রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ
নাম রোহিঙ্গা। তবে কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে এই জনগোষ্ঠীতে রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর
সাথে
আরাকান রাজ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
প্রাচীন তথ্যানুসারে জানা যায়, ক্লডিয়াস টলেমি এই অঞ্চলকে
Argyré
নামে অভিহিত করেছিলেন। পর্তুগিজ নাবিকরা এর নাম
দিয়েছিলেন Arracao
ইউরোপ ও ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এর পরিচয় ছিল
আরাকান। বঙ্গদেশের এর প্রাচীন রোসাং। অন্যদিকে আরব বণিকদের কাছে এর
নাম ছিল রোহাং। বার্মা অধিবাসীদের কাছে এর ঐতিহ্যগত নাম ছিল রাখাইন।
খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বঙ্গের চন্দ্রবংশীয় শাসকদের
লেখাসমূহ থেকে,
তাদের আদি বাসভূমি হরিকেল সীমার মধ্যে ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময়ে এই
রাজ্যটি সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা থেকে রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিল। এ বিষয়ে
শ্রীচন্দ্রের বেশ কিছু ফলক থেকে জানা যায়, চন্দ্রবংশের প্রথম শাসক ত্রৈলোক্যচন্দ্র
কার্যত এবং আইনত উভয় প্রকারেই হরিকেলের রাজা ছিলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্র তাঁর পিতার
কাছ থেকে হরিকেল রাজ্যের একজন সামন্তের মর্যাদা লাভ করেন এবং তিনিই শক্তি সঞ্চয়
করে হরিকেল রাজার প্রধান সহায়ক শক্তিতে পরিণত হন। পরবর্তী সময়ে সে অবস্থা থেকে
তিনি একজন সার্বভৌম রাজা হন। ধারণা করা হয়,
আরাকান
সীমান্তবর্তী
চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ রাজ্য অবস্থিত ছিল।
খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে আরব বণিক এবং ইসলাম ধর্ম-প্রচারকরা এই অঞ্চলে আসা-যাওয়া
শুরু করে। এই সূত্রে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজা মহত চন্দ্রের
রাজত্ব কালে (৭৮৮-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ)
কয়েকটি আরব বাণিজ্য জাহাজ আরাকানের নিকটে একটি দ্বীপের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়।
এর ফলে আরবীয় মুসলমান নাবিকরা আরাকান সংলগ্ন সমুদ্রতীরে উঠে। কথিত আছে, আরবীয়
মুসলমানরা জাহাজ ডুবির পর, রহম রহম বলতে তীরে উঠেছিল। এই কারণে, স্থানীয় অধিবাসীরা
এদেরকে রহম গোত্রের মানুষ হিসেবে ডাকতো। ক্রমশ শব্দটি বিকৃত হয়ে রোঁয়াই রোঁয়াই
রোঁয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
এদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক
অধ্যায়ের সূচনা হয়। আরব বণিকদের অনেকে স্থানীয় মেয়েদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে
তোলে। এর ফলে নৃতাত্ত্বিকভাবে রাখাইনদের একাংশ সঙ্কর জাতিতে পরিণত হয়। ৮৫১
খ্রিষ্টাব্দে আরবের প্রখ্যাত ভূগোল বিশারদ সুলায়মানের রচিত ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারিখ’
গ্রন্থে বঙ্গোপসাগরের তীরে ‘রুহমী’ নামক দেশের নাম পাওয়া যায়।
অনেকে মনে করেন, আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের রোহা জেলার অধিবাসীদের বংশধর
হল রোহিঙ্গারা । তারা মূলত তুর্কী কিংবা আফগানী বলে ধারণা করা হয়। বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসকগণ ইসলাম
প্রচার ও প্রসারের জন্যে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে
প্রেরণ করে ছিলেন বলে ধারনা করা হয়। আর এ রোহার অঞ্চলের লোকেরা আরাকানের নামকরণ
করেছিলেন রোহাং। এ রোহা বা রোহাং অঞ্চলের বাসিন্দারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত হয়ে
উঠেন।
রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়-১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের পরে। উল্লেখ্য,
১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মিন সো মোন (নারমেইখ্লা) নামক জনৈক যুবারাজ মাত্র ২৪ বছর বয়সে পিতার
সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময়, লেম্ব্রো নদীর তীরে লংগ্রেত তার রাজধানী ছিল। মিন সো
মোন
সিংহাসনে আরোহণ করার কিছুদিন পর একজন দেশীয় সামন্ত রাজার ভগ্নিকে অপহরণ করে রাজধানী
লংগ্রেতে নিয়ে আসেন। ফলে আরাকানের সকল সামন্ত রাজারা একত্রিত হয়ে বার্মার রাজা
মেঙশো আইকে আরাকান দখলের অনুরোধ করেন। ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা ত্রিশ হাজার
সৈন্য নিয়ে আরাকান রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজা মিন সো মোন পালিয়ে যান এবং তৎকালীন বাংলার
রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। উল্লেখ্য,সে সময় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ গৌড় থেকে বাংলা শাসন করতো।
