ব্রাজিলের পতাকা |
ব্রাজিল
ইংরেজি Brazil।
সরকারি নাম:
পোর্তুগিজ: República
Federativa do Brasil
।
দক্ষিণ আমেরিকা
মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
এর রাজধানীর নাম
ব্রাসিলিয়া।
ব্রাজিল নামটির উৎপত্তি নিয়ে
বিতর্ক আছে। ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে-
১৬ শতকে ব্রাজিল থেকে এক প্রকার
কাঠ উৎপাদনকারী গাছ
'ব্রাজিলউড' রফতানি হ্ওয়া শুরু
হয়। পর্তুগিজ ভাষায় ব্রাজিলউডকে 'পাউ-ব্রাজিউ
(pau-brasil)
বলা হয়। এই 'ব্রাজিউ' শব্দটির উৎস 'জ্বলন্ত
কয়লার মতো লাল' শব্দগুচ্ছ থেকে। উল্লেখ্য লাতিন ভাষায় 'ব্রাজা'
(brasa)
শব্দের অর্থ কয়লা। এর শেষের -il
উপসর্গটি লাতিন -iculum বা -ilium থেকে এসেছে। এ সকল শব্দের সংমিশ্রণে পর্তুগিজ
'ব্রাজিউ' শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। ইংরেজিতে দেশটির নাম ব্রাজিল।
ভৌগোলিক অবস্থান:
১৫°৪৭′
দক্ষিণ
৪৭°৫২′
পশ্চিম।
এর উত্তর দিকে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ও ফ্রান্সের সামুদ্রিক
দেপার্ত্যমঁ ফরাসি গায়ানা; উত্তর-পশ্চিমভাগে
কলম্বিয়া; পশ্চিমে বলিভিয়া ও
পেরু;
দক্ষিণ-পশ্চিমে
আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে, এবং সর্ব-দক্ষিণে দক্ষিণে
উরুগুয়ে।
এছাড়া ব্রাজিলের পূর্বাংশ জুড়ে রয়েছে আটলান্টিক মহাদেশ। এই মহাসাগরের
বেশকিছু দ্বীপপুঞ্জ ব্রাজিলের অন্তর্গত। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য দ্বীপগুলো
হলো-ফের্নান্দু জি নরোনিঁয়া, রোকাস অ্যাটল, সেন্ট পিটার ও সেন্ট পল রকস, এবং
ত্রিনিদাজি এ মার্চিঁ ভাজ।
আয়তন: আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ আমেরিকা বৃহত্তম এবং বিশ্বের পঞ্চম
বৃহত্তম রাষ্ট্র। মোট আয়তন ৮,৫১৪,৮৭৭ বর্গকিলোমিটার (৫,২৯০,৮৯৯ বর্গমাইল)।
জনসংখ্যা: ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের অনুমানিক হিসাব ২০,২৬,৫৬,৭৮৮ ।
ভাষা: পোর্তুগিজ।
ধর্ম: রোমান ক্যাথলিক প্রধান ধর্ম।
মুদ্রা: ব্রাজিলিয়ান রিয়াল।
ব্রাজিলের ইতিহাস
আদি মানবগোষ্ঠীর অভিযাত্রার সূত্রে ব্রাজিলে মনুষ্যজাতি বসতি স্থাপন
করেছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। এরাই নানা জাতিগোষ্ঠীতে বিভাজিত হয়ে ব্রাজিলের বিভিন্ন
অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রাজিলের আদিম নরগোষ্ঠী হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় মারাজো
দ্বীপপুঞ্জের অদিবাসীদের। এদের সংস্কৃতিকে মারাজোয়া সংস্কৃতি নামে অভিহিত করা হয়।
১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল, পর্তুগিজ অভিযাত্রী পেদ্রু আলভারেজ কাবরাউয়ের
একটি নৌবহর নিয়ে বর্তমান ব্রাজিলে এসে পৌঁছান। তিনি পোর্তুগালের রাজা প্রথম মানুয়েলের অধীনস্থ এলাকা হিসেবে
ব্রাজিলের অংশবিশেষে বসতি স্থাপনে মনোযোগ দেন। এই সময় এই অঞ্চলে বসবাস করতো
'তুপি-গুয়ারানি' ভাষাগোষ্ঠীর নানা গোত্রের আদিবাসী। এই সময়ে এই আদিবাসীদের মধ্যে
যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। এই সুযোগে পোর্তুগিজরা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং
১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাজিলে পোর্তুগিজ উপনিবেশ সৃষ্টি হয়।
১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ডম তৃতীয় জোয়াউঁ পোর্তুগিজদের অধিকৃত সমগ্র অঞ্চলকে ১২টি পৃথক
ভাগ করে এবং ১২টি জমিদারি শাসন চালু করে। এই সব জমিদারদের স্বেচ্ছাচারিতায় উপনিবেশে
বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তাই ১৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজা পুরো উপনিবেশ
নিয়ন্ত্রয়ণের জন্য একজন গভর্নর-জেনারেল নিয়োগ দেন।
পর্তুগিজরা কিছু আদিবাসী গোত্রকে নিজেদের
বশ্যতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বেশ কিছু আদিবাসীকে বশ্যতায় আনতে সক্ষম হলে, একটি
বিরাট সংখ্যক আদিবাসী পোর্তুগিজদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই সময় দীর্ঘ যুদ্ধ ও
রোগের কারণে কিছু কিছু আদিবাসী বিলুপ্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য এই অঞ্চলে গুটি বসন্ত
জাতীয় রোগ ছিল না। ইউরোপীয়দের মাধ্যমে এই রোগ আদিবাসীদের মধ্যে সংক্রামিত হয়। এ সকল
রোগের চিকিৎসা আদিবাসীরা জানতো না। ফলে ব্যাপকিভাবে এ সকল রোগের কারণে আদিবাসীদের
মৃত্যু ঘটে।
ভূমির অধিকার নিয়ে ফরাসিদের সাথে
পোর্তুগিজদের সংঘাতের সৃষ্টি হয়। উভয় উপনেবিশিক শক্তির ভিতরে যুদ্ধ শুরু হলে
পর্তুগিজরা ফরাসিদের ভূমি দখল করে নিতে থাকে।
১৬শ শতকের মধ্যভাগে পোর্তুগিজরা
ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব উপকূলের ভালো মাটি ও ক্রান্তীয় জলবায়ুর সুযোগ নিয়ে সেখানে
চিনির তৈরির কারখানা স্থাপন করে। এর ফলে ব্রাজিল একটি শক্তশালী অর্থনৈতিক সুবিধায়
পৌঁছে যায়। সে সময়ে ব্রাজিলের চিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু
ব্যাপকভাবে চিনি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জনসংখ্যা ছিল না। তাই পোর্তুগিজরা আফ্রিকা
থেকে কালো মানুষ নিয়ে আসে দাস হিসেবে।
১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা তাদের উপনিবেশের
দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত রিউ দি
জানেইরু ও ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত
সাউঁ লুইসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা আমাজন
অরণ্য অভিমুখে অভিযান শুরু করে। এই সময় ঐ অঞ্চলে অবস্থিত ব্রিটিশ ও ওলন্দাজ
উপনিবেশগুলোর দখল করে নেয়।
১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এরা দক্ষিণ দিকে রাজ্য সম্প্রসারিত করে।
১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বভাগের মাতু গ্রেসো এবং গোইয়াস
অঞ্চলে স্বর্ণখনি আবিষ্কার করে। ব্রাজিলের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত উন্নতি ঘটে।
১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা
নেপোলিয়নের পর্তুগাল আক্রমণ করে। এই সময় পোর্তুগিজ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র
লিসবন থেকে ব্রাজিলের রিও দি জানেইরুতে সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা ফরাসি
গায়ানা দখল করে। অবশ্য ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে তা ফ্রান্সের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
ইতিমধ্যে ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিল যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, ও আলগ্রেভিজের সাথে
একত্রিত হয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে চলে যায়।
১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের নতুন রাষ্ট্রের যুদ্ধাভিযানে ইস্টার্ন স্ট্রিপ
দখল করে। এই সময় দক্ষিণ দিকের একটি বিরাট অংশ দখল করে নেয়।
১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল পোর্তুগালের রাজা ষষ্ঠ জোয়াউঁ ইউরোপে ফিরে যান। এই
সময় তাঁর তাঁর বড় ছেলে পেদ্রু জি কান্তারাকে ব্রাজিলের রিজেন্ট হিসেবে রেখে যাব।
পর্তুগিজ সরকার ব্রাজিলকে পুনরায় পর্তুগিজ উপনিবেশে পরিণত করতে চেষ্টা করেন।
কিন্তু ব্রাজিলের অধিবাসীরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করা শুরু করে। রিজেন্ট
পেদ্রু জি কান্তারা পর্তুগালে ব্রাজিলীয়দের দাবির পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে
১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ৭ই নভেম্বর পেদ্রু আনুষ্ঠানিকভাবে পর্তুগালের কাছে থেকে
ব্রাজিলের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই বছরের ১২ই অক্টোবর ডম পেদ্রু ব্রাজিলের প্রথম
সম্রাট হিসাবে স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর সিংহাসনে আরোহণ
করেন।
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিলের প্রথম সংবিধান পাশ হয় এবং ১৫ই মার্চ এই সংবিধান প্রকাশ
করা হয়। এই সময় থেকে দুই কক্ষ বিশিষ্ট
সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ব্রাজিল একটি
যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র। একটি ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট, ২৬টি প্রদেশ, ও ৫,৫৬৪টি
মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে এর যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছে।
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনীয় আর্জেন্টিনা ও পর্তুগিজ ব্রাজিলের মধ্যে একটি বাফার বা
অন্তর্বর্তী রাষ্ট্র (buffer state)
হিসেবে উরুগুয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল প্রথম
পেদ্রু সিংহাসন ছেড়ে দেন ও তাঁর কন্যার রাজত্ব পুনরায় দাবি করার উদ্দেশ্যে
পর্তুগালে পাড়ি জমান। এই সমব তিনি তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে (ডম দ্বিতীয় পেদ্রু)
সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে নির্বাচিত করে যান। এই সময় নাবালক সম্রাটের পক্ষে
রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে রিজেন্সি পদ্ধতি চালু করা হয়। এই সূত্রে সম্রাটের
পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ফলে ব্রাজিলের
অভ্যন্তরে কলহের সূত্রপাত হয়। এই সময় কোনো প্রদেশ স্বাধীন হওয়ার পক্ষে চলে যায়। ফলে
ডম দ্বিতীয় পেদ্রুকে মাত্র
চৌদ্দ বৎসর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করতে হয়।
১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিকভাবে দাস পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে-
ব্রাজিল ধীরে ধীরে দাস প্রথা বিলোপ করার উদ্যোগ নেয়। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাজিলে
সম্পূর্ণরূপে দাস প্রথার বিলোপ হয়ে যায়।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
ব্রাজিলের অধিবাসী
দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য আদিবাসীদের মতো- ব্রাজিলের আদিবাসীরা সাধারণভাবে রেড
ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল অংশ জুড়ে এই রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার
কারণে, এই দেশে রয়েছে নানা জাতের আদিবাসীরা। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজ
উপনিবেশ শুরু হলে- স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে পোর্তুগিজ রক্তের সংমিশ্রণ শুরু হয়। ১৬শ
শতকের দিকে ব্রাজিলে কৃষিকাজের জন্য আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ দাস নিয়ে আসা শুরু হয়।
ফলে নতুন করে মনুষ্য সঙ্কারায়ণ শুরু হয়। ১৯শ শতকের শেষ দিকে ও ২০শ শতকের গোড়ার
দিকে ব্রাজিলে ইতালীয়, জার্মান, স্পেনীয়, আরব, ও জাপানি অভিবাসীরাও বসবাস করা
শুরু করে। ফলে ব্রাজিলে মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি হয়। তবে এ দেশের মূল সাংস্কৃতিক
ধারা পোর্তুগিজ। একই কারণে পোর্তুগিজ ব্রাজিলের প্রধান ভাষা।
ব্রাজিলের খেলাধুলা
ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। এ পর্যন্ত পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়লাভ
করেছে। ফুটবল ছাড়া ভলিবল, বাস্কেটবল, অটো রেসিং ব্রাজিলে বেশ জনপ্রিয়।