আদিনাথ মন্দির
 

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত মহেশখালী উপজেলায় অবস্থিত একটি মন্দির। এটি মূলত মহাদেব-এর মন্দির। জনশ্রুতি আছে, কোনো এক কৃষক এই দ্বীপের একটি বনের ভিতর মহেশ (হিন্দু পৌরাণিক দেবতা মহাদেব-এর অপর নাম) -এর মূর্তি পান। এরপর এই দেবতার নামে একটি মন্দির তৈরি করে, সেখানে ওই বিগ্রহটি স্থাপন করেন। পরে এই দেবতার নামের সাথে খালী (খাল অর্থে) শব্দ যুক্ত হয়ে এই স্থানটি মহেশখালী নামে পরিচিত লাভ করে। উল্লেখ্য এই মন্দিরটি বর্তমানে আদিনাথ মন্দির হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। মন্দিরটি স্থানীয় মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৮৫.৩ মিটার। দ্বীপের ভূমি থেকে এই মন্দিরে উঠার জন্য রয়েছে ৬৯টি সিঁড়ি। এই মন্দিরের ভেতরে রয়েছে অষ্টভুজা দুর্গা মন্দির।

 

মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ১০.৫০ মিটার, প্রস্থ ৯.৭৫ মিটার এবং উচ্চতা ৬ মিটার। মন্দিরের সম্মুখের প্রবেশপথটি ধনুকাকৃতির। এর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আরও দুটি প্রবেশ পথ ছিল। বর্তমানে তা ইঁটের দে্‌ওয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে পূর্ব-পশ্চিম দেওয়ালে দুটি জানালা আছে। আর দক্ষিণ দেওয়ালে কুলুঙ্গি আছে। পূর্ব-পশ্চিমের কক্ষের উপরে গম্বুজ আছে। গম্বুজের উপরে রয়েছে ফুটন্ত পদ্ম, কলসচূড়া ও চক্র। এর অষ্টভূজাকৃতির স্তম্ভে রয়েছে কলস, লতাপাতার নকশা।
 

এর অভ্যন্তরীণ দেওয়াল ১.০৫ মিটার এবং বহির্দেয়াল ০.৬০ মিটার। মন্দিরটির ভিতরে অংশ তিনটি কক্ষে বিভক্ত। এর উত্তরের কক্ষটি প্রাচীন। অপর দুটি কক্ষ (পূর্ব ও পশ্চিম) পরে তৈরি করা হয়েছে। এর উত্তরের অংশের প্রথমভাগে আছে ২টি বর্গাকৃতির পূজা কক্ষ। এর আয়তন ৩.৩৫ বর্গমিটার। পূর্বকক্ষে আছে  আদিনাথ বাণলিঙ্গ শিবমূর্তি। আর পশ্চিম কক্ষে আছে অষ্টভূজা দুর্গামূর্তি।

 

লোককাহিনী অনুসারে মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ে মহাদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন ত্রেতাযুগে। রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় মহাদেবের আশীর্বাদ লাভের জন্য রাক্ষসরাজ রাবণ কৈলাশে যান। দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব রাবণকে শর্ত দেন যে, রাবণ যদি তাঁকে বিরতিহীনভাবে তাঁকে নিয়ে যেতে পারে, তবেই তিনি লঙ্কায় যাবেন। এই শর্ত মেনে মহাদেবকে মাথায় নিয়ে রাবণ লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে রাবণ মৈনাক পাহাড়ে অবতরণ করতে বাধ্য হয়। শর্তভঙ্গ হওয়ায় শিব মৈনাক পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। অন্য লোককাহিনী মতে জনৈক নাগা সন্ন্যাসীর সহায়তায় নেপাল থেকে পাথরের অষ্টভূজা দুর্গামূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলে কোনো এক মহাদেবের উপাসক। সমুদ্রের মধ্যে মৈনাক পর্বতের অবস্থান বলে রামায়ণেও উল্লেখ আছে। অনেকে মনে করেন এই মৈনাক পর্বতটিই হলো মহেশখালী দ্বীপের মৈনাক পাহাড়।


মহেশখালীর ইতিহাসের সাথে 'নাথ' সম্প্রদায়ের যোগ আছে বলে অনেকে মনে করেন। উল্লেখ্য নাথ সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু মীন নাথের শিষ্য, গোরক্ষ নাথ-এর আবির্ভাব কাল হিসাবে একাদশ শতাব্দী বিবেচনা করা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থ গোরক্ষ বিজয প্রকাশিত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। নাথ সম্প্রদায়ের চারজন সিদ্ধগুরু মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা এবং কাহ্নপার প্রভাব বাংলাদেশের অনেকস্থানে ছাড়িয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, নাথ সম্প্রদায়ের কোনো শিষ্য মহেশখালীতে এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, বগুড়া অঞ্চলে গোরক্ষনাথের শিব মন্দিরে মতো, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য মন্দিরের অনতিদুর একটি বাজারের নাম গোরকঘাটা বাজার। এই নামের সাথে 'গোরক্ষ' নামের মিল পাওয়া যায়। আদিনাথ মন্দিরের লোক কাহিনীতে নেপাল রাজা, নুর মোহাম্মদ সিকদারের উল্লেখ আছে। গোরক্ষ বিজয়েও কবীন্দ্র দাস, শ্যামদাস, ভীমদাসসহ ফয়জুল্লাহ, সুকুর মুহাম্মদ প্রভৃতি মুসলমানের নামও পাওয়া যায়।


বর্তমানে এই মন্দির কমপ্লেক্সে আছে একটি মসজিদ ও একটি রাখাইন বৌদ্ধ বিহার। তাই অনেকে মন্দিরটিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক মনে করেন। প্রতিবছর শিব চতুর্দশী উপলক্ষে হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এ মন্দিরে। এ উপলক্ষে ১০/১৫ দিন মেলা বসে।

 


তথ্য সূত্রঃ
http://www.banglapedia.org/HTB/104075.htm

http://www.tour-in-bd.com/moheshkhali.html