সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাবব্দীতে
চোল রাজ্যকে কারিকল সুসংহত অবস্থায় আনতে সক্ষম
হয়েছিলেন। তাঁর সময় পার্শ্ববর্তী পাণ্ড্য ও
চের রাজ্য চোলরাজ্য
আক্রমণ করে। কিন্তু কারিকল সাফল্যের সে আক্রমণ প্রতিরোধ
করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে পাণ্ড্যদের সামরিক ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল।
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত
চোলরা শক্তিশালী
রাজ্য গড়ে তোলার পর,
পাণ্ড্য ও চেরদের পরাজিত করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের অন্যতম
রাজশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সে সময় তামিল ভাষাভাষী
চোলদের দখলে ছিল।
এছাড়া কারিকল ও তাঁর পুত্র চোল রাজ্যকে শক্তিশালী রাজ্যে
পরিণত করলেও তাঁর পৌত্র নেদুমুদুকিল্লার শাসনামলে রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই
সুযোগে জলদস্যুরা ক্রমাগত চোলরাজ্যে হানা দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জলদস্যুরা রাজধানী
কাবেরী পদিনাম আক্রমণ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পাণ্ড্যরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। এদের
ক্রমাগত আক্রমণের মুখে চোল রাজ্যের পতন হয়।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত
পাণ্ড্যরা ছোটো রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল।
এর ভিতরে ৫৬৬-৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাতাপী
চালুক্য
রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা
কীর্তিবর্মণ প্রথম
পাণ্ড্য রাজ্যের অংশবিশেষ দখল করে নেন। এই সময়
ক্ষুদ্র পরিসরে থাকা পাণ্ড্য রাজা কডুঙ্গন, পাণ্ড্য
রাজ্যকে শক্তিশালী করে তোলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি অন্যান্য রাজাদের আক্রমণ প্রতিহত
করে রাজ্য সুসংহত করেন।
৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে পাণ্ড্যবংশের
চতুর্থ রাজা অরিকেশরী মারবর্মণ শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করে চেরদের অধিকৃত কেরালা রাজ্য দখল করে নেন। এরপর
তিনি আশপাশের ছোটো ছোট রাজ্য দখল করে
বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এরা সে সময়ের অপর শক্তিশালী
চালুক্য রাজ্যের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এই সময় চালুক্য রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য (প্রথম)।
এরা উভয়ে মিলে পল্লবরাজ পরমেশ্বরকে পরাজিত করে। এরপর পাণ্ড্যরা আরও শক্তিশালী হয়ে
উঠে। ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে অরিকেশরী মারবর্মণের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন রাজসিংহ
সিংহাসন লাভ করেন। রাজসিংহ একই ভাবে আশপাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজসিংহের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন জটিল পরাস্তক। তিনি
যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিচিনপল্লী, তাঞ্জোর ও কায়েমবাটির অঞ্চল দখল করেন। ৮১২
খ্রিষ্টাব্দে জটিল পরাস্তকের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন শ্রীমার শ্রীবল্লভ। এই
সময় চোল রাজা বিজয়ালয় শক্তিশালী সেনাবহিনী তৈরি করেন এবং
৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে পাণ্ড্যদের কাছ থেকে তাঞ্জোর দখল করেন।
চোলরা এই সময় তাঞ্জোরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিল।
শ্রীমার শ্রীবল্লভ চোলদের ঠেকাতে না পারলেও, শক্তিশালী নৌবাহিনীর সহায়তা সিংহল
আক্রমণ করে এর কিছু অংশ দখল করতে সক্ষম হন। এই সময় তাঁর জ্যেষ্ঠ্ পুত্র বড়গুণবর্ধন
বিদ্রোহ করেন। ৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে পিতাপুত্রে দ্বন্দ্বে সুযোগ নিয়ে পল্লবরাজ
পাণ্ড্যরাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাণ্ড্যরাজ শ্রীমার শ্রীবল্লভ পরাজিত ও
নিহত হন। এই সূত্রে পাণ্ড্য রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল চোল ও পল্লবদের অধীনে চলে
যায়।
৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে
৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ) বিজয়ালয়ের
পুত্র আদিত্য (প্রথম) চোল-সিংহাসন লাভ করেন।
আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তিনি পল্লবরাজ্যের সাথে
যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এই যুদ্ধকে বলা হয় শ্রীপুরাবিয়ামের
যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আদিত্য পল্লবরাজাকে সহায়তা করেন। এই যুদ্ধে পল্লবরাজ জয়ী
হলে, চোলরাজা আদিত্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। পরে সুযোগ
বুঝে পল্লবরাজ্য আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে পল্লবরাজ 'অপরাজিত' পরাজিত ও নিহত হন। এরপর
