মুসলিম সাহিত্য সমাজ
ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি সাহিত্য-সংগঠন।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল ইউনিয়ন কক্ষে মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই সংগঠনের অন্যান্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন- কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হোসেন প্রমুখ। এছাড়া বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দ।

ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংগঠনের দ্বিতীয় দ্বিতীয় বর্ষের কার্য বিবরণীতে
কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছিলেন- 

“আমরা চাই সমাজের চিন্তাধারাকে কুটিল ও পঙ্কিল পথ হইতে ফিরাইয়া প্রেম ও সৌন্দর্য্যের সহজ সত্য পথে চালিত করিয়া আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে। এক কথা আমরা বুদ্ধিকে মুক্ত রাখিয়া প্রশান্ত জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা বস্তু জগত ও ভাবজগতের ব্যাপারাদি প্রত্যক্ষ করিতে ও করাইতে চাই।”

... মুসলিম সাহিত্য সমাজের লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও ধর্ম প্রভাবিত মুসলমান সমাজকে বৈজ্ঞানিক যুক্তির পাটাতনের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে। মুসলিম সাহিত্য সমাজ করণীয় সম্পর্কে পাওয়া যায় : “মুসলিম সমাজে অনেক গলদ ঢুকিয়াছে। মিথ্যা হাদিস দ্বারা ঐ সবের সমর্থন চলিতেছে; অনেক সময় লোকেরা নিজেদের মতলব হাসিল করার জন্য হাদিস সৃষ্টি করিয়াছে; যে সমস্ত হাদিস বুদ্ধির দ্বারা সমর্থিত নহে তাহা মানিতে হইবে না; কুরআনের ব্যাখ্যা যাহা হইয়া গিয়াছে তাহা ব্যতীত আর হইতে পারিবে না, ইহা ঠিক নহে; কাল ও অবস্থা ভেদে ইহার নতুন ব্যাখ্যা দিতে হইবে।”

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারিতে। উল্লেখ্য, এই সভায় যোগদানের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন  বিকেলের দিকে। সম্মেলনের প্রথম দিনে কাজী আব্দুল ওয়াদুদ  প্রবন্ধ পাঠের পর, নজরুল পরিবেশন করেছিলেন- 'খোশ্ আমদেদ' শিরোনামের গানটি। এরপর তিনি প্রধান অতিথির ভাষণ দেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি (সোমবার, ১৬ ফাল্গুন ১৩৩৩) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অধিবেশনের শুরু হয়েছিল, নজরুলের গজল গানের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি আবৃত্তি করে শোনান 'খালেদ' কবিতা। এই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন স্যার এ এফ রহমান আর সভাপতিত্ব করেছিলেন মৌঃ তসদ্দুক আহমদ।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের মুখপত্র প্রকাশিত হয়েছিল 'শিখা' শিরনামে। এর পরিশিষ্ট অংশে এই সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ মুদ্রিত হয়েছিল।

১৯২৯খ্রিষ্টাব্দের মুসলিম সাহিত্য সমাজের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে
সমাজ সংস্কারের জন্য পাঁচ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। এই প্রস্তাবগুলো ছিল-

১. এই সভা বাংলার মুসলমান নর-নারীকে বিশেষভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বাংগালীকে কোরানের সহিত পরিচিত হইবার অনুরোধ জানাইতেছে।
২.
এই সভা বাংলার পল্লীর বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠাগার ও গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে উদ্যোগী হইবার জন্য দেশের কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানাইতেছে।
৩.
এই সভা বাংলার বিভিন্ন মক্তব ও মাদ্রাসায় যাহাতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যায়াম শিক্ষার ব্যবস্থা হয় তজ্জন্য গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানাইতেছে।
৪.
এই সভা বাংগালী মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দকে পর্দাপ্রথা দূরীকরণার্থে আদর্শ স্থাপন করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।
৫.
এই সভা সাহিত্য সমাজের কর্মীবৃন্দকে মুসলিম ইতিহাস , দর্শন ও ধর্মবিষয়ক আরবী ও ফার্সি গ্রন্থ সমূহ অনুবাদ করিবার জন্য একটি অনুবাদ কমিটি গঠন করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই সংগঠনটি সক্রিয় ছিল।