জনশ্রুতি রয়েছে, নারমেইখ্লা গৌড়ে এসে সুফী হযরত মুহম্মদ জাকির রহমতুল্লাহি আলাইহি নামক
একজন বিখ্যাত কামিল ব্যক্তির দরবার শরীফ-এ আশ্রয় নেন। এরপর তিনি সুদীর্ঘ ২৪ বছর গৌড়ে
অবস্থান করেন এবং ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতা ও রাজনীতি অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি ইসলাম
ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের বৌদ্ধনাম বদলিয়ে মুহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম গ্রহণ করেন।
গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহ মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ ২৪ বছর পর, ১৪৩০
খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্য বাহিনী দিয়ে মুহম্মদ
সোলায়মান শাহকে
তার রাজ্য উদ্ধারের জন্যে পাঠান। ওয়ালী খানের সহায়তায় সহায়তায়
সোলায়মান শাহ আরাকান রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং ম্রাউক-উ-তে নতুন রাজধানী স্থাপন
করেন।
১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি ওয়ালী খান বিদ্রোহ করেন এবং নিজেই আরাকান দখল করে নেয়।
গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহ পুনরায় সোলায়মান শাহকে (নারমেইখ্লা) সাহায্যের জন্যে
সেনাপতি সিন্ধিখানের নেতৃত্বে আবার ত্রিশ হাজার সৈন্য পাঠান। সোলায়মান শাহ
সিন্ধিরখানের সহায়তায় পুনরায় আরাকান জয় করেন। সে সময় গৌড় থেকে আসা সৈন্যরা আরাকানেই
বিশেষ রাজকীয় আনুকূল্যে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। সিন্ধি খানের সহযোগিতায় সোলায়মান শাহ
১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দে পিতার শাসনামলে থাকা রাজধানী লংগ্রেত থেকে রোহং নামক স্থানে
রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। যেসব সৈন্য ও কর্মচারী নরমেইখলার সাথে গৌড় থেকে
এসেছিলেন, তারা সকলেই থেকে যান এই রোহং শহরে। এর ফলে আদি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাথে
বাংলা থেকে আসা মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটে।
গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহ মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ ২৪ বছর পর ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্য বাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে তার নিজের রাজ্য আরাকান উদ্ধারের জন্যে সাহায্য করেন। ওয়ালী খানের সহায়তায় সহায়তায় নরমিখলা আরাকান রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং ম্রাউক-উ নামক এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠান করেন। নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ-এর সূত্রে আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের আধিপত্য শুরু হয়।
১৪৩১ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে আরাকান রাজ্য ১৩ জন রাজা শাসন করেছে। তবে এসব
রাজাদের গড় শাসনকাল দুই বছরের বেশি ছিল না। এই সময়ে আরাকানের রাজারা মুসলিমদেরকে রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন। ১৭
শতকের দিকে আরাকানে বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের
বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করতো। রাজার সৈন্যবাহিনীতে ছিল মুসলমানদের আধিপত্য ছিল
এবং মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশই মুসলমান ছিলো। এই সময় কাজী নিয়োগ করে বিচারকার্য
পরিচালিত হতো। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মিয়ানমার সরকারের
নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা
অংশ ছিল। জাতি সত্তার বিচারে এই সময় রোহিঙ্গা কোনো বিশেষ অর্থ বহন করতো না। এদের
প্রধান পরিচয় ছিল, আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী। এই সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাথে
রোহিঙ্গাদের তেমন বিরোধের তথ্য পাওয়া যায় না। এই বিরোধের সূত্রপাত হয় ১৭৮৪
খ্রিষ্টাব্দের পরে।
১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদপায়া আরাকান আক্রমণ করেন। এই সময় হাজার হাজার আরাকানী
পালিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এর ভিতরে আরকানের সকল জনগোষ্ঠীর
মানুষই ছিল। ভোদপায়া এই অঞ্চলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য, স্থানীয় বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন এবং রোহিঙ্গারা বহিরাগত হিসেবে প্রচার
করেন। একই সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি লুটপাটের সহায়তা করে ভোদপায়ার সৈন্যরা। এর ফলে
