতাপ ও মহেন্দ্র
নামক শাসকদের দ্বারা ভাওয়ালের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য
গড়ে উঠেছিল। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো পরিচিত ছিল চেদী
রাজ্য নামে। বর্তমানের শ্রীপুর, কালিয়াকৈর (আংশিক) কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, টঙ্গীসহ ময়মনসিংহ
জেলার গফরঁগাও ও ত্রিশাল উপজেলার অংশ বিশেষ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার অংশ বিশেষ,
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার উওরাংশ, টঙ্গীর পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে এই সমস্ত
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেদী রাজ্যগুলো বিদ্যমান ছিল।
পরে
পুরো এলাকা সেন
রাজবংশ (১১২৫-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর রাজারা এই অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা নিজেদের
অধীনে আনতে সমর্থ হন। সেন বংশের পতনের পরও সেন বংশের সেনাপতি প্রতাপ রায় ও প্রসন্ন
রায় আপন সাহস ও শক্তি বলে কিছুকাল নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
তাঁদের পতনের পর এই অঞ্চল ভুঁইয়ার অন্যতম ফজল গাজীর অধীনে চলে আসে। ফজল গাজীর পর
দৌলত গাজীর ভাওয়ালের শাসক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময় রাজ্যের সীমা
নিয়ে দৌলত গাজীর সঙ্গে ঢাকার নবাব নাজিমের বাদানুবাদ হয়। এই কারণে দৌলত গাজী ভাওয়াল
পরগণা রক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদ কোর্টে মামলা দায়ের করেন। সে সময়ে মুর্শিদাবাদ
কোর্টে কুশধ্বজ নামে জনৈক মোক্তার মামলা পরিচালনায় প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।
কুশধ্বজের খ্যাতি সম্বন্ধে সম্যক ধারনা পেয়ে দৌলত গাজী মামলা পরিচালনার ভার তার
হাতেই ন্যাস্ত করেন। এই মামলায় দৌলত গাজী জয় লাভ করেন। দৌলত গাজী কৃতজ্ঞতা স্বরূপ
কুশধ্বজকে জয়দেবপুরের 'চান্দনা' গ্রামে একটি বাড়ি ও কিছু জমি প্রদান করেন এবং
পরবর্তী সময়ে তাঁকে দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ দান করেন। শুধু তাই নয়, কুশধ্বজের সততা ও
কর্তব্যনিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে দৌলত গাজী তাঁকে 'রায় চৌধুরী' উপাধিতে ভুষিত করেন।
১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে টোডরমল্ল বিহার ও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সুবা বাংলাকে মোট চব্বিশটি সরকার ও সাতশত মহলে বিভক্ত করে
একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল ওয়াসিল-তুমার-জুমা নামে। এই সময় ভাওয়াল বাজুহা নামক একটি মহল
হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। এর বার্ষিক খাজনা ছিল ১৯.৩৫.১৬০ দম (৪০ দম বা দাম এক টাকা)।
এর কয়েক বছর পর ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে
সম্রাট আকবরের দরবার থেকে প্রকাশিত হয় সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল রচিত আইন-ই- আকবরী নামক মহামূল্যবান গ্রন্থ।
এই গ্রন্থে ভাওয়াল বাজুহার উল্লেখ আছে একাধিকবার। পাহলোয়ান শাহ প্রথমে আস্তানা ফেলেন কালীগঞ্জে চৌরা গ্রামে। তখন কার চেদী রাজ্যগুলোতে ইসলামের বাণী প্রচার করেন এবং একই পথে কারফরমা শাহও ইসলাম প্রচার ও জমিদারী দিল্লী থেকে পরগণা করিয়ে আনেন। কালক্রমে তারই সুযোগ্য উত্তর পুরুষ শাসক ভাহওয়াল গাজী, দিল্লীর পাঠান সুলতানদের শাসনামলের শেষের দিকে চেদী রাজ্যগুলো দখল করে নিজ নামে ভাওয়াল পরগণা হিসেবে কেন্দ্র হতে জমিদারীর আনেন। ভহওয়ালই পরের ভওয়াল নামে পরিচিতি পায়। ভাওয়াল পরগণায় স্থায়িত্ব কাল ছিল ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
দিল্লির
সম্রাট আকবরের শাসনামলে যে বারো জন ভূঁইয়া তৎকালীন বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা
করেছিলেন, তাঁদের ভিতরে একজন ছিলেন পাঠান বংশোদ্ভুত ভাওয়াল গাজী। অনেকে মনে করেন
ভাওয়াল গাজী যে এলাকায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, সে স্থানটি কালক্রমে ভাওয়াল
এবং বর্তমান
গাজীপুর
নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এই মতে বলা হয়- ভাওয়াল গাজীর অধীনস্থ এক জমিদার তাঁর
পরগণার ৯ আনা হিস্যা হিসেবে জনৈক ব্রাহ্মণ কর্মচারীকে এবং বাকি ৭ আনা হিস্যা
হিসেবে দুই জন কায়স্থ
