মানচিত্র : বাংলাপেডিয়া। |
শাহজাদপুর
বাংলাদেশের
সিরাজগঞ্জ
জেলার একটি উপজেলা।
বর্তমানে শাহজাদপুর উপজেলার উত্তরে রয়েছে উল্লাপাড়া উপজেলা ও বেলকুচি উপজেলা,
দক্ষিণে
পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা,
পূর্বে চৌহালী উপজেলা এবং পশ্চিমে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলা। শাহজাদপুর উপজেলা
সদরের পশ্চিমে পঞ্চগড়-নগরবাড়ি বিশ্বসড়ক এবং পূর্বে প্রবাহিত হচ্ছে করতোয়া নদী। এর
পূর্ব প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের যমুনা নদী। অবশ্য যমুনার ওপারেও (পূর্বে) এ
উপজেলার কিছু অংশ রয়েছে।
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাদপুরকে থানা করা হয়।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাদপুরকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।
এ উপজেলার প্রধান নদীগুলো হলো যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুরা সাগর। এতগুলো নদী থাকার
কারণে, একসময় শাহজাদপুরের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম
ছিল নৌপথ। বর্তমানে এই উপজেলার সাথে প্রথান যোগাযোগ মাধ্যম হলো সড়ক পথ।
কথিত আছে যে, ইয়ামেনের শাহজাদা মখদুম শাহ দৌলা (রহঃ) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে, ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতে আসেন। বঙ্গদেশে আসার পর, তিনি তাঁর তিন ভাগ্নে এবং কিছু সহচর নিয়ে নদীপথে রওনা দেন। যাত্রাপথে তিনি তাঁর সহচরদের বর্তমান শাহজাদপুর এলাকায় এসে পৌঁছেন। এই জায়গাটি পছন্দ হওয়ায়, তিনি এখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এরপর স্থানীয় হিন্দু রাজার সাথে তাঁর সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই স্থানটি মুসলমান প্রজারা নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হলেও, স্বয়ং শাহাজাদা যুদ্ধে শহিদ হন। এই শাহাজাদার নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করা হয় 'শাহজাদপুর'।
শাহজাদপুরের মখদুমিয়া জামে মসজিদ বা 'দরগাহ মসজিদ' |
হযরত মখদুম শাহদৌলার মৃত্যুর পর তাঁর সহচরগণ শাহজাদপুর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটিকে নিয়ে নানা রকম কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এটি বর্তমানে এই মসজিদটি দরগা পাড়া মখদুমিয়া জামে মসজিদ বা 'দরগাহ মসজিদ' নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এই মসজিদটি সংস্কার করা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। বর্তমানে এই মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৯.১৩ মিটার এবং প্রস্থ ১২.৬০ মিটার। মসজিদটিতে রয়েছে ১৫ টি গম্বুজ এবং প্রত্যেক সারিতে রয়েছে ৫টি করে গম্বুজ। এখানে আরবি হরফে উৎকীর্ণ শিলালিপি এবং ফুল লতাপাতার নকশা রয়েছে। এই মসজিদের পাশেই হযরত মখদুম শাহদৌলার মাজার এবং অন্যান্য শহিদের কবর আছে। এটি এ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্বের স্থান বলে বিবেচিত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই এই মসজিদ ও মাজারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ধর্মীয় কারণেই ব্রিটিশ শাসনমাল পর্যন্ত শাহাজাদপুর-এর বিশেষ পরিচিতি ছিল।
১৮৭৩-১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্লবী ঈশানচন্দ্র নিজগ্রাম দৌলতপুর থেকে সিরাজগঞ্জের কৃষক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনের নাম ছিল— বিপ্লব পলো।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি |
ব্রিটিশ শাসনামলে এই উপজেলায় একটি মুনসেফ
কোর্ট এবং একটি জেলখানা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানে নীলকরদের একটি নীলকুঠি
স্থাপিত হয়েছিল। পরে
রবীন্দ্রনাথ দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি নিলামে ১৩
টাকা ১০ আনায় কিনে নেন। পরে এই কুঠিবাড়িতে জমিদারী খাজনা আদায়ের কাচারি হিসেবে
ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর আমল থেকেই এই কাচারি কুঠিবাড়ি নামেই
প্রচলিত ছিল। এখনও একে কুঠিবাড়ি নামেই ডাকা হয়। বর্তমানে এখানে নির্মিত আধুনিক
অডিটোরিয়াম। দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং
আঙিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুন্দর সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান।
রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য
প্রথম শাহজাদপুরে আসেন। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ মোট ৭ বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুর
আসা-যাওয়া এবং অবস্থান করেছেন। এই সময়ের মধ্যে এখানে তিনি তাঁর অনেক অসাধারণ কালজয়ী