আরকান অঞ্চলের সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপিত হয়। আরাকান দখল করার পর, বোধপায়ার আরাকানী সৈন্যদের সাধারণ
ক্ষমা ঘোষণা করে এবং সবাইকে অস্ত্র ফেলে সেনানিবাসে এসে আত্মসমর্পন করে নিরাপদে নিজ
নিজ ঘরবাড়িতে থাকার সুযোগ লাভের উপদেশ দেয়। কিন্ত সৈন্যরা সেনানিবাসে এসে
আত্মসমর্পন করলে ভোদপায়া মুসলিম সেনারা সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
এরপর ভোদপায়া সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের নির্দেশ দেয়। ফলে
রোহিঙ্গারা আরকান ছেড়ে
চট্টগ্রামের দিকে
পালিয়ে আসতে থাকে। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতের প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ
চট্টগ্রাম
অঞ্চলে চলে আসে। ইতিমধ্যে আরাকানীদের একাংশ অতর্কিত বর্মী বাহিনীর উপর হামলা চালাতে
শুরু করে। অন্যদিকে বিদ্রোহী আরাকানীদের আশ্রয়স্থলগুলো
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির
শাসনাধীন এলাকায় পরিণত হয়। বার্মার রাজা এদের মূল নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে
ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি
ছলছাতুরীর
আশ্রয় নিয়ে তিনজন বিদ্রোহী আরাকানী নেতাকে বন্দি করে বার্মা রাজার কাছে প্রেরণ করে।
বার্মার সৈন্যরা বন্দিদের চোখ উপড়ে জলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে তাদের মেরে ফেলে !
এরপর সিনপিয়া নামক জনৈক নেতা বিদ্রোহীদের আরো সুসংগঠিত করে আরাকানে অবস্থান নেওয়া
বর্মি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিপর্যন্ত করে তুলেন। এক পর্যায়ে সিনপিয়া
রাজধানী ম্রোহং ব্যতীত সমগ্র আরাকান দখল করে নেয়। এ সময় সিনপিয়ার বাহিনীতে তীব্র
গোলাবারদ ও রসদের অভাব দেখা দিলে
ইষ্ট-ইন্ডিয়া
কোম্পানির কাছে গোলাবারুদ ও রসদ
সরবরাহ করার জন্যে অনুরোধ করে। কিন্তু কোম্পানি এই সাহায্য দিতে অস্বীকার করে।
পুনরায় নতুন বর্মি বাহিনী আরাকানে অভিযান চালালে, সিনপিয়া বাঁশের বর্শা এবং
তীর-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সিনপিয়া পরাজয় বরণ করেন।
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি
১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকান পুরোপুরি দখল করে নেয়।
এরপর কোম্পানি এবং পরবর্তী ব্রিটিশ প্রশাসন,
আরকান অঞ্চলে কৃষিকাজের সম্প্রসারণের জন্য বাংলা থেকে কৃষকদের চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ
করতে থাকে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কালক্রমে এরাও রোহিঙ্গাদের অংশ হয়ে যায়। একই সাথে রাখাইন বৌদ্ধদের সাথে শত্রুতা
বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার
অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ
অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে।
কিন্তু এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার কারণে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ বার্মা আক্রমণ করে।
ব্রিটিশরা জাপানিদের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে
ব্যাপকহারে সেখানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম
রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে
ব্রিটিশপন্থীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানিদের আক্রমণের
সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থী অস্ত্রধারী মুসলিমদের দল বাফার জোন সৃষ্টি
করেছিল।
রোহিঙ্গারা এই যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষ তথা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল এবং জাপানি
শক্তির বিরোধিতা করেছিল।
১৯৪২ সালের মধ্য জানুয়ারির দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে জাপানি সৈন্য
বার্মা দখল করে নেয়। এরপর স্থানীয়
মগরা জাপানি সৈন্যদের সহায়তায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।
ইতিহাসে এই গণহত্যাটি ১৯৪২ সালের গণহত্যা নামে খ্যাত। এই গণহত্যায় ১ লাখ ৭০ হাজার
থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এই গণহত্যার শুরুর দিকে প্রায় ২২ হাজার
রোহিঙ্গা আরাকান ছেড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় ৫০ হাজার
রোহিঙ্গা চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের থাকার ইচ্ছায়, মোহম্মদ আলী
জিন্নাহর সাথে একাধিক বৈঠক করে। তারা রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে
সংযুক্ত করে বুথিডং ও মংদৌ নামে দুটি শহরের একত্রীকরণের প্রস্থাব প্রদান করেন। এর