কর্মচারীকে দান করেন। পরে এঁরা দিল্লির মুঘল সম্রাট কর্তৃক জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ
করেছিলেন। ৭ আনা হিস্যার একজন পূবাইলে জমিদারি স্থাপন করেন।
ইনি পূবাইলের জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অপর জন কাশিমপুরে জমিদারি স্থাপন করায়,
তিনি কাশিমপুরের জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অপরদিকে ৯ আনা হিস্যার ব্রাহ্মণ কর্মচারী
কুশধ্বজের পুত্র বলরামকে তাঁর জমিদারি ভাওয়ালে স্থাপন
করার অনুমতি দেন।
১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে
সম্রাট আওরঙ্গজেবর
শাসনামলে
মুরশিদকুলি খাঁ
বাংলায় সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পান পদ দেওয়া হয়। এই সময় তিনি বাংলার রাজধানী
ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দশসালা আইন প্রবর্তন ভেতর
বঙ্গদেশে দেশে মোগল শাসনাধীন জমিদারি প্রথার সূচনা
করেন। তিনি সুবা-ই-বাংলাকে ১৩টি চাকলা এবং ১৬৬০ টি পরগণায় বিভক্ত করেন।
১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে অপুত্রক অবস্থায়
মুরশিদকুলি খাঁর
মৃত্যুর হয়। তবে তিনি মৃত্যুবরণের আগেই তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁকে সিংহাসনের
উত্তরাধিকার করে যান। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পর, সিংহাসন নিয়ে তাঁর জামাত
সুজাউদ্দিন খাঁর
বিবাদ উপস্থিত হয়। পরে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যস্থতায় নবাব হন
সুজাউদ্দিন খাঁ।
১৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দৌলত গাজী মক্কা
থেকে পবিত্র হজ্জব্রত পালন শেষে পায়ে হেঁটে ফেরার সমব
পথিমধ্যে তাঁর মৃত্যু
হয়। দৌলত গাজীর অবর্তমানে সুচতুর বলরাম রায় ও তার সহযোগীদের ষড়যন্ত্রে খাজনা বাকি
পরলে মুর্শিদাবাদের নবাব গাজীর উপর রুষ্ট হন। বলরাম রায় আপন কুটবুদ্ধিতে দৌলত গাজীর
প্রধান প্রধান কর্মচারীর সহযোগিতায় জমিদারি নিলামে তুলে নিজেদের নামেই চিরস্থায়ী
বন্দোবস্ত লিখিয়ে নেন। ১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বলরাম রায়
তাঁর জমাদারি অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিলেন। এই বিচারে বলরাম রায়ই ভাওয়াল
রাজবংশের প্রথম পুরুষ।
তিনি চৌরায় জমিদারির পরিচালনার জন্য বসবাস শুরু করেন।
উল্লেখ্য, বলরাম রায়ের বংশধরেরা নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বিখ্যাত বজ্রযোগিনী
গ্রামের পুশিলাল শোত্রীয় ব্রাহ্মণ গোত্রভুক্ত বলে দাবি করতেন।
১৭৬২-৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি জমা বন্দোবস্ত ও ১৭৭৭
খ্রিষ্টাব্দ থেকে বার্ষিক মেয়াদি জমিদারির বন্দোবস্ত প্রথা চালু হয়।
বলরামের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অত্যন্ত
চতুর ও কৌশলী।
মুর্শিদকুলি
খাঁ মুসলিম-প্রধান এলাকায় হিন্দুদের
জমিদারী প্রদানের সিদ্ধান্ত দেন। ফলে অনেক
মুসলমান জমিদারি হারান। এই সূত্রে
শ্রীকৃষ্ণ
মুর্শিদকুলি
খাঁকে সন্তুষ্ট করে তাঁর ক্ষমতাকে বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজ্য পরিচালনার
সুবিধার্থে শ্রীকৃষ্ণ রায় চান্দনা গ্রামের পূর্বদিকে পাড়াবাড়ি নামক স্থানে চলে
আসেন। পরে কৃষ্ণ রায়ের পুত্র কুমার জয়দেব এখানে একটি রাজবাড়ি
তৈরি করেন।
জয়দেব নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইন্দ্র নারায়ণ এবং ইন্দ্রনারায়ণের
পুত্র কীর্তি নারায়ণ ভাওয়ালের জমিদারি প্রাপ্ত হন। কীর্তি নারায়ণের
মৃত্যুর পর তৎপুত্র লোকনারায়ণ জমিদারি লাভ করেন।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হওয়ার পর, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট মুঘল সম্রাট
দ্বিতীয় শাহ আলমকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বাংলা বিহার
উড়িষ্যার দেওয়ানি বা দেওয়ানি লাভ করে। এরপ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের
সুবিধার্থে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচশালা এবং ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাৎসরিক এবং ১৭৯০
খ্রিষ্টাব্দে দশশালা বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে। দশশালা বন্দোবস্তের আগে তালুকদারগণ
জমিদারগণের মাধ্যমে খাজনা বা রাজস্ব পরিশোধ করতো। দশশালা নীতির ফলে তালুকদারগণ
