শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। ঢাকা
মহানগরীর মোহাম্মদপুর থানার অন্তর্গত রায়েরবাজার এলাকায় এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা
হয়েছে।
অপারেশন সার্চ লাইটের
মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করেছিল।
পরবর্তী প্রায় ৯ মাস ধরে
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগী পূর্ব-পাকিস্তানের
দালালরা প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা ও প্রায় ২ লক্ষ নারীকে যৌন-নির্যাতন করে। এই
সময়ের ভিতরে মুক্তি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও
তাদের অনুগতদের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়। ক্রমে ক্রমে গ্রামাঞ্চলগুলো মুক্তিবাহিনীর
অধিকারে চলে যেতে থাকে। ডিসেম্বর মাসে পাক-বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ৩রা
ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী
ও মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মিত্রবাহিনীর আক্রমণের মুখে
পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে আসতে থাকে। এক সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়
শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এই সময়
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল
রাও ফরমান আলী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি
আল্ শামস বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা অনুসারে- ১৪ই ডিসেম্বর রাতে অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ ২০০ জন
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গোপনে ধরে নিয়ে আসে। এরপর মিরপুর,
মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ এবং শহরের বিভিন্ন স্থানের নির্যাতন সেলে চোখ
বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এদের হত্যা করে রায়েরবাজার এলাকার পরিত্যাক্ত
ইটাভাটার নিচু
জলাভূমিতে নিক্ষেপ করে। এই জলাভূমিটি বর্তমানে 'রায়ের বাজার বধ্যভূমি' হিসেবে
পরিচিত। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত সারা দেশে
৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত
করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে
নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহিদ
বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময়
বাংলাদেশের গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ স্থপতি
ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে 'বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ'-এর নকশার জন্য জন্য একটি জাতীয় স্থাপত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন
করে।
মোট
২২টি প্রস্তাবনার মধ্যে স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও স্থপতি মোঃ
জামী-আল-সাফী র প্রস্তাবিত নকশা নির্ণায়ক-সভা কর্তৃক নির্বাচিত হয়। এই নকশা
অনুসারে গণপূর্ত বিভাগ
প্রকল্পটি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাস্তবায়ন করে।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এই বধ্যভূমিটি ছিল একটি পরিত্যক্ত ইটভাটা। স্থপতি ফরিদ উদ্দিন
আহমেদ ও স্থপতি মোঃ জামী-আল-সাফী পরিকল্পনায় ইটভাটার আদলটি রেখেছেন। এই স্মৃতিসৌধটি
৩.৫১ একর এলাকার উপর অবস্থিত। স্মৃতিসৌধের যেখানে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল,
সেখানে ১৭.৬৮মি পুরু, ০.৯১মি উচু এবং ১১৫.৮২মি দীর্ঘ বাঁকা ইটের প্রাচীর স্থাপন করা
হয়েছ। প্রাচীর নিজেই দুঃখ ও দুঃখের গভীরতা প্রদর্শক,
তাই এর দুই প্রান্তেই নষ্ট হয়ে গেছে এমনটা দেখানো হয়েছে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এ ৬.১০মি
x
৬.১০মি বর্গাকার জানালা আছে। এই দেয়ালের সামনে রয়েছে একটি
জলাধার। আর এই জলাধারের ভিতরে রয়েছে একটি কালো গ্রানাইটে নির্মিত বর্গাকার স্তম্ভ।
এই স্তম্ভটি রাখা হয়েছে বিষাদের প্রতীক হিসেবে।