ভাওয়াল রাজবাড়ি
বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে অবস্থিত একটি জমিদার বাড়ি। প্রাসাদটি ঢাকা শহর থেকে উত্তরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শেষের পাঁচ কিলোমিটার প্রাসাদগামী শাখা রাস্তা ময়মনসিংহ ও মির্জাপুর সড়কের ছেদরেখা থেকে পূর্বদিকে প্রসারিত। বর্তমানে এই রাজবাড়ি নব্য সৃষ্ট গাজীপুর জেলার সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জয়দেবপুরের চারদিক টাঙ্গাইল জেলার পূর্ব মধুপুর গড়ের বিস্তৃত গভীর বনভূমির বিখ্যাত গজারি বন দ্বারা পরিবেষ্টিত। রাজবাড়িটি গাজীপুরের জয়দেবপুরের বর্তমান রেল জংশনের খুব কাছে

১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বলরাম রায় তাঁর জমাদারি অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিলেন। এই বিচারে বলরাম রায়ই ভাওয়াল রাজবংশের প্রথম পুরুষ। তিনি চৌরায় জমিদারির পরিচালনার জন্য বসবাস শুরু করেন।  ১৭৬২-৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি জমা বন্দোবস্ত ও ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বার্ষিক মেয়াদি জমিদারির বন্দোবস্ত প্রথা চালু হয়। বলরামের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও কৌশলী। মুর্শিদকুলি খাঁ মুসলিম-প্রধান এলাকায় হিন্দুদের জমিদারী প্রদানের সিদ্ধান্ত দেন। ফলে অনেক মুসলমান জমিদারি হারান। এই সূত্রে শ্রীকৃষ্ণ মুর্শিদকুলি খাঁকে সন্তুষ্ট করে তাঁর ক্ষমতাকে বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে শ্রীকৃষ্ণ রায় চান্দনা গ্রামের পূর্বদিকে পাড়াবাড়ি নামক স্থানে চলে আসেন। পরে কৃষ্ণ রায়ের পুত্র কুমার জয়দেব এখানে একটি রাজবাড়ি তৈরি করেন। এটাই ছিল আদি ভাওয়াল রাজবাড়ি।

১৭৮৭ ও ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্প এই বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে লোকনারায়ণ রায় পাকা ইমারত নির্মাণের পাশাপাশি রাজউদ্যান ও রাজ-শ্মশান নির্মাণ করেন। বর্তমান রাজবাড়িটি লোকনারায়ণ রায় তৈরি করেছিলেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলটি ভাওয়াল রাজার অধীনে ছিল। এখানকার জমিদার জয়দেব নারায়ণ চিলাই নদীর তীরে (বর্তমানে বিলুপ্ত), একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং নিজের নামে বাড়িটির নামকরণ করেন জয়দেবপুর। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পান। তখন থেকে এই বাড়িটি 'রাজবাড়ি' নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। বর্তমানে এই ভবনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

রাজবাড়িটি প্রায় ১৫ একর জমির উপরে তৈরি করা হয়েছিল। ভাওয়াল রাজপ্রাসাদের মূল অক্ষের দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে ১২০ মিটার। প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশের জন্য মূল প্রাসাদ ভবনের প্রায় ৬ মিটার পশ্চাতে দক্ষিণ দিকে চার জোড়া গোলায়িত স্তম্ভের ওপর নির্মিত রয়েছে দ্বিতলবিশিষ্ট একটি প্রবেশ দরদালান বা গাড়িবারান্দা। প্রাসাদের গাড়িবারান্দার পশ্চাতে রয়েছে একটি প্রশস্ত বারান্দা। হলঘরের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে তিনটি করে কক্ষ বিদ্যমান। পরিকল্পনা অনুসারে প্রবেশ হলঘরের ডান দিকে দ্বিতলে ওঠার জন্য রয়েছে কাঠের নির্মিত একটি প্রশস্ত সোপানশ্রেণী।

বড়দালান নামে পরিচিত এই সম্মুখ ব্লকটি ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। প্রবেশদ্বারটি বর্গাকার এবং এর ৪ কোণে ৪টি গোলাকার স্তম্ভ স্থাপন করে উপরে ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রবেশ পথের কাঠামোর একদিকের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার এবং প্রবেশ দ্বারের পরে একটি প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে এর পর হল ঘর। হল ঘরের পূর্ব ও পশ্চিমে ৩টি করে বসার কক্ষ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শাল কাঠের সিড়ি রয়েছে যা উপরের কক্ষসমুহে যাওয়ার সুব্যবস্থারই অংশ। সম্মুখ ভাগের এই অংশ পরিচিত বড় দালান হিসেবে। এই বড় দালানের পিছনে ছিল ১০০ বর্গ ফুটের একটি খোলা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গনের তিন দিক পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ছিল আবাসনের জন্য নির্মিত বারান্দাযুক্ত কক্ষ। বারান্দা ছিল কক্ষসমূহের দিকে উন্মুক্ত এবং বারান্দা গুলিতে করিন্থিয়াস স্তম্ভের উপর অর্ধ বৃত্তাকার খিলান স্থাপন করা হয়েছিল। উপরে ফাকা লম্বাটে নকশা, স্তম্ভে ফুল, লতা ও লম্বা টানা নকশা ছিল।

স্থাপত্যটির ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য নির্মিত ব্লকের পশ্চাতে রয়েছে ৩০ মিটার বর্গাকৃতির একটি উন্মুক্ত অঙ্গন। অঙ্গনে রয়েছে একটি নাটমণ্ডপ। নাটমণ্ডপের উপরিভাগ লোহা ও সিমেন্ট-বালি মিশ্রিত মসলা দিয়ে প্রস্তুতকৃত কতকগুলো নলাকৃতির স্তম্ভের ওপর স্থাপিত ঢেউটিনের ছাদে আচ্ছাদিত। অঙ্গনের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দ্বিতল আবাসিক কক্ষসংবলিত তিনটি ব্লক পরিলক্ষিত হয়। ব্লকসমূহের সম্মুখে অর্ধবৃত্তাকৃতির খিলানসংবলিত টানা বারান্দা বিদ্যমান। অঙ্গনের চতুর্দিকের বারান্দার খিলানসমূহ কতকগুলো করিন্থীয় স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। সর্বোপরি এটি একটি উন্মুক্ত চত্বর, যার দুই প্রান্তে রয়েছে দুটি চৌচালা মন্দির এবং এর পশ্চাতে রয়েছে দ্বিতলবিশিষ্ট একটি সাদাসিধে ইমারত। অধিকন্তু প্রথম অঙ্গনের পশ্চাতে আরো উত্তরে রয়েছে আরেকটি উন্মুক্ত অঙ্গন। এ অঙ্গনের তিন দিক আবাসিক কক্ষসংবলিত তিনটি দ্বিতলবিশিষ্ট ইমারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইমারতগুলোর সম্মুখভাগে গোলায়িত যুগল স্তম্ভের ওপর ছাদ নির্মিত রয়েছে। অঙ্গনের অবশিষ্ট উত্তর দিকে রয়েছে একটি পারিবারিক মন্দির। মন্দিরটির সম্মুখস্থ বারান্দা ছয়টি গোলায়িত স্তম্ভ দ্বারা দুটি সমান সারিতে বিভক্ত। প্রতিটি গোলায়িত স্তম্ভের চারদিক আবার কতকগুলো নলাকৃতির তুশকান স্তম্ভ সংযুক্ত করে

রাজবাড়ীর মধ্যে পশ্চিমাংশের (রাজদিঘীর সংলগ্ন) দ্বিতল ভবনাংশের নাম ওরাজবিলাসহ নিচে রাজার বিশ্রামের কক্ষ ওহাওয়া মহলহ নামে পরিচিত ছিল। মধ্যের একটি দক্ষিণ দিক খোলা খিলানযুক্ত উন্মুক্ত কক্ষের নাম ছিল পদ্মনাভি। পশ্চিম মধ্য দোতলার একটি কক্ষ ছিল রাণী মহল নামে আর সামনের বারান্দাসহ নাম ছিল বড় দালান হিসেবে।

এক সময় রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই পড়ত বড় দালান। এই দালানে অবশ্য রাজপরিবারের কোন লোকজন বসবাস করতেন না। বড় দালানে থাকতেন রাজবাড়ির অতিথিরা। রাজবাড়ির অতিথি হয়ে যারা জঙ্গলে শিকার করতে আসতেন তাঁরা এই বড় দালানে উঠতেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবসস্থা ছিল এই বড় দালানে। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের মিঃ মেয়্যার রাজ এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তিনি বড় দালানটিকে তাঁর নিজের বাসসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। বড় দালানের পিছনেই ছিল 'নাটমন্দির’। এই নাটমন্দিরের দু পাশেই ছিল ঝুল বারান্দা। এই ঝুল বারান্দা ছিল নাটমন্দির ঘিরে দু-পাশের দালানে। এই দোতালা বাড়ির ঝুল বারান্দা থেকে রাজপরিবারের মহিলারা নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি দেখতেন। গান-বাজনা হলে এখানে বসেই তাঁরা সেই সব শুনতেন। বাড়ির একটি ঘরকে ব্যবহার করা হত ঠাকুরঘর হিসেবে। ঠাকুরঘরটিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল জগদ্ধাত্রীর মূর্তি (বিগ্রহ)। জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর নাটমন্দিরে গান-বাজনার আসর বসতো। উত্তর দিকের বাড়ির দোতলার একটি ঘর ছিল রাজবাড়ির সদর বৈঠকখানা।

এই বাড়ির পিছনের দিকে ছিল রাজবাড়ির অন্দরমহল। অন্দরমহলটিকে বলা হতো পুরানো বাড়ি। পুরানো বাড়ির পশ্চিমদিকের অংশটিকে বলা হতো পশ্চিমাখণ্ড। রাজবাড়ির পিছনের দিকে খোলা অংশে ছিল একটি বাগান। পূর্বদিকে চিলাই নদী। পশ্চিমদিকে ছিল একটি বড় দীঘি। রাজবাড়ির মেয়েরা মাধব বাড়ির পাশ দিয়ে পশ্চিমের দীঘিটিতে যাতায়াত করতেন। 'মাধব বাড়িতে’ ছিল ’রাধামাধবের’ মূর্তি। ’রাধা মাধবের’ মূর্তিটি ছিল পাথরের। মাধব বাড়ির পিছনে ছিল রাজবিলাস। রাজা কালি নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজপরিবারের লোকজন সাধারণত বাস করতেন রাজাবিলাসে। জয়দেবপুর বাজবাড়িতে ছিল ডাক্তারখানা, খাজাঞ্চিখানা, ফরাসখানা, বাবুর্চিখানা প্রভৃতি।

সূত্র :