দুই মাস পর রোহিঙ্গা মুসলমানরা আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠন কর পাকিস্তানের
সঙ্গে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বার্মা থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে। জিন্নাহ এই
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে আরকানে রাখাইন বৌদ্ধারা রোহিঙ্গাদের 'বেঈমান'
হিসেবে প্রচারণা চালায়। এই সূত্রে ইংরেজরা রোহিঙ্গাদের দেওয়া 'সন্দেহভাজন নাগরিক'
হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এই
সময় রাখাইন মুসলমানরা 'সন্দেহভাজন নাগরিক' হিসেবেই থেকে যায়। ফলে বার্মায় আরাকানি বৌদ্ধ এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের
মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এই বছরের নভেম্বর মাসে উ নু-র শাসনামলে (৫তম
বার্মা রেজিমেন্ট) সামরিক অভিযান চালায় এবং এই সময় মগ সেনাদের নিয়ে
Burma Territorial Force
গঠন করে, রোহিঙ্গাদের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। এর ভিতর দিয়ে রোহিঙ্গারা এই
স্বাধীনতার দাবিতে ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।।
১৯৪৯-১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের দমন করার জন্য বার্মা সরকার- 'বার্মা টেরিটোরিয়াল ফোর্স অপারেশন' অভিযান পরিচালিত হয়। বিদ্রোহ দমনের নামে
এই অভিযানে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান,
আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের
পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর সেখানে মগদের জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়।
১৯৫১-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত মিলিটারি অপারেশনে অংশগ্রহণ করে (২য় ইমার্জেন্সী
কিন রেজিমেন্ট) শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে 'অপারেশন মায়ু' নামক অভিযানে রোহিঙ্গাদের
উচ্ছেদ করার কার্যক্রম চালানো হয়। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যান্ত এই অপারেশন চলেছিল। এই
সময়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও প্রতিবাদ দানা বাঁধতে
থাকে এবং অনেকেই বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দান করে।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে 'অপারেশন মনসুন' নামে কঠোর অভিযান শুরু
করে।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে 'সম্মিলিত ইমিগ্রেশন ও
আর্মি অপারেশন' পরিচালিত হয়। এতে অংশগ্রহণ করেছিল সামারিক বাহিনী ও পুলিশ। এই
অভিযান চলেছিল ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের পরিচালিত হয় 'কেপ্টেন হটিন কাও অপারেশন'। এই অভিযানেও
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্রতর নিপীড়ন করা হয়েছিল।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার শাসন ক্ষমতা চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে। এই সময়
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে। জেনারেল নে-উইন প্রধানমন্ত্রী উ
নুকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সামরিক অফিসারদের নিয়ে বার্মা সোশালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি
গঠন করে বার্মাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ক্ষমতা দখলের পর নে উইন
সংখ্যালঘুদের সব সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দেন। এই সাথে শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন
পরিকল্পনা।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গাদের সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে বার্মা বেতার থেকে রোহিঙ্গা ভাষার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া আরাকানকে বৌদ্ধ শাসিত অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। জেনারেল নে-উইনের
সামপ্রদায়িক নীতির ফলে রোহিঙ্গাসহ আরাকানের অন্যান্য মুসলিম জাতির সঙ্গে বৌদ্ধদের
সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও দাঙ্গা বৃদ্ধি বাড়তে থাকে।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে 'শুয়ে কাই অপারেশন' নামক অভিযান শুরু
হয়েছিল। এই অভিযানে দাঙ্গা রোধের নামে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়।
১৯৬৭-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালত হয় 'এঙ্গাজিংকা অপারেশন'। এই অভিযানটি ছিল
রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করার জন্য পরিচালিত হয়েছিল।
১৯৬৯-১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে 'মায়াত মন অপারেশন' অপারেশন পরিচালিত
