টর্নেডো
ইংরেজি :
tornado
এক প্রকার ঘূর্ণিঝড়।
স্প্যানিশ শব্দ tronada (বজ্রঝড়)
শব্দ থেকে ইংরেজি ভাষায় tornado
শব্দটি যুক্ত হয়েছে। বাংলা টর্নেডো এসেছে
ইংরেজি থেকে।
ঘূর্ণায়মান বায়ু প্রবাহের শুরুতে উত্তপ্ত এবং আর্দ্র বাতাস উপরে উঠে গিয়ে
ঝড়োমেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘের একটি সরু অংশ ভূমি সংলগ্ন হয়ে ঘুরতে
থাকে। ঘূর্ণায়মান এই অংশটি একটি সরু চোঙার মতো মনে হয়। এই চোঙাযুক্ত মেঘকে বলা
হয় চোঙাকৃতির মেঘ (funnel cloud।
এই চোঙা অংশটি ঘুরতে ঘুরতে অগ্রসর হয়। এর ফলে যে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়, তাকে
টর্নেডো বলা হয়।
টর্নেডোর সাথে মেঘটি কয়েকশত মিটার বিস্তৃত থাকে। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল চোঙা
একটি ছোট ধুলা বা জলের ঘূর্ণিস্তম্ভ সৃষ্টি করতে পারে। এই স্তম্ভ অনেক সময় ভূমি
পর্যন্ত বিস্তৃত নাও থাকতে পারে। যদি বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ মাইলের (বা ঘণ্টায়
৬৪ কিমি) বেশি হয়, তবে এ ঘূর্ণনস্তম্ভকে টর্নেডো হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অনেক সময় একটি টর্নেডো থেকে একাধিক টর্নেডো তৈরি হতে দেখা যায়। টর্নেডো তৈরির
এই প্রকৃতিকে বলা হয় চক্রিক টর্নেডো। অনেক সময় আদি টর্নেডো নতুন টর্নেডোর সাথে
যুক্ত হয়ে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠে। অনেক সময় একই এলাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে
ক্রমাগত একের পর এক টর্নেডো তৈরি হতে দেখা যায়। এই জাতীয় টর্নেডো একটি অঞ্চলকে
ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। এই জাতীয় টর্নেডোকে বলা হয় ক্রমধ্বংসাত্মক টর্নেডো
(Tornado outbreak)।
অনেক সময় একটি শক্তিশালী টর্নেডো তৈরি হওয়ার পর, তার কাছাকাছি একাধিক দুর্বল
টর্নেডো তৈরি হয়ে থাকে। এই সকল দুর্বল টর্নেডো শক্তিশালী টর্নেডোকে কেন্দ্র করে
আবর্তিত হতে থাকে। এই সকল আবর্তিত দুর্বল টর্নেডোগুলোকে বলা হয় উপ-টর্নেডো
(Satellite tornado)।
এই জাতীয় একাধিক টর্নেডোযুক্ত বৃহৎ টর্নেডোদলকে বলা হয় বহুসদস্যময়
টর্নেডো (Multiple vortex
tornado)।
বড় একক টর্নেডোগুলির স্তম্ভ দেখতে অনেকটা ভূপৃষ্ঠে পোঁতা কীলকের (Wedge) মত দেখায়। এজন্য এগুলোকে অনেক সময় কীলক টর্নেডো বলে। এই কীলকাকৃতির টর্নেডোগুলো এতই বিস্তৃত হয় যে শুধু ঘন কালো মেঘের স্তুপই দেখা যায়, বিস্তারে ভূপৃষ্ঠ থেকে মেঘের দূরত্বের চাইতেও বেশি বিস্তৃত হয়।
টর্নেডোর শেষ পর্যায়ে স্তম্ভটির আকার হ্রাস পেতে থাকে। শেষ পর্যায়ে দেখতে সরু নল বা
দড়ির মত লাগে। অনেক সময় এই চোঙা বেঁকে গিয়ে নানা জটিল আকৃতি নেয়। একে বলা হয়
রোপিং আউট। বহু-ঘূর্ণি টর্নেডোগুলো দেখতে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রকে আবর্তিত অসংখ্য
ঘূর্ণির মত লাগে, অথবা ঘনীভবন, ধুলাবালি এবং বর্জ্যের কারণে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে
একটি চোঙায় রূপ নেয়। এসব বিষয় দেখে টর্নেডোর একটি আকৃতি দেখা যায়। তবে বৃষ্টি এবং
ধূলার কারণে অনেক সময় টর্নেডোর প্রকৃত আকৃতি বোঝা যায় না। এছাড়া এই টর্নেডোগুলো
এতটাই বিপদজনক, যে নিবিড়ভাবে কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঘণ্টায়
৬৪ কিমি বাতাসের গতি আছে, এমন সাধারণ মানের টর্নেডোর চেয়ে উচ্চগতির টর্নেডোর
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পড়ে। এর প্রভাবে বড় বড় গাছ উপড়ে যায়। কাঁচা
বাড়িঘরকে তুলে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করতে পারে। দ্রুত গতির একটি টর্নেডো বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০-৪৮০
কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
প্রকৃত টর্নেডো দেখা যায় এন্টার্কটিকা মহাদেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া এছাড়া দক্ষিণ কানাডা, দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারত), দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বমধ্যাংশ, আফ্রিকা দক্ষিণাংশ, উত্তরপশ্চিম এবং দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, ইটালি, পশ্চিম এবং দক্ষিণপূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে টর্নেডো হতে দেখা যায়।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে সংঘটিত টর্নেডো |
প্রকৃতিতে এমন কিছু ঘূর্ণিঝড় হয়, যেগুলো মূলত টর্নেডো নয়। কিন্তু সাধারণভাবে অনেক সময় এগুলোকে টর্নেডোর পর্যায়ে ফেলা হয়ে থাকে। এই জাতীয় ঘূর্ণিঝড়গুলো হলো−
সাধারণ ঘূর্ণিঝড়
(Gustnado)
এই জাতীয় ঝড়ের বাতাস ঘূর্ণায়মান থাকে, কিন্তু কোনো ঝড়োমেঘের সাথে চোঙাজাতীয়
বায়ুপ্রবাহ দ্বারা ভূমির সম্পর্ক থাকে না। ফলে এই ঘূর্ণিবায়ু কোনো ক্ষুদ্র অংশের উপর প্রবল বেগে আবর্তিত
হতে থেকে। ভূমি সংলগ্ন গাছপালা, ঘড়বাড়ি, পাহাড়-টিলা ইত্যাদির দ্বারা
বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় অগ্নিগর্ভমেঘ থেকে বজ্রসহ বৃষ্টি
হওয়ার কারণে ওই স্থানের বাতাস শীতল ও ভারি হয়ে পড়ে। ফলে কয়েক ঘণ্টার ভিতর এই ঝড়
থেমে যায়। কিন্তু এই সামান্য সময়ের ভিতরে একটি ক্ষুদ্র ব্যাসের ভিতর ব্যাপক
ক্ষতি করে।
ধূলিময় ঘূর্ণিঝড়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনার জনসনভিলে সৃষ্ট একটি ঘূর্ণি ধূলিঝড় |
অনেক সময় কোনো
ধূলিঝড় টর্নেডোর মত স্তম্ভাকারে ঘুরতে থাকে এবং এই ঘূর্ণন ধূলিঝড়কে বলা ডাস্ট ডেভিল নামে ব্যাপক পরিচিত।
শক্তির বিচারে এগুলো অত্যন্ত দুর্বল। যদি নিম্নস্তরের বায়ুর গতি ও দিক দ্রুত
পরিবর্তিত হয়, তবে এই উষ্ণ ও উর্দ্ধমুখী বায়ুস্তম্ভ একটি ক্ষুদ্র ঘূর্ণির
সৃষ্টি করতে পারে যা ভূপৃষ্ঠ থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। গরমের দিনে ভূমির নিকটবর্তী
বাতাস হালকা
হয়ে উপরে উঠার সময় এই জাতীয় ধুলিঝড়ের সৃষ্টি হয় এটা সৃষ্টি হয়। মেঘের সাথে এর
