বঙ্গবন্ধু ভূ-উপগ্রহ
বাংলাদেশের
নিজস্ব কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ। এই ভূ-উপগ্রহ সিরিজের প্রথমটির নাম দেওয়া
হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১
(BANGABONDHU-1)।
এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের
বাংলাদেশ সময় ১২ মে ভোর
০২:১৪টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এর
আয়ুষ্কাল প্রায় ১৫ বছর। কক্ষপথে চূড়ান্তরূপে অবস্থান নেয়ার পর ৩৬ হাজার কিলোমিটার
ওপর দিয়ে
এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটি
পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবীকে
কেন্দ্র করে এর আবর্তন কাল হবে ২৪
ঘণ্টায় একবার। ফলে পৃথিবী হতে স্যাটেলাইটটিকে স্থির মনে হয়ে থাকে।
পরিকল্পনা অনুসারে এই
কৃত্রিম
ভূ-উপগ্রহটি ১৯৯.১° ডিগ্রী পূর্ব
দ্রাঘিমায় ভূস্থির স্লটে স্থাপন করা হয়।
এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের জন্য
স্পেসএক্স-এর সর্বাধুনিক রকেট
ফ্যালকন-৯ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে রয়েছে ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন
মোট ৪০টি কে এবং সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার। এর ভিতরে ২৬টি কে-ইউ ব্যান্ড এবং ১৪টি
সি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ধার্য করা হয়েছে। কে-ইউ ব্যান্ডের আওতায় রয়েছে
বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরে তার জলসীমাসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও
ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল। সি ব্যান্ডেরও আওতায় রয়েছে এই সমুদয় অঞ্চল।
এর বাইরের অংশে রয়েছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রঙের নকশা এবং ওই নকশার ওপর
ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও এর
সাথে যুক্ত রয়েছে।
গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের তেলিপাড়ার কৃ্ত্রিম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র |
এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহটি বাংলাদেশের গাজীপুর
জেলার জয়দেবপুর ও
রাঙ্গামাটি
জেলার
কাউখালি
উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নে স্থাপিত
বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র
থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই দুটি কেন্দ্রের মধ্যে জয়দেবপুরের তেলিপাড়ায় ৫ একর জমির
উপর নির্মিত ভূ-কেন্দ্রটি হলো মূল স্টেশন । আর বেতবুনিয়ায় স্টেশনটি দ্বিতীয়
মাধ্যম হিসেবে রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ১ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ প্রাপ্ত সুবিধা
কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের ইতিহাস
বাংলাদেশ নিজস্ব
কৃত্রিম
ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ
ও অন্যান্য সুবিধাদি পাওয়ার জন্য একটি ভূ-উপগ্রহ স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ
পর্যালোচনার পর, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা 'বিটিআরসি' ভূ-উপগ্রহ
উৎক্ষেপণের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়
তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় ভূ-উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। এরপর
বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন
ইউনিটের (আইটিইউ) কাছে বাংলাদেশ একটি ইলেক্ট্রনিক আবেদন করে। এই সূত্রে কৃত্রিম
উপগ্রহ ব্যবস্থার নকশা তৈরির জন্য ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকল্পের মূল
পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস পার্টনারশিপ
ইন্টারন্যাশনাল’ কে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সাথে স্যাটেলাইট সিস্টেম কেনার জন্য
ফ্রান্সের 'কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস'-এর সাথে বিআরটিসি এক হাজার ৯৫১
কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে।
এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক), ২০১৪
খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ৯৬৮ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ করে। এই অর্থের ভিতরে
বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ (মোট অর্থের ৪৪% ) বরাদ্দ দেওয়া
হয়। এ ছাড়া ‘বিডার্স ফাইন্যান্সিং’ এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি
৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে
অরবিটাল স্লট অনুমোদন দেওয়া হয়। এর অর্থমূল্য ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হংক সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সাথে সরকারের
প্রায় একহাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়। এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে
২০ কিস্তিতে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্রিম উপগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার প্রাথমিক মূলধন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে এই কৃ্ত্রিম ভূ-উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পর, এটি ২১ মে নিজ কক্ষপথে পৌঁছে যায়। ২২ মে থেকে এটি আংশিক সংকেত পাঠানো শুরু করে। গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ওই সংকেতটি পাওয়া যায়।