হয়েছিল। এটি ছিল-'এঙ্গাজিংকা অপারেশন' অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আরাকানে মেজর অং থান অপারেশন
(Major Aung Than operation)
পরিচালিত হয়েছিল। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর আরাকান থাকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ
করা।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সাবে অপারেশন
(Sabe operation)
নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান
শুরু করে। এ অভিযানের ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন
বাঁচাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে এসে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ নেয়। সে
সময় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় অবস্থান ও
চরমপত্রের কারণে বার্মা সরকার বিতাড়িতদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এই বছরে আরাকান
রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাখা হয়। তবে 'সাবে অপারেশন' চলেছিল ১৯৭৮
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে 'নাগা মিন (কিং ড্রাগন) অপারেশন' অভিযান
পরিচালিত হয় জেনারেল নে-উইন-এর নেতৃত্বে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত আন্দোলন
দমন করা। এই সময় আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের
সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে নির্বিচারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। সে সময়
নাগামিন ড্রাগন অপারেশনের ফলে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হয়ে
বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৯
খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর থেকে ২৪শে ডিসেম্বরের
মধ্যে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা স্বদেশে ফিরে গেলেও ১৫ হাজার রোহিঙ্গা তখন
বাংলাদেশে থেকে যায়।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের 'নাগা মিন (কিং ড্রাগন) অপারেশন' চলাকালেই জেনারেল নে-উইন নতুন
'শয়ি হিন্থা অপারেশন' অভিযান শুরু করে আগস্ট মাসে। এটি ছিল 'নাগা মিন (কিং ড্রাগন)
অপারেশন'-এর পরিপূরক অভিযান।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে 'গালন অপারেশন' অভিযান। এটি ছিল 'নাগা মিন (কিং ড্রাগন)' এবং
'শয়ি হিন্থা অপারেশন'- ধারাবাহিক অভিযান স্বরূপ।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারের নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইন দ্বারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব
বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে বার্মায় রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি অর্জন, রাজনৈতিক অধিকার ও অবাধ
বিচরণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
১৯৯১-৯২ খ্রিষ্টাব্দে
The State Law and Order Restoration Council (SLORC)
এর মাধ্যমে 'পাই থায়া অপারেশন' নামক অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার
শুরু করে। এসময় মায়ানমারের সৈন্য ও স্থানীয় রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ,
শিশু চুরি, মসজিদ ভেঙে দেয়া, গ্যাটোতে স্থানান্তর, ধর্মপালনে বাধা দেয়া,
বাংলাদেশে পুশ ইনসহ সামরিক ক্যাম্পে বাধ্যতামূলক শ্রমে বাধ্য করে। এর ফলে প্রায় দুই
লাখ ৬৮ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই অভিযান চলেছিল ১৯৯২
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে পূর্বের অভিযানগুলোর ধারাবাহিকতায় 'নাসাকা অপারেশন' পরিচালিত হয়।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানে জাতিগত দাঙ্গা হয়। এর শুরু হয়েছিল রোহিঙ্গা
দুষ্কৃতিকারী দ্বারা এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণ করার সূত্রে। শুরুর দিকে এটি স্থানীয়
দাঙ্গা থাকলেও মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধ মৌলবাদীরা মিলে
রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু করে। এর ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা গৃহ হারা
হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসে। এই সময় বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানের মুখের সরাসরি
প্রবেশে বাধা পেলেও, পাহাড়ি দুর্গম সীমান্ত দিয়ে নানা উপায়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা
বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে আদমশুমারির সময় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু বৌদ্ধ চরমপন্থিরা এর প্রতিবাদ জানায়