কোনো সম্পর্ক থাকে না এবং এর জন্য বৃষ্টি-বজ্র জাতীয় দুর্যোগের সৃষ্টি করে না।
এই কারণে এই ঝড়কে টর্নেডো বলা হয় না। তবে প্রবল ধূলি ঝড়ের কারণে জনজীবন
দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। খাদ্যদ্রব্য-সহ পানীয়জল দুষিত হয়ে পড়ে।
তুষার জলস্তম্ভ
(Winter Waterspout)
শীতপ্রধান দেশে এই জাতীয় ঘূর্ণিঝড়
সৃষ্টি হয়। প্রবলভাবে প্রবাহিত শৈতপ্রবাহ কোনো কোনো স্থানে ঘূর্ণিবায়ুর সৃষ্টি করে।
এর ফলে বরফের কণাগুলো ঘূর্ণায়মান অবস্থায় একটি স্তম্ভের আকার ধারণ করে। এই অবস্থায়
একে একটি জলস্তম্ভের মতো মনে হয়। এই ঘূর্ণঝড় আশপাশ অঞ্চলের তুষারপাতকে বৃদ্ধি করে।
তবে এই ঝড় খুব বেশি দেখা যায় না।
অগ্নি ঘূর্ণি
(Fire whirl)
কোনো বড় বনে
তীব্র দাবানলের সময়, অনেক ক্ষেত্রে ঘূর্ণন বাতাসের সৃষ্টি হয়। এর ফলে দাবানলের
তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফেলে দ্রুত আগুন বনের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বাভাবিকভাবে এই জাতীয় ঘূর্ণি ঝড়ে ঊর্ধ্বাকাশের মেঘ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে
না। তবে বড় ধরনের দাবানলে অগ্নিস্তম্ভ তৈরি হয় এবং আকাশের অনেক উপরে উঠে যায়। এই
অবস্থায় অনেকে একে টর্নেডো বলে থাকেন।
শীতল বায়ু ঘূর্ণি
(Cold air vortex)
অনেক সময় ঝড়োমেঘের কিছু নিচ বা পাশ
থেকে ক্ষুদ্রাকার অস্থায়ী চোঙার মতো নিচের দিকে নেমে আসে। ফলে দুর্বল ঘূর্ণিবায়ুর
সৃষ্টি করে। এই চোঙা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমি পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে ভূমিতে শীতল
বাতাসের ঝাপটা অনুভব করা যায়। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এই বাতাস বেশ মনোরমই মনে হয়। তবে
এর স্থায়ীত্বকাল খুবই কম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা কিইসে সৃষ্ট জলস্তম্ভ |
জলস্তম্ভ
(Waterspout)
পানির উপরে সৃষ্ট এমন এক ধরনের ঘূর্ণিঝড়, যা পানির উপর টর্নেডোর মতো চোঙা তৈরি করে
এবং উলম্বভাবে জলস্তম্ভ তৈরি করে। সাধারণ জলস্তম্ভ মেঘের সাথে যুক্ত হয়ে কোনো
প্রলঙ্করীয় কাণ্ড ঘটায় না। তাছাড়া ভাল আবহাওয়ায়
সৃষ্ট এই জলস্তম্ভ কম ভয়ংকর। এর সাথে
ঘূর্ণায়মান ধূলিঝড়ের বেশ মিল রয়েছে। পার্থক্য হলো ঘূর্ণায়মান ধূলিঝড় হয়
শুষ্কভূমিতে এবং এর উপাদন থাকে ধূলি। পক্ষান্তরে ঘুর্ণায়মান জলস্তম্ভ হয় জলাশয়ের
উপর এবং এর উপাদান থাকে জল। বাংলাদেশে কখনো কখনো এরূপ জলস্তম্ভ দেখা যায়। তবে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা
কিইসে এই জাতীয় জলস্তম্ভ বেশি দেখা যায়।
প্রকৃত টর্নেডো যদি কোন হ্রদ বা বিলের উপর হয়, তখন বিপুল পরিমাণ জল এবং জলজ উদ্ভিদ
ও প্রাণি ঊর্ধাকাশে উঠে যায়। এক্ষেত্রে এই সকল উপাদান পরবরতী সময়ে নিচে পতিত হয়।
তবে জল শোষণের কারণে এই জাতীয় টর্নেডো খুব স্বল্পস্থায়ী হয়। জলযানের জন্য এই
টর্নেডো ভয়ংকর।