সাহিত্য রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘‘সোনার তরী’’ কাব্যের ‘ভরা ভাদরে’, ‘দুইপাখি’,
‘আকাশের চাঁদ’, ‘হৃদয় যমুনা’, ‘প্রত্যাখান’, ‘বৈষ্ণব কবিতা’, ‘পুরস্কার’ ইত্যাদি
কবিতা এবং ‘‘কল্পনা’’ কাব্যের ’যাচনা’, ‘বিদায়’, ‘নববিরহ’ ,‘মানস-প্রতিমা’,
‘লজ্জিতা’, ‘সংকোচ’, ইত্যাদি বিখ্যাত গান রচনা করেছেন। শাহজাদপুরে রচিত তাঁর
ছোটগল্পের মধ্যে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘সমাপ্তি’,‘অতিথি’, ইত্যাদি বিখ্যাত। আর
প্রবন্ধের মধ্যে ‘ছেলে ভুলনো ছড়া’, ‘পঞ্চভূত’, এর অংশবিশেষ এবং ‘ছিন্নপত্র’ ও
ছিন্নপত্রাবলীর আটত্রিশটি পত্র রচনা করেছেন। ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ভাগাভাগির ফলে
শাহজাদপুর জমিদারি চলে যায় রবীন্দ্রনাথের অন্য শরিকদের হাতে। তাই ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি শেষবারের মতো শাহজাদপুরে এসেছিলেন।
শাহজাদপুরের তাঁতশিল্প ও দুগ্ধশিল্পের জন্য বিখ্যাতে। এখানকার তাঁতশিল্পে উৎপাদিত
পণ্যের মধ্যে শাড়ি ও লুঙ্গির দেশে ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এখানকার দ্বিতীয় প্রধান
শিল্প হচ্ছে দু্গ্ধশিল্প। বাংলাদেশের বৃহৎতম দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান
মিল্কভিটা সবচেয়ে বড় কারখানাটি শাহজাদপুরে অবস্থিত। এই কারখানায় দুগ্ধ
প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াও দুগ্ধজাত ঘি, মাখন, আইসক্রিমসহ নানা পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে।
মিল্টভিটার প্রায় শতকরা আশি ভাগ দুধ শাহজাদপুরে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের দুগ্ধ
খামার থেকে সরবরাহ করা হয়।
শাহজাদপুর উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো বাঘাবাড়িতে স্থাপিত দুটি বিদ্যুৎ
উৎপাদন কেন্দ্র। ৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ওয়েস্ট মোন্ট পাওয়ার প্লান্ট
(১০০ মেগাওয়াট )। এ দুটিই বাঘাবাড়ি বড়াল নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত। এ দুটি প্লান্ট
থেকে গড়ে ১৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে। আরও ১০০ মেঘাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন
গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। শাহজাদপুর
উপজেলার যে সব কারণে গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে প্রতিষ্ঠিত
পেট্রোলিয়াম ডিপো অন্যতম। এই ডিপোতে রয়েছে পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম
কোম্পানির সরবরাহ। উত্তরবঙ্গের জ্বালানী তেলের প্রায় সমস্তটাই এখান থেকে সরবরাহ করা
হয়। মোটের উপর, শিল্প কারখানার দিক থেকেও উপজেলা হিসাবে শাহজাদপুর বেশ অগ্রবর্তী।
শাহজাদপুর উপজেলার সংক্ষিপ্ত তথ্যাবলী |
|
আয়তন |
৩২৮ বর্গ কিঃমিঃ |
মোট থানার সংখ্যা |
০২টি |
মোট ইউনিয়নের সংখ্যা |
১৩ট |
মোট পৌরসভার সংখ্যা |
০১টি |
মোট মৌজার সংখ্যা |
২১৬টি |
মোট জমির পরিমাণ |
৩০,৮৫৫ হেক্টর |
মোট জনসংখ্যা (২০০১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী |
৪৭২৫০৫জন (পুরুষ-২৪৭০১৯ জন, মহিলা ২২৫৪৮৬ জন ) |
মোট গ্রামের সংখ্যা |
৩৪৩টি |
জনসংখ্যার ঘনত্ব |
১৪৮১.৩৫ (প্রতি বর্গ কিঃমিঃ ) |
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় |
১৫২টি |
রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় |
৬৫টি |
কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের |
০২টি |
কেজি স্কুল |
১৪টি |
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার |
৯৬.৩৫% |
মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা |
স্নাতক -৮,উচ্চ মাধ্যমিক-৯,বিজনেস ম্যানেজমেন্ট-৩টি |
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা |
৩২টি |
নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় |
০৪টি |
কারিগরী বিদ্যালয় |
০৪টি |
মাধ্যমিক স্কুল এন্ড কলেজ |
০২টি |
টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ |
০২টি |
টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনসটিটিইটঃ |
০১টি |
মাদ্রাসা |
১৯টি ( দাখিল-১২,আলীম-০৪,ফাজিল-০৩ ) |
এবতেদায়ী মাদ্রাসা |
৪০টি |
ফোরকানিয়া মাদ্রাসা |
১১৮টি |
মোট হাট-বাজারের সংখ্যা |
২৩টি (পৌরসভাসহ ) |
মসজিদের সংখ্যা |
৫৬৮টি |
মন্দির |
৪৮টি |
পাবলিক লাইব্রেরী |
০১টি |
টেলিফোন এক্সচেঞ্জ |
০১টি |
রেষ্ট হাউজ |
০৯টি (ডাকবাংলোসহ ) |
ব্যাংক |
১০টি |
হাসপাতাল |
০১টি |
উপ-স্বাসহ্যকেন্দ্র |
০৭টি |
ইউনিয়ন ভূমি অফিস |
১৩টি |
ডাকঘর |
৩৩টি |
খাদ্য গুদাম |
০২টি (ধারনক্ষমতা -৩৫০০ মেঃটন ) |
সূত্র :