এবং শুমারি বর্জনের হুমকি দেয়। এই হুমকির মুখে রোহিঙ্গাদরে 'বাঙালি' হিসেবে শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত
করার কথা ঘোষণা করে।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধ চরমপন্থিদের দাবির মুখে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার
হরণ করা হয়। শুরুর দিকে সামরিক সরকার ঘোষণা করেছিল যে, যাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র আছে
তারা সংবিধান সংক্রান্ত গণভোটে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু চরম পন্থী বৌদ্ধদের
প্রতিবাদের মুখে সরকার অস্থায়ী পরিচয়পত্র বাতিল করে দেয়।
মিয়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে কোন বিদেশী সে দেশের কোন সম্পত্তি ও
ভূমি মালিকানা পেতে পারে না। আর রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমার সরকারের আইন অনুসারে
(১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়) অবৈধ অভিবাসী তথা, বিদেশী। এই কারণে
রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যে সকল
ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মিয়ানমার সরকার চাইলে যেকোন মুহূর্তে সেগুলো দখল
নিতে পারবে।
মিয়ানমার সরকার বৈষম্যমূলক আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জীবন রীতিমত অসহনীয় করে
তুলেছে। রোহিঙ্গা লোকজন সরকারি কোন চাকরি করতে পারে না, সরকারি কোন দপ্তরে
রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের
সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে
পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা
বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত। তবে তারা ধর্মীয় মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করে।
২০১৭
খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগষ্ট একটি বিদ্রোহী দল রাখাইনের কয়েকটি তল্লাশি চৌকিতে
হামলা করে। এরপর খ্রিষ্টাব্দে
মায়ানমার সেনাবাহিনী 'ক্লিয়ারেন্স
অপারেশন' শুরু করে। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিধন ও উচ্ছেদ অভিযান
শুরু করে । এই সময় মায়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক
হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি, রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়,
ধর্ষণ ও শিশু হত্যা করে। এর ফলে ৭ লাখের বেশি
রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
এর ফলে প্রায় ৮ লক্ষ
রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
তবে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্যাতনের পরে এ দেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা কত— তা
নিয়ে স্থানীয়দের সাথে জাতিসংঘের
তথ্যর বিশাল ব্যবধান লক্ষ্য করা যায় ।
ইউএনএইচসিআরের মতে ২৪ আগস্ট ২০১৭ এর পর আরাকান থেকে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৮২ হাজার
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিদের
ধারণা, নতুন অনুপ্রবেশ
করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।
রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার
মায়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানে রোহিঙ্গাদের
ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অভিযোগ তোলে। ঐ ঘটনার দুই বছরের
বেশি সময় ধরে, বিশ্বব্যাপী বিশেষ আলোচিত বিষয়ে হিসেবে প্রাধান্য
পেতে থেকে। কিন্তু চীনের বিরোধিতার কারণে, তেমন কোনো সুফল পাওয়া যায় নি। অবশেষে
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি)
সমর্থনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে আফ্রিকা
মহাদেশের গাম্বিয়া।
এই দিন নেদারল্যান্ডের পিস প্যালেসে অবস্থিত
আইসিজেতে গাম্বিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলাটির শুনানি শুরু হয়।
মামলার শুনানিতে গাম্বিয়াকে নেপথ্যে থেকে
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ, কানাডা ও
নেদারল্যান্ডস। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস যৌথ বিবৃতিতে গাম্বিয়াকে
সহযোগিতা করার কথা স্পষ্ট
জানায়।
রোহিঙ্গাদের ভাষা
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধুনিক লিখিত ভাষাই হল রোহিঙ্গা
ভাষা। ভাষা-পরিবারের বিচারে এটি ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এর সাথে
সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মিল রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলা
রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় ভাষার স্থান অধিকার করেছে।