সরাসরি কোম্পানির নিকট খাজনা পরিশোধের সুযোগ লাভ করে। ফলে কোম্পানি লাভবান হলেও
জমিদারগণ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জমিদাররা এই বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া মেনে নিতে
পারেনি।
১৭৮৭ ও ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্প এই বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে লোকনারায়ণ
রায় পাকা ইমারত নির্মাণের পাশাপাশি রাজউদ্যান ও রাজ-শ্মশান নির্মাণ করেন। বর্তমান
রাজবাড়িটি লোকনারায়ণ রায় তৈরি করেছিলেন। উল্লেখ্য, ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে বেশ খানিকটা
দূরে নোয়াগাঁও মৌজায় ১৯.০৭ এলাকা জুড়ে লোকনারায়ণ রায় রাজউদ্যানটি গড়ে তুলেছিলেন।
লোকনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গোলক নারায়ণ জমিদারি লাভ করে ছিলেন।
গোলক নারায়ণ ইহধাম ত্যাগ করলে তার পুত্র কালি নারায়ণ রায় ভাওয়ালের জমিদার হন
১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট ডিরেক্টর সভায় চিরসস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশকে নির্দেশ দেন। লর্ড কর্ণওয়ালিশ
১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ চিরসস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোষণা দেন। এই বন্দোবস্তেরর ফলে জমিদার ও
স্বাধীন তালুকদারগণ নির্ধারিত রাজস্ব নিয়মিত পরিশোধের বিনিময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে
জমিদারি ভোগের সুযোগ পেলেন। এই আইনে ভবিষ্যতে খরা বা দুর্যোগের কারণে রাজস্ব মওকুফ
রহিত করা হয়। প্রতি বছর ৩০ চৈত্র সূর্যাসে-র পূর্বে নির্ধারিত খাজনা পরিশোধে
ব্যর্থ হলে পুরো জমিদারি অথবা অংশ বিশেষ বিক্রি করে সরকারি পাওনা পরিশোধের
ব্যবসস্থা রাখা হয়। জমিদারগণকে পুলিশি ও ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পালন হতে বিরত
করা হয়। এই আইনে জমিদারগণকে জমিদারি বিক্রয়, বন্ধক, দান বা অন্য কোন ভাবে
হস্তান্তরের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চিরসস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে ভাওয়াল জমিদার পরিবার আশে পাশের বহু ছোট-খাট
জমিদারি এবং জমি ক্রয় করে একটি বড় জমিদারির মালিক হয়।
১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে
এঁরা নীলকর জেমস ওয়াইজের জমিদারি ক্রয়
করে সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগণার মালিক হয়ে যান। সরকারি রাজস্ব নথিপত্র হতে জানা যায়
যে, ভাওয়ালের জমিদার ৪,৪৬,০০০/- টাকা দিয়ে ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেছিলেন।
লোক নারায়ণের
মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গোলক নারায়ণ জমিদারি লাভ করেন। গোলক নারায়ণের মৃত্যুর পর
তাঁর পুত্র কালি নারায়ণ জমিদার হন। ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য পোষণ ও যোগ্যতার
জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে
ঢাকার নর্থব্রুক হলে তৎকালীন ভারতের বড়লাট লর্ড লিটনকে
তিনি এক জাঁকজমক পূর্ণ সংবর্ধনা দেন। বড়লাট কালি নারায়ণের প্রভু ভক্তিতে গদগদ
হয়ে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে
ভাওয়ালের রাজা কালি
নারায়ণ রায় চৌধুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সেই থেকে ভাওয়াল জমিদার পরিবার ভাওয়াল রাজ পরিবারের
মর্যাদা লাভ করে।
রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরীর তিন স্ত্রীর মধ্যে ছোট স্ত্রীর নাম ছিল রাণী
সত্যভামা দেবী। অপর দুই স্ত্রী ছিলেন রাণী যামিনী দেবী এবং রাণী ব্রহ্মময়ী দেবী।
এই দুই রাণী নিঃসন্তান ছিলেন। রাণী সত্যভামা দেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন রাজা
রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং কন্যা কৃপাময়ী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর
রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ভাওয়ালের রাজা হন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বরিশাল
জেলার বানারিপাড়ার বিলাসমণি দেবীকে। রাজা রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পিতার ন্যায়
যোগ্য ও কৌশলী ছিলেন। তিনি জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। এই সময়ে ভাওয়াল জমিদারি
ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বঙ্গের
দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিণত হয়।
রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী রাণী বিলাসমণি দেবীর গর্ভে তিন পুত্র ও
তিন কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন।
- প্রথম সন্তান কন্যা ইন্দুময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল
গোবিন্দচন্দ্র মুখোপধ্যায় এম এ বি এল এর সাথে।
- দ্বিতীয় সন্তান কন্যা জ্যোতির্ময়ী
দেবীর বিয়ে হয়েছিল জগদীশচন্দ্র মুখোপধ্যায়ের সঙ্গে।
- তৃতীয় সন্তান পুত্র
বড়কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন সরযূবালা দেবীকে। তিন
কুমারের মধ্যে রণেন্দ্র নারায়ণ কিছুটা লেখা পড়া শিখেছিলেন। ফলে
তিনি ব্রিটিশ
রাজ পুরুষদের সাথে তিনি যোগাযোগ রক্ষা ও আলাপচারিতা করতে পারতেন। ১৯১২
খ্রিষ্টাব্দে
তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
- চতুর্থ সন্তান পুত্র
কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী কোনরূপ নাম সহি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন
অমিতাচারী। খেলাধুলা আর শিকারের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি ১৯০২
খ্রিষ্টাব্দের মে
মাসে হুগলীর বিষ্ণুপদ মুখার্জির মধ্যমা কন্যা বিভাবতীকে বিয়ে করেন। রমেন্দ্র
নারায়ণ মেজোকুমার নামে পরিচিত ছিলেন।
- পঞ্চম সন্তান পুত্র কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ
রায়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল আনন্দ কুমারী দেবীর। ১৯১২
খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিঃসন্তান
অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
- ষষ্ঠ সন্তান কন্যা তড়িন্ময়ী দেবীর
বিয়ে হয়েছিল বাবু ব্রজলাল ব্যানার্জী এম এ বি এল এর সাথে।
রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়
চৌধুরী ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। হিন্দু
আইনানুসারে তাঁর মৃত্যুর পর ভাওয়াল রাজ্য বা এস্টেটের মালিক হন
তাঁর তিন পুত্র। কিন্তু
কুমারগণ নাবালক থাকায় তাঁদের মা রাণী বিলাসমণি দেবী ট্রাস্টি হিসেবে এস্টেট
পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। আর এ কারণে ভাওয়াল রাজ এস্টেট এক সময়ে রাণী বিলাসমণি
এস্টেট নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রাণী বিলাসমণি মৃত্যু
বরণ করেন। এরপর তিন কুমার সমান
ভাগে ভাওয়াল এস্টেটের মালিকানা
প্রাপ্ত হন। কিন্তু ১৯০৯
খ্রিষ্টাব্দে মেজোকুমার রামেন্দ্র
নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যুর পর এস্টেটের এক তৃতীয় অংশের মালিকানা চলে যায়
তাঁর কথিত বিধবা স্ত্রী বিভাবতী দেবীর হাতে। বিভাবতী তাঁর ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ এর
হাতে এস্টেটের এক তৃতীয়াংশের ভার ছেড়ে দিয়ে কোলকাতায় গিয়ে বিধবা বেশে জীবন
যাপন করতে থাকেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিন
রাজকুমারের মৃত্যুর পর, ব্রিটিশ সরকার
ভাওয়াল রাজ এস্টেট পরিচালনার ভার কোর্ট অব ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৭৯-এর ৬ ধারার ক্ষমতা বলে গ্রহণ করেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও
প্রজাস্বত্ব আইন বলে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটলেও আইনগত জটিলতার কারণে
ভাওয়াল এস্টেটের কিছু কিছু সম্পত্তি এখনও কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেট
নামে বাংলাদেশ সরকার ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে
পরিচালনা করছেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলটি ভাওয়াল রাজার অধীনে ছিল। এখানকার জমিদার জয়দেব নারায়ণ
চিলাই নদীর তীরে (বর্তমানে বিলুপ্ত), একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং নিজের নামে বাড়িটির
নামকরণ করেন জয়দেবপুর। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পান। তখন
থেকে এই বাড়িটি 'রাজবাড়ি' নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। বর্তমানে এই ভবনটি জেলা
প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তান আমলে অঞ্চলটি ঢাকা
বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে আওয়ামীলীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ভাওয়ালগড় জেলা নামে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিন্যাসের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
অন্যদিকে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাগণ ঢাকা সদর উত্তর মহকুমাকে ভাওয়ালগড় মহকুমা নামে জয়দেবপুরে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে
এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে তখন থেকেই এ অঞ্চল ভাওয়ালগড় জেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কালানুক্রমিক ঘটনাবলি:
- ৪ মার্চ (বৃহস্পতিবার, ১৯ ফাল্গুন ১৩৭৭) উপজেলা সদরের টংগীতে প্রতিরোধ সংগ্রামে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
- ১৯ মার্চ (শুক্রবার, ৫ চৈত্র ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ),
পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বাঙালি সৈন্য ও জনতার প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত
হয়েছিল গাজীপুরে। এই যুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে শহিদ হন হরমত
আলী-সহ ২০ জন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এঁদের স্মরণে এই
জাগ্রত চৌরঙ্গী নামে গাজীপুরে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়ক-দ্বীপে নির্মিত হয়েছে
স্মৃতিসৌধ। এছাড়া শহিদদের স্মরণে গাজীপুর
সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য
অনুপ্রেরণা ১৯] [বিস্তারিত:
১৯ মার্চ: গাজীপুর]
- ২৭ মার্চ (শনিবার ১৩ চৈত্র ১৩৭৭) পাকসেনারা টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায়
গণহত্যা করে।
- ৭ এপ্রিল (বুধবার ২৪ চৈত্র ১৩৭৭) জয়দেবপুরে পাকসেনারা গণহত্যা করে।
- ১৭ এপ্রিল (শনিবার ৩ বৈশাখ ১৩৭৮) আরিচাপুরে পাকসেনারা গণহত্যা করে।
- ১৪ মে (শুক্রবার ৩০ বৈশাখ ১৩৭৮) টঙ্গী শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাকসেনারা
গণহত্যা করে।
- ১৭ জুন (বৃহস্পতিবার ২ আষাঢ় ১৩৭৮) শ্রীপুর কলেজ ক্যাম্পাসে গণহত্যা চালায় এবং কাপাসিয়া বাজারে অগ্নিসংযোগ করে।
- ৯ অক্টোবর (শনিবার ২২ আশ্বিন ১৩৭৮) মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়াকৈর পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে ৩৪ জন রাজাকার ও ১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করে।
- ২৮ অক্টোবর (শনিবার ২২ আশ্বিন ১৩৭৮) উপজেলার কাচিঘাটা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধে প্রায় ৫২ জন পাকসেনা নিহত হয়।
- ৩০ অক্টোবর (শনিবার ১২ কার্তিক ১৩৭৮) মুক্তিযোদ্ধারা ফুলবাড়িয়া এলাকায় ৭জন পাকসেনাকে হত্যা করে।
- ১৮ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার ১ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮) কালীগঞ্জ উপজেলার সোমবাজার খালের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ আর্মি ক্যাম্প, থানা ও আড়িখোলা রেলস্টেশন ক্যাম্প দখল করে।
- ১ ডিসেম্বর (বুধবার ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮) খলাপাড়া ন্যাশনাল জুট মিলে ও সাতখামাইরে পাকসেনারা
গণহত্যা করে।
- ৬ ডিসেম্বর (সোনাবার ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮) মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা বহনকারী ৩ টি ট্রাক ধ্বংস করে এবং ২৭ জন
পাকসৈন্য হত্যা করে। কালিয়াকৈর লতিফপুর সেতুর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘটিত যুদ্ধের পরে পাকবাহিনী শ্রীফলতলী গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
- ১৩ ডিসেম্বর (সোমবার ২৬ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮)বংশী সেতুর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের সংঘটিত যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
- ১৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮) পূবাইলে ও নলছাটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধে ৭ জন পাকসেনা এবং মিত্র বাহিনীর
(ভারতীয় সৈন্য) আনুমানিক ২ জন সদস্য নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন
বিশেষ দর্শনীয় স্থান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভাওয়ালগড়কে জেলা হিসেবে উন্নীত করার দাবি উত্থাপন করে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূত্র: