বাঙালির খাদ্য ও বাংলাদেশের খাদ্য
মৌলিক মানবিক চাহিদার বিচারে বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে গোড়ার দিকে এই
প্রভাব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল খাদ্যের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে। প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা
কৃষি-কাজ শিখেছিল। সেই সূত্রে বঙ্গদেশের অনার্য এবং আর্য-সংমিশ্রিত প্রাকৃত জনদের
ভিতরে কৃষিকাজ সঞ্চালিত হয়েছিল। বঙ্গদেশের আর্দ্র ভূমি এবং অগভীর পানিতে ধান চাষে
বিশেষ দক্ষ হয়ে উঠছিল। নানা জাতের বুনো ধানগাছের ভিতর থেকে অধিক ফলনশীল সুস্বাদু
ধানকে এরা চাষের তালিকা এনেছিল। সেকালে বঙ্গদেশের ভূমি গমের চাষ উপযোগী ছিল না। ফলে
গম, বার্লি, ভুট্টা বঙ্গদেশে ধান চাষকে ছাপিয়ে কখনো ওঠে নি।
বঙ্গদেশের মিশ্র জাতের মানুষের কাছে ভাত হয়ে উঠেছিল শর্করা জাতীয় খাদ্য চাহিদা
মেটানোর প্রধান উৎস। ভাতের সাথে তরকারি হিসেবে উঠে এসেছিল দেশীয় নানা জাতের
শাক-সব্জি। এসব এরা সিদ্ধ করে ঝোল তরাকারী বা ভর্তা হিসেবে ভাতের সাথে খেতো। গোড়ার
দিকে মশলার ব্যবহার ছিল না। স্বাদে বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব আনার চেষ্টায় সুস্বাদু
নিরামিষ রান্নার বিকাশ ঘটেছিল বহুদিন ধরে। এদের আমিষের তালিকায় নানা ধরনের বন্য
প্রাণী, পাখি ও জলচর প্রাণী। এরা বন্য শুকর, হরিণ, খরগোশ জাতীয় স্থলচর প্রাণী শিকার
করতো। জলচর প্রাণীর ভিতরে ছিল নানা জাতের মাছ, কাছিম, কাঁকড়া ইত্যাদি। টোটেম এবং
ট্যাবুর সূত্রে সকল গোত্রের মানুষ সকল প্রাণী খেতো না। ফলে আংশিকভাবে বাঙালির
পূর্বপুরুষরা সর্বার্থে সর্বভুক হয়ে উঠেনি। অরণ্যবাসী মানুষ বা কৃষি-ভিত্তিক গৃহী
মানুষ বিষাক্ত ফল আর টোটেম-বৃক্ষের ফল ছাড়া সকল ফলই আহার করতো। কালক্রমে বঙ্গদেশের
মানুষের একটি সাধারণ খাদ্য তালিকা তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে। দীর্ঘ কাল-পরিক্রমায়
বাঙালির খাদ্য তালিকায় সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বানর, কাক, শকুন, সাপ,
কুমির ইত্যাদি বাদ পড়ে গেছে। কাঁকড়া, কাছিমও সকল বাঙালির খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়
না। বৌদ্ধধর্মানুসনে জীব হত্যা পাপ। এরই সূত্রে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ছিল নিরামিষ
ভোজী। এই শ্রেণিতে হিন্দুদের একাংশ ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ হিন্দুরা মুরগী, হাঁস,
ছাগল, মাছ আহার করে থাকে। যদিও বৈদিকযুগে গরুর মাংস নিষিদ্ধ ছিল না। মনুর সিদ্ধান্ত
অনুসারে হিন্দুদের ভিতরে গোমাংশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে শুকর
নিষিদ্ধ। ‘তৃণভোজী জাবরকাটা এবং খুর দ্বিবিভক্ত’ এই জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণির মাংস
মুসলমানদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। এর ভিতরে রয়েছে গরু, ছাগল, হরিণ, মহিষ ইত্যাদি।
বঙ্গদেশে ঘোড়া খাওয়ার চল নেই। যদিও বৈদিকযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষে অশ্ব-মাংশের
অংশবিশেষ খাওয়ার রীতি ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে বর্তমানে কোনো ধর্মের লোকই অশ্বমাংস
খায় না। বিবাহ বা জাঁককমকপূর্ণ ভোজানুষ্ঠানে বাঙালির খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে
পারস্য, আফগানী খাবার। পোলাও, কোরমা, নানা জাতের কাবাব এর সাথে যুক্ত হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত বাঙালির প্রধান শর্করা জাতীয় খাবারের উৎস ছিল ভাত। সখের
খাবার হিসেবে লুচি পরোটা ছিল। পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশে রুটি খাওয়ার চল সাধারণ
বাঙালির ঘরে ঢুকে পড়ে। গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারে এখনও সকালের গরমভাত বা পান্তা ভাত
খাওয়ার চল আছে, কিন্তু নগরকেন্দ্রিক বাঙালি সমাজে গমজাত রুটি, পরোটার চল্ আছে।
বাঙালির মুখোরোচক খাবারের তালিকায় রয়েছে মিষ্টিজাতীয় খাবার। এই তালিকায় রয়েছে নানা
ধরনের ফিরনি ও পায়েস। এসব খাবারের সাথে জড়িত রয়েছে বাঙালির নবান্ন, অন্নপ্রাসনের
মতো ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের পিঠা। কুলি (পুলি), চিতই পিঠা, তেলে
ভাজা, দুধ কুলি, দুধ চিতই, নকশি, পাকন, পাটি সাপ্টা ভাপা, বুলবুল, ভাজা কুলি,
মালপোয়া, সেমাই পিঠা ইত্যাদি।
ময়রার তৈরি নানা রকমের মিষ্টির জন্য বঙ্গদেশ বিখ্যাত। এই জাতীয় মিষ্টির তালিকায়
রয়েছে কালোজাম, চমচম, প্রাণহরা, মণ্ডা, রসগোল্লা, রসমালাই, রাজভোগ, সন্দেশ ইত্যাদি।
এসব মিষ্টি জাতীয় খাবারের পাশাপাশি রয়েছে ধান বা কাউন থেকে তৈরি খই, মুড়ি, মুড়কি,
মোয়া। নারকেলর নাড়ু, তিলের নাড়ু।
বাঙালির ঐতিহ্যগত খাদ্য
প্রাত্যহিক খাবার
মুখোরোচক বা নাস্তা
মিষ্টি