আদিত্য পল্লবরাজ্য অধিকার করে সার্বভৌম রাজ্য স্থাপন করেন। এরপর তিনি কঙ্গু প্রদেশ
ও পশ্চিম গঙ্গ জয় করেন। শেষপর্যন্ত তিনি, মাদ্রাজ থেকে কাবেরী উপত্যাকা পর্যন্ত
রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হন। এরপ ফলে পল্লবদের অধিকৃত পাণ্ড্য
রাজের অংশ বিশেষ চোলদের অধীনে চলে যায়।
৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পাণ্ড্য রাজা রাজসিংহ কিছুটা
শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিত্য
(প্রথম) এর পুত্র পরাক্রান্ত (প্রথম) সিংহাসন লাভ করার পর,
তিনি প্রথমে পাণ্ড্য রাজা রাজসিংহকে পরাস্ত করে পাণ্ড্য রাজ্য দখল করেন।
রাজসিংহ তাঁর বন্ধু সিংহলের রাজার কাছে আশ্রয় নেন। পরে পরাক্রান্ত
(প্রথম) সিংহল আক্রমণ করে উভয় রাজাকে
পরাস্ত করেন। এই সময় মাদুরাই এবং পাণ্ড্যরাজ্যের একাংশ
চোলদের দখলে চলে যায়।
বারকুটের রাজা কৃষ্ণ (তৃতীয়) গঙ্গ রাজার সাথে জোট বেঁধে
চোলরাজা পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। উভয় শক্তি ৯৪৯
খ্রিষ্টাব্দে তাক্কোলামের যুদ্ধে চোল বাহিনীকে পরাজিত করেন। এর ফলে তোণ্ডামণ্ডলমে
চোল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পরাক্রান্তের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকুটরা
তোণ্ডামণ্ডলম করে নেয়। এ সময়ে স্থানীয় পাণ্ড্যরাজা
চোলরাজ্যের একাংশ দখল করে নেয়। ধীরে ধীরে চোল রাজ্য ক্ষয়িষ্ণু রাজ্যে পরিণত
হতে থাকে। এই অবস্থায় চোল রাজা সুন্দর ভেঙে পড়া দুর্বল
চোল সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেন। তিনি প্রথমে পাণ্ড্য
রাজা বীরকে পরাজিত করেন এবং তোণ্ডালম থেকে রাষ্ট্রকুটদের বিতারিত করেন।
৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে চোল সিংহাসনে বসেন সুন্দরের পুত্র রাজরাজ।
রাজরাজ সিংহাসন লাভের পর প্রথমে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে
তোলেন। এর উদ্দেশ্যে সমুদ্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করা। সে সময়ে আরব বণিকরা মালাবার
বন্দরে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। এদের সহায়তা করেছিল কেরালার চের শাসকেরা।
আরব বণিকরা এই সুযোগ নিয়ে চীন ও মালাবারের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লাভ করেছিল।
রাজরাজ তাঁর শক্তিশালী নৌবাহিনী দিয়ে প্রথম চের-নৌবাহিনীকে ধ্বংস করে দেন এবং
কেরালার চের বন্দরগুলো দখল করে নেন। যুদ্ধের শুরুতে চোল সৈন্যরা ত্রিবেন্দ্রমের
কাছে চেরদের পরাজিত করেন। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য অঞ্চল দখল করতে থাকেন। ফলে আরব
বণিকরা অবাধ বাণিজ্য সুবিধা হারায়। এরপর রাজরাজের সেনাবাহিনী পাণ্ড্যরাজ্য আক্রমণ
করে এবং মাদুরাই দখল করে নেয়। এই সময় পাণ্ড্য রাজা অমরভুজঙ্গ চোল সৈন্যদের হাতে
বন্দী হন। এরপর চোল সৈন্যরা উদ্গাই দুর্গ দখল করে।
১০৪৪
খ্রিষ্টাব্দে চোলরাজা
রাজেন্দ্র (প্রথম) মৃত্যুবরণ করলে, রাজরাজ (দ্বিতীয়)
চোলরাজ্যের সিংহাসন লাভ করেন। রাজরাজ সিংহাসন দখলের পর চালুক্যরা চোলরাজ্য আক্রমণ
করে। এই সুযোগে পাণ্ড্যরা বিদ্রোহ করে। কিন্তু রাজরাজ পাণ্ড্যদের এই বিদ্রোহ
দমন করেন।
১০৭০
খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে চোলরাজ কুলতুঙ্গ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এঁর শাসনামলে
পাণ্ড্য ও চেররা বিদ্রোহ করলে, কুলোতুঙ্গ তা কঠোর হাতে দমন করেছিলেন। ১১২০
খ্রিষ্টাব্দে কুলোতুঙ্গ মৃত্যুবরণ করলে, রাজরাজ (দ্বিতীয়) সিংহাসন লাভ করেন। তিনি
কোনো মতে রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও ধীরে ধীরে রাজশক্তি দুর্বল হতে থাকে।
১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজরাজ (দ্বিতীয়) মৃত্যুবরণ করলে, রাজত্ব লাভ করেন রাজাধিরাজ (দ্বিতীয়)।
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজাধিরাজ (দ্বিতীয়) -এর মৃ্ত্যুর পর রাজাধিরাজ (তৃতীয়) সিংহাসন
লাভ করেন। এই সময় পাণ্ড্যরা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠে।
১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে জটাবর্মণ সুন্দর পাণ্ড্য রাজ্যকে শক্তিশালী করে তোলেন। এরা চোল
রাজ্য আক্রমণ করে তাঞ্জোর দখল করে নেয়। এরপর চোল রাজ্য এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে, এরা
পাণ্ড্যদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দে জটাবর্মণ সুন্দরের মৃত্যু হয়।
এরপর পাণ্ড্যরাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান
আলাউদ্দিন খিলজীর সেনাপতি মালিক কাফুর দেবগিরি আক্রমণ করে। একই সময়ে পাণ্ড্যরাজ্য
আক্রমণ করে মাদুরা নগরীতে লুণ্ঠন চালায়।
ষোড়শ শতাব্দীতে এই রাজ্য বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